অভিনয় থেকে ভয় ও ভালোবাসা
ছোট সময় টিভিতে যখন খলনায়ক রাজীবকে দেখা হতো ভেতরে ভেতরে একটা আতঙ্ক অনুভূত হতো। হুমায়ূন ফরীদিকে দেখে হাসতাম। আবার ভয়ংকর দৃশ্যে দেখলে ভয়ও পেতাম। বাড়ির পাশে বাজারে দোকানে দেয়ালে অনেক বড় পোস্টারে ইয়া বড় কালো একটা মানুষকে দেখেছিলাম। হাতে লম্বা দা। চোখ দুটো বড়সড়। পোস্টার দেখতে ভয়ংকর লাগত। এত বড় মানুষ হয়! পরে জানতে পারি এই পোস্টারের ভয়ংকর মানুষটার নাম ডিপজল। প্রেক্ষাগৃহে গিয়ে ডিপজলকে কেন্দ্র করে ছবি দেখেছি। সেই সময় ডিপজলের নামে ছবি চলত।
ডিপজলের অভিনয় এতটা ভয়ংকর ছিল যে তার একটা বাস্তব গল্প আছে। আমার বাড়ির পাশের এক ছোট ভাই সিনেমা হলে গেছে ছবি দেখতে। ডিপজলের হাতে রামদা। প্রথমে ক্লোজে দেখানো হয় ডিপজলের পা, তারপর বডি, তারপর যখন ডিপজলের ভয়ংকর দুটি চোখ দেখল, ঠিক তখন সেই ছোট ভাইটি চেয়ারের নিচে মাথা ঢুকিয়ে দেয়। সে আর ছবি দেখবে না। তার খুব ভয় করছে। এ ঘটনা দেখে হলের ভেতরে অনেকে হেসেছিল। সেদিন আমিও খুব হেসেছিলাম।
সময়ের পরিক্রমায় বদল হয় অনেক কিছু। ভয়ংকর ডিপজলও হয়ে যায় পর্দায় নায়ক। ছোট সময় যখন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘ছুটি’ গল্পটি পড়তাম, তখনো মনের মধ্যে একটা কষ্ট অনুভব করতাম। ফটিক নামের ছেলেটি যখন খুব বেশি দুষ্টুমি করত, মা তখন মামার সঙ্গে পাঠিয়ে দিয়েছিল। মামার বাড়িতে ফটিক তার চঞ্চলতা হারিয়ে ফেলে। মামাতো ভাইদের অত্যাচার, ঘৃণা ফটিকের জন্য বেঁচে থাকা দায়। নীরবে আঁধারে ফটিকের চোখের পানি কেউ দেখে না। ফটিকের চোখের পানির সঙ্গে আমারও যে চোখের পানি বেরিয়ে আসত।
টাইটানিক সিনেমায় জ্যাকের দুষ্টুমি ও হাসিমাখা মুখটাকে দেখে রোজের মনে অনুরাগ উঁকি দেয়। ভালোবাসাও হয় তাদের মধ্যে। জাহাজটা যখন ডুবে যাচ্ছিল ঠিক সেই সময় জ্যাককে রোজের বন্ধু শিকল দিয়ে বেঁধে রেখেছিল। রোজ নিজের জীবনের পরোয়া না করে জ্যাককে বাঁচিয়েছিলেন। সেই দৃশ্য দেখে আমি অবাক এবং মুগ্ধও হয়েছিলাম। ভালোবাসা একা বাঁচাতে শেখায় না। ভালোবাসা পরস্পরকে সঙ্গে নিয়ে বাঁচতে শেখায়।
আবার শেষ দৃশ্যে কাঠের পাটাতনে যখন দুজনের জায়গা হয় না, যখন জ্যাক বুঝতে পারে দুজনের ওজনে পাটাতন ডুবে যাবে, ঠিক তখন জ্যাক নিজে থেকে পাটাতন থেকে নেমে যায় বরফঠান্ডা পানিতে।
রোজ না করছিল এবং কান্না করছিল। জ্যাক ভালোবাসার রোজকে বুঝিয়েছিল, ‘তুমি নিজেকে ঠিক রেখো এবং হাসি মুখে বেঁচে থেকো। তোমাকে বাঁচতে হবে। তোমার গর্ভে আমার সন্তান আছে। তাকে তুমি বড় করে আমাদের ভালোবাসার গল্প শোনাবে।’ একটা সময় জ্যাকের মৃত্যু হলো, রোজকে তুলে নেওয়া হলো। অবশ্যই রোজ জ্যাকের কথা রেখেছিল। তার একটা কন্যাসন্তান হয়েছিল। সেই মেয়েকে রোজ ও জ্যাকের ভালোবাসার গল্পও শুনিয়ে ছিল বৃদ্ধকালে। আসলে ভালোবাসা এমনই জীবন দেয়, জীবন নেয়।
কাজী হায়াৎ সাহেবের নির্মিত খোকন সোনা ছবিতে রাজীবের অভিনয় দৃষ্টি কারে। দুধের শিশুকে ঘরে ঘুম পাড়িয়ে, বাইরে থেকে তালাবদ্ধ করে, খোকনের জন্য দুধ আনতে যাওয়া। মাঝরাস্তায় বাবা-মা দুজনে সড়ক দুর্ঘটনা আহত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হওয়া। এদিকে দুধের শিশুর ক্ষুধার যন্ত্রণায় ক্রমাগত কান্না করা। দিনের পর দিন কেটে যাওয়া মেডিকেলে। একটা সময় শিশু না খেতে খেতে মারা যায়। রাজীবের জ্ঞান ফেরে সাত–আট দিন পর। মাথার ব্যান্ডেজ নিয়ে বাড়িতে ছুটে আসা। দরজা লক খুলে ভেতরে প্রবেশ করে মৃত সন্তানকে কোলে নিয়ে কী কান্না, কী আহাজারি। এই অভিনয় জীবনকে অনেক শিক্ষা দেয়।