অবরুদ্ধ সময়কে লাগাতে হবে ভবিষ্যতের পরিকল্পনার কাজে

নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ অভিজিৎ বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায়
নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ অভিজিৎ বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায়

নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ অভিজিৎ বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছেন, করোনাভাইরাস পরিস্থিতিতে এখন অর্থনীতি স্তব্ধ হলেও এটা নিয়ে চরম ভীত হওয়ার কিছু নেই। কর্মকাণ্ড শুরু হলে আগের চেয়ে অর্থনীতি জোরদার গতি পেতে পারে। এর নজির আছে। এখন এ অবরুদ্ধ অবস্থায় ভবিষ্যতের জন্য সঠিক রিকল্পনা করতে হবে। ম্যাজিকে কিছু হবে না।

বেসরকারি সংগঠন ব্র্যাক ও একাত্তর টেলিভিশনের অনুষ্ঠান ‘বাসায় থাকি’–তে যুক্ত হয়ে এ কথা বলেন ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজির অর্থনীতির এই বাঙালি অধ্যাপক। গতকাল বৃহস্পতিবার দুপুরে এ অনুষ্ঠান হয়। অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন ব্র্যাকের পরিচালক (প্রিভেন্টিং ভায়োলেন্স এগেইনস্ট উইমেন ইনিশিয়েটিভ) নবনীতা চৌধুরী। ব্র্যাকের নির্বাহী পরিচালক আসিফ সালেহ এবং অর্থনীতিবিদ আহমেদ মুরশিদ মোবারকও অনুষ্ঠানে কথা বলেন।

উন্নত দেশগুলোর মতো বাংলাদেশসহ অনেক উন্নয়নশীল দেশ সবকিছু অবরুদ্ধ করে ফেলেছে। বাংলাদেশ ও ভারতের মতো দেশগুলোতে যে কড়াকড়িগুলো আরোপ করা হয়েছে, তার উপযোগিতা নিয়ে অধ্যাপক অভিজিতের কথা, ‘যদি এমন হয় যে ৬০ থেকে ৭০ শতাংশ লাভ হয়, তবে এ ধরনের কড়াকড়ির হয়তো দরকার আছে।’

করোনার সংক্রমণ নিয়ে আরোপিত কড়াকড়ির প্রভাব অর্থনীতিতে কতটুকু—এ প্রশ্নের জবাবে অভিজিৎ বলেন, ‘এর প্রভাব নিয়ে খুব বেশি কাজ হয়নি। কিন্তু যদি কোনো সামাজিক সংকট না হয়, তাহলে আমরা যত দূর জানি, একবার অর্থনীতিকে ছেড়ে দেওয়া হলে তাড়াতাড়িই তা উঠে যায়। জার্মানি ও জাপানে যুদ্ধের (দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ) পর, ভিয়েতনামে যুদ্ধের পর খুব তাড়াতাড়ি অর্থনীতি সচল হয়ে গিয়েছিল। খুব বেশি দিন লাগেনি। বাংলাদেশের জন্য এ তত্ত্ব কতটুকু কার্যকর তা জানি না। কিন্তু বিষয়টি এমন নয় যে আজ যদি অর্থনীতি বন্ধ করে দিই, তবে কালও বন্ধ থাকবে।’

বাংলাদেশ, ভারতসহ বিভিন্ন দেশ পরিস্থিতি সামলাতে প্রণোদনা ঘোষণা করেছে। এসব প্রণোদনায় অর্থনীতি সচলে থাকবে কি? এর জবাবে নোবেল বিজয়ী অভিজিৎ বললেন, ‘বিষয়টি যদি এমন হয় যে এটা ছয় মাসের ব্যাপার, তবে বিদেশি সংস্থার কাছে থেকে ধার করতে হবে। আর যুক্তরাষ্ট্র যেটা করছে, সেটা হলো তারা টাকা ছাপছে। কারণ, এখন যে অর্থনীতির অবস্থা, তাতে লোকেদের হাতে পয়সা নেই। আর এ অবস্থা থাকলে তারা কিছু কিনবে না। না কিনলে যাদের কাছে থেকে কিনবে, তাদের কাছেও পয়সা থাকবে না। এসব ভাবনা থেকে তারা টাকা ছাপাচ্ছে। কিন্তু এ বিষয়ে ভারত বা বাংলাদেশ দ্বিধায় আছে। এখনো তারা স্থির করতে পারেনি, কতটা টাকা ছাপানো উচিত হবে।’

অভিজিৎ বিনায়কের মতে, ‘টাকা ছাপিয়ে ফেলা যেত এবং এর মাধ্যমে জীবিকা ও জীবন—দুটোতেই সাহায্য করা যেত। এটা এখনো আমরা করছি না। আমরা হয়তো ভয়ে আছি যে এটা করলে মুদ্রাস্ফীতি হবে। আমাদের আরও দৃঢ় পদক্ষেপে এগিয়ে যাওয়া উচিত। টাকা ছাপিয়ে মানুষের হাতে দিই। টাকাটা ব্যয় করার সুযোগ থাকলে অর্থনীতিও সচল হবে।’

প্রশ্ন ছিল টাকা দেওয়া হবে, কিন্তু এই টাকা মানুষের হাতে পৌঁছানোর মতো উন্নত ব্যবস্থা কি আমাদের আছে? নিজ দেশ ভারতের উদাহরণ টেনে অভিজিৎ বলেন, ‘নিশ্চয় অনেক লোকই, যাদের পাওয়া উচিত তারা বাদ যাবে। কিন্তু তারপরও ৬০ থেকে ৭০ শতাংশ দরিদ্র ও হতদরিদ্র মানুষের কাছে পৌঁছানো সম্ভব। সেটা হলেও তারা খরচ করবে।’

করোনা–পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ ও ভারতের মতো উন্নয়নশীল অর্থনীতির দেশগুলো একেবারে শুরুতেই অবরুদ্ধ নীতিতে গেছে। এ নিয়ে সমালোচনাও আছে। যা উন্নত দেশ করেছে, তা আমাদের জন্য কতটুকু যুক্তিযুক্ত? অভিজিতের মতে, ‘যদি ধরে নেওয়া যায় যে এটা বেশ কিছুদিন চলবে, প্রথমে থামিয়ে দেওয়া যুক্তিযুক্ত ছিল। এখন চিন্তা করার আরেকটু সময় পাওয়া যাবে। আর থামিয়ে দিয়ে যে ভীষণ অর্থনৈতিক ক্ষতি হয়, আমি এমন কোনো তথ্য দেখিনি।’

অভিজিৎ বলেন, ‘এই অসুখ যেহেতু বাংলাদেশে এখনো আস্তে আস্তে ছড়াচ্ছে, এতে বেশ কিছুদিন ছড়াবে। এটা নিঃসন্দেহে। একসময় আমাদের ভাবতে হবে যে এর পরে কী, এর শেষ কোথায়। এটা করতে গেলে কোন কোন জায়গায় প্রথমে আমরা যাব, এসব ঠিক করতে হবে।’

বাংলাদেশ প্রসঙ্গে অভিজিৎ বিনায়কের পরামর্শ ছিল, ‘৫ মে পর্যন্ত বাংলাদেশের সবকিছু বন্ধ আছে। অর্থাৎ এখনো ১০ থেকে ১২ দিন সময় আছে। কীভাবে পরবর্তী কাজ সুষ্ঠুভাবে করা যাবে, সেটা এখন ভাবা যায়। কোন প্রযুক্তি ব্যবহার করা যায়, যাঁরা সাপ্লাই চেইন নিয়ে চিন্তা করেন, তাঁদের ভাবনা নিয়ে কাজ করতে হবে।’