অবহেলিত জনগোষ্ঠী হিজড়া

হিজড়া
প্রতীকী ছবি

‘তৃতীয় লিঙ্গ’ বা ‘হিজড়া’ শব্দটি শুনলেই সবাই কেমন আঁতকে ওঠে। কিন্তু তাঁরাও রক্ত-মাংসের সাধারণ মানুষ—বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই তা আমরা ভুলে যাই।

স্কুলে পড়ার সময় একবার গ্রামের মেলায় গিয়েছিলাম। এক সময় দেখলাম, লোকজন ছোটাছুটি করছে। তৃতীয় লিঙ্গের একটা দল মেলায় এসেছে, তাঁরা নাচবেন। তাঁদের দেখার জন্য মানুষের ভিড় বেড়ে গেছে। ভিড় ঠেলে সামনের দিকে এগিয়ে দেখলাম, তাঁরা খুব সুন্দর নাচছেন।

মেলাটি ছিল আমার মায়ের মামা বাড়ির এলাকায়। ‘মাদারের মেলা’ নামে জ্যেষ্ঠ মাসে এই মেলাটি এখনো হয়। হঠাৎ খেয়াল করলাম, এক মা তাঁর পাঁচ বছর বয়সী সন্তানকে দেখিয়ে দিচ্ছেন, বাপ দেখ ওগল্ল্যা হিজড়া (বাবা দেখ, ওরা হিজড়া)। তাঁদের সঙ্গে ছোট বাচ্চাদের এভাবে কেন পরিচয় করিয়ে দিতে হবে!

এরপর রাজশাহীর একটি পত্রিকায় প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করার সময় ‘বন্ধু’ নামের একটা সংগঠন তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ ও সাংবাদিকদের নিয়ে মতবিনিময় সভা করেছিল। সেখানে আমিও ছিলাম। উপস্থিত হিজড়াদের অনেকেই আমার পূর্ব পরিচিত। স্বাভাবিকভাবে তাঁদের পাশের একটা চেয়ারে বসলাম। বুঝতে পারছিলাম, অন্যরা এটা স্বাভাবিকভাবে নিচ্ছেন না। এরপর নাশতা দেওয়া হলো। তখনো সবার সামনে খাবার পৌঁছায়নি। এর মধ্যে একজন হিজড়া খাওয়া শুরু করলেন। এবার পূর্ব পরিচিত এক সাংবাদিক হঠাৎ করে বললেন, দেখছেন, এঁরা কোনো দিন সভ্য হবে না। সবার সামনে খাবার আসুক তারপর তো খেতে পারত। আমরা আসলে সবকিছু নিয়ে রিয়্যাক্ট করি বিষয়টি না বুঝে।

সন্তান জন্মানোর আগে বা জন্মানোর সঙ্গে সঙ্গেই আমরা বুঝতে পারি বাচ্চাটা হিজড়া, মেয়ে বা ছেলে হয়েছে। শিশুটির লৈঙ্গিক পরিচয় জানার পর থেকেই আসলে আমাদের অনুভূতিটা অন্যরকম হয়ে যায়। ১০-১২ বছর বয়স হওয়ার পর থেকেই প্রতিবেশীরা বুঝতে পারে, শিশুটি হিজড়া এবং তখন থেকেই তাকে টিজ করা শুরু হয়। একপর্যায়ে তার বাবা-মা, ভাই-বোন, আত্মীয়স্বজনকেও এই টিজের শিকার হতে হয়। ভাইবোন একপর্যায়ে নিতে পারে না, বাড়ি এসে কান্নাকাটি করে, মন খারাপ করে। বাবা-মা না চাইলেও এই ছোট বাচ্চাটি নিজের বাড়ি ত্যাগ করে। সে এটাও জানে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে সে বাড়ির এবং সমাজের বোঝা, তাকে বাবা-মায়ের সম্পদের অংশও দেওয়া হবে না। তাই তার একমাত্র আশ্রয় হয় রাস্তা। এরপর কোনো হিজড়া গুরু তাঁর আখড়ায় বাচ্চাটিকে আশ্রয় দেয়। সে প্রাপ্ত বয়স্ক হওয়া পর্যন্ত হিজড়া গুরু তার দেখাশোনা করে। ভরণপোষণ, অসুখ, ভালোমন্দ, বাবা-মা সবই হিজড়া গুরু ও তার আখড়ার সঙ্গীরা।

প্রাপ্ত বয়স্ক হওয়ার পর এই হিজড়া বাড়িতে গিয়ে চাঁদা দাবি করে বা চাঁদা তোলে। এটাই তখন তাঁদের স্বাভাবিক জীবন। অনেকের প্রশ্ন, হিজড়া কিছু করে না কেন? উত্তর, হিজড়াদের এখনো আমরা ভিনগ্রহের প্রাণী মনে করি। আমরা তাঁদের বাসা বাড়িতেও কাজ দিতে চাই না।

একবার একটা কাজে হিজড়া আখড়ায় আমরা ছয়জন গিয়েছিলাম। তাঁরা খুব যত্ন সহকারে বসতে দিলেন। আমাদের টিম লিডার কিছু বিস্কুট নিয়ে গিয়েছিলেন। এবার আমাদের নাশতা দেওয়া হলো সঙ্গে তাঁদের কাপে চা। আমরা এবার সবাই সবার দিকে মুখ চেয়ে তাকিয়ে আছি। কেউ চায়ে চুমুক দিচ্ছি না। এদিকে হিজড়া সদস্যরা চা খাওয়ার জন্য তাগিদ দিচ্ছেন। শেষমেশ আমরা পাঁচজন চা শেষ করলাম। একজন খেলেন না। যদিও এখন এ রকম মনে হয় না।

এই ঘটনার কয়েক মাস পর সাগরিকা নামের একজন এক সভায় সবার সামনে আমাকে বলেই ফেললেন, আমাদের কেউ মানুষ ভাবে না আপা। আপনারাও আমাদের বাসায় গিয়ে একজন চা খাননি। যতই বলেন পাশে আছেন, আপনার বোন বা ভাই মনে করেন কিন্তু আসলে বাস্তবতা হলো, আমরা হিজড়া...।