অভিবাসন প্রক্রিয়া আরও সাশ্রয়ী করতে ডিজিটালাইজেশনে কাজ করছে ‘আমি প্রবাসী’

অভিবাসী শ্রমিকেরা আমাদের সমাজে বেশ অবহেলিত। অর্থনীতিতে তাঁদের যথেষ্ট অবদান থাকা সত্ত্বেও তাঁরা সবচেয়ে বেশি উপেক্ষিত এবং প্রতিনিয়ত হয়রানি ও দুর্নীতির স্বীকার। সংকটের অন্যতম বিদ্যমান নিয়ম পালনের জটিল প্রক্রিয়া, সরকারি অফিস, এজেন্সি ও মধ্যস্বত্বভোগীদের অফিসে একাধিকবার যাতায়াত এবং স্পষ্ট ও বিশ্বস্ত তথ্যের অপর্যাপ্ততা। এ ছাড়া অভিবাসী শ্রমিকেরা বিদেশে থাকার সময়ে তাঁদের সঙ্গে যোগাযোগের সহজ মাধ্যম কিংবা সহজে সরকারি সহায়তা পাওয়ার কোনো উপায় নেই। সবকিছুর মিলিত ফল: ব্যাপক অপব্যবহার, ক্রমবর্ধমান অভিবাসন ব্যয় ও প্রবাসীদের নিদারুণ কষ্ট।

আমি প্রবাসী কী
অভিবাসন–সংক্রান্ত অন্তর্নিহিত সমস্যাগুলো মোকাবিলা করতে তৈরি হয়েছে আমি প্রবাসী অ্যাপ ও ওয়েব পোর্টাল। প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা অনুযায়ী, মন্ত্রণালয়, জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরো (বিএমইটি) এবং থ্যান সিস্টেমসের (বাংলা ট্রাক কমিউনিকেশনসের অঙ্গপ্রতিষ্ঠান) মধ্যে সমঝোতা স্মারক ও পরিষেবা চুক্তির পর ২০২১ সালের মে মাসে ‘আমি প্রবাসী’ আনুষ্ঠানিকভাবে যাত্রা শুরু করে। বাংলাদেশ সরকারের জন্য তৈরি এ অ্যাপের জন্য মন্ত্রণালয় ও বিএমইটির কোনো অর্থ ব্যয় করতে হয়নি। এটি ঐচ্ছিক পরিষেবা চার্জ মডেলে কাজ করে।

ব্যবহারকারীদের জন্য ঘরে বসে অনায়াসেই সরকার নির্ধারিত নানা প্রক্রিয়া সম্পন্ন করার সুযোগ তৈরির সঙ্গে সঙ্গে বিদেশে বৈধ চাকরির খোঁজ, ট্রেনিং সেন্টারে ভর্তির আবেদন, চ্যাট সাপোর্ট ইত্যাদি ফিচার সহজলভ্য করার মাধ্যমে আমি প্রবাসী অভিবাসন প্রক্রিয়ায় স্বায়ত্তশাসন, স্বচ্ছতা ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করছে। অভিবাসন প্রক্রিয়াকে সম্পূর্ণরূপে ডিজিটালাইজ করতে আমি প্রবাসী অ্যাপ ও ওয়েব পোর্টাল ডিজাইন করা হয়েছে। এতে জড়িত সব পক্ষের সময়,অর্থ ও হয়রানি হ্রাস পাচ্ছে।
একদিকে আমি প্রবাসী যেমন বিএমইটি রেজিস্ট্রেশনের মতো ডিজিটাল সরকারি পরিষেবা চালুর ক্ষেত্রে অগ্রগণ্য ভূমিকা রাখছে, তেমনি দালাল বা মধ্যস্বত্বভোগীদের এড়িয়ে অভিবাসনপ্রত্যাশীদের সরাসরি বৈধ অসংখ্য রিক্রুটিং এজেন্সির সঙ্গে সংযুক্ত করছে।

সরকারি প্রক্রিয়া সম্পন্ন করার বিকল্প চ্যানেল
বিদেশে যেতে ইচ্ছুক কর্মীদের প্রয়োজনীয় সরকারি প্রক্রিয়াগুলো সম্পন্ন করার ক্ষেত্রে আমি প্রবাসী একটি বিকল্প ও অতিরিক্ত চ্যানেল। যে কেউ চাইলে এখনো সরকারি অফিসগুলোতে গিয়ে প্রক্রিয়াগুলো সম্পন্ন করতে পারবেন। কিন্তু সময়, যাতায়াত ও মাত্রাতিরিক্ত ‘স্পিড মানি’ (উৎকোচ) বিবেচনায় ডিজিটাল পদ্ধতি বেশি প্রাধান্য পাচ্ছে। অ্যাপটির মাধ্যমে একজন ব্যবহারকারী কোনো দালাল বা মধ্যস্বত্বভোগীর ওপর নির্ভরশীল না হয়ে নিজেই এসব প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে পারছেন।
বিদ্যমান সরকারি ম্যানুয়াল প্রক্রিয়ার সুবিধাভোগী গোষ্ঠী ও দালালদের শত বাধা ও অপপ্রচার সত্ত্বেও ২৫ লাখের বেশি ব্যবহারকারী নিয়ে আমি প্রবাসী দালালমুক্ত একটি কার্যকর ডিজিটাল অভিবাসন প্রক্রিয়া তৈরিতে এগিয়ে যাচ্ছে।

বিএমইটি তথ্যভান্ডার কী

বিদেশে চাকরি নিয়ে যেতে ইচ্ছুক বাংলাদেশিদের একমাত্র সরকারি তথ্যভান্ডার—বিএমইটি তথ্য ভান্ডার। একজন অভিবাসনপ্রত্যাশী তার দক্ষতা, শিক্ষাগত যোগ্যতা, পছন্দের দেশ ইত্যাদি তথ্য দিয়ে এ তথ্যভান্ডারে রেজিস্ট্রেশন করতে পারেন। মাত্র ১০০ সার্ভিস চার্জের বিনিময়ে আমি প্রবাসী তার ব্যবহারকারীদের এ তথ্যভান্ডারে ডিজিটালি এন্ট্রির সুযোগ করে দিয়েছে। আমি প্রবাসীর মাধ্যমে মাত্র ৬ মাসে বিএমইটি রেজিস্ট্রেশন ৫০০ শতাংশ বেড়েছে! প্ল্যাটফর্মটি এখন পর্যন্ত সরকারকে ২০ কোটি টাকার বেশি দিয়েছে।

করোনা ও অগ্রাধিকারভিত্তিক টিকা

বাংলাদেশ সরকার এবং প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় বিদেশগামী কর্মীদের জন্য অগ্রাধিকার ভিত্তিতে টিকাকরণ চালু করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। মন্ত্রণালয় নিবন্ধিত বিদেশগামী কর্মীদের বিএমইটি নম্বর ‘সুরক্ষা’য় প্রেরণ করে কর্মীদের অগ্রাধিকার ভিত্তিতে টিকা প্রদানের প্রস্তাব রাখে। মন্ত্রণালয়ের অনুরোধে পরিস্থিতির গুরুত্ব অনুধাবন করে মহামারির মধ্যে আমি প্রবাসী ১০ লাখের বেশি রেজিস্ট্রেশন সম্পন্ন করেছে। এতে সরকারের কোনো অতিরিক্ত অর্থ খরচ করতে হয়নি। আমি প্রবাসী পরিষেবার মাধ্যমে লাখ লাখ প্রবাসী বিভিন্ন জেলা জনশক্তি অফিসে সরাসরি যাতায়াত না করে ও লাইনে না দাঁড়িয়ে দ্রুত করোনা টিকা গ্রহণের জন্য রেজিস্ট্রেশন করতে সক্ষম হয়েছেন। এতে সম্ভাব্য কোভিড সংক্রমণ থেকে কেবল প্রবাসীরাই নন, বরং তাঁদের পরিবার ও পাড়া-প্রতিবেশীরাও রক্ষা পেয়েছেন।

স্বায়ত্তশাসন ও চাকরির খোঁজ

বর্তমান ম্যানুয়াল পদ্ধতিকে ডিজিটালাইজ করার মাধ্যমে পুরো অভিবাসন প্রক্রিয়ায় স্বায়ত্তশাসন অর্জিত হচ্ছে, যা দিন শেষে অ্যাপ ব্যবহারকারীদের ব্যাপক আর্থিক সাশ্রয়ে ভূমিকা রাখছে। অভিবাসনপ্রত্যাশীরা আমি প্রবাসীর মাধ্যমে সরকার অনুমোদিত চাকরির সন্ধানের পাশাপাশি দালাল বা মধ্যস্বত্বভোগীদের এড়িয়ে সরাসরি বৈধ অসংখ্য রিক্রুটিং এজেন্সির সঙ্গে যোগাযোগ করে ইন্টারভিউ ও অ্যাপয়েন্টমেন্টের ব্যবস্থা করতে পারেন। বিশেষ দ্রষ্টব্য, আমি প্রবাসী নিজ থেকে কোনো চাকরির বিজ্ঞপ্তি প্রদান করে না।

এমপ্লোয়ার পোর্টালের মাধ্যমে নিয়োগকর্তা ও ব্যবহারকারীর মধ্যে সরাসরি যোগাযোগের ক্ষেত্র তৈরি হয়েছে এবং এখানেও সহজে মধ্যস্বত্বভোগীদের এড়ানো সম্ভব হচ্ছে। একজন ব্যবহারকারী অ্যাপের মধ্যেই দেশভিত্তিক খরচ থেকে শুরু করে কাছের দূতাবাস কিংবা পাসপোর্ট অফিসের নিয়মকানুনসহ বিদেশ যেতে প্রয়োজনীয় সব তথ্য পাচ্ছেন। ফলে তাঁরা ভুল পথে কিংবা কোনো ফাঁদে পা দিচ্ছেন না।

টেকনিক্যাল ট্রেনিং সেন্টার ডিজিটালাইজেশন

আমি প্রবাসী দেশব্যাপী ৬৪টি টেকনিক্যাল ট্রেনিং সেন্টার (টিটিসি) ও ৬টি মেরিন টেকনোলজি ইনস্টিটিউটকে অটোমেটেড ও ডিজিটালাইজ করে ডিজিটাল সার্টিফিকেশনের ব্যবস্থা করেছে। এ জন্য মন্ত্রণালয় বা বিএমইটিকে কোনো অর্থ ব্যয় করতে হয়নি।
মান সংযোজন পরিষেবা (ভিএএস): ব্র্যাক ও প্রবাসীর ট্যাক্সির সঙ্গে অংশীদারত্ব ব্র্যাকের সঙ্গে অংশীদারত্বের কারণে আমি প্রবাসী ব্যবহারকারীরা নিকটবর্তী ব্র্যাক সেন্টার খোঁজ করতে পারবেন, ব্র্যাক রিক্রুটিং এজেন্সির সঙ্গে যোগাযোগ, ব্র্যাক ট্রেনিং সেন্টারে নির্দিষ্ট কোর্সে ভর্তি হওয়ার পাশাপাশি ব্র্যাক রিটার্নি মাইগ্রেশন ফরম পূরণ করতে পারবেন।

প্রবাসীর ট্যাক্সির সঙ্গে স্বাক্ষরিত নতুন সমঝোতা অনুযায়ী বিদেশ যেতে আগ্রহী ও বিদেশফেরত কর্মীদের বিমানবন্দরে গমন এবং বিমানবন্দর থেকে বাড়িতে ফেরার সময়ে নিরাপদ ও নির্ভরযোগ্য পরিবহনের নিশ্চয়তা দেওয়া হয়।

সরকারি পরিষেবা
আমি প্রবাসীর লক্ষ্য কেবল বিদেশে গমন–ইচ্ছুক অভিবাসীদের চাকরি ও প্রশিক্ষণ পেতে সাহায্য করা নয়, বরং বিদেশে যাওয়ার সঙ্গে সম্পর্কিত সব ব্যাপারে তাঁদের যথাযথভাবে অবগত করা। এ অ্যাপে প্রি-ডিপারচার ওরিয়েন্টেশন (পিডিও), ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ তহবিল (ডব্লিউইডব্লিউবি) সদস্য পদ ও বিএমইটি ক্লিয়ারেন্সের মতো পরিষেবা শিগগিরই চালু হবে। তখন চাকরি নিয়ে বিদেশে গমন–ইচ্ছুক ব্যক্তিরা অফিসে গিয়ে সরাসরি যে কাজগুলো করতে হতো, তা ঘরে বসেই করতে পারবেন এবং এতে তাঁদের ব্যয়ের সাশ্রয় নিশ্চিত হবে।

সাপোর্ট সেন্টার
আমি প্রবাসীর ২৪/৭ কল সেন্টার ও লাইভ চ্যাট–সুবিধা বিদেশে যেতে ইচ্ছুক ও বিদেশে অবস্থানকারী কর্মীদের নিয়মিত সহায়তা প্রদান করছে।

তথ্য বিশ্লেষণ

আমি প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারকে নিয়মিত গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন তথ্য, যেমন আবেদনকারীদের দক্ষতা, অবস্থান, পছন্দের চাকরি, দেশ প্রভৃতি প্রদান করছে, যা সরকারকে তথ্য বিশ্লেষণ প্রদান করে কর্মীদের বিদেশে প্রেরণসংক্রান্ত আলোচনা ও জনশক্তি রপ্তানিতে কৌশলগত পন্থা অবলম্বনে সহায়তা করছে। এ ছাড়া এ তথ্য পরিবর্তিত বৈশ্বিক প্রয়োজনীয়তা মোকাবিলায় কর্মীদের জন্য কী ধরনের প্রশিক্ষণের উদ্যোগ নেওয়া উচিত, তা নির্ধারণেও মন্ত্রণালয়কে সাহায্য করে।

আমি প্রবাসী অ্যাপে নিকটস্থ পাসপোর্ট অফিস, মেডিকেল সেন্টার, জেলা জনশক্তি অফিস ও বিদেশের বাংলাদেশ দূতাবাস বা মিশন সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য পাওয়া যাচ্ছে। স্বার্থান্বেষী মহলের ক্রমাগত অপপ্রচার সত্ত্বেও প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় এবং জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) সহায়তায় অভিবাসন প্রক্রিয়ার ডিজিটালাইজেশনে আমি প্রবাসী নিয়মিত কাজ করে যাচ্ছে।