অপরাজিতা

অলংকরণ: মাসুক হেলাল
অলংকরণ: মাসুক হেলাল

স্বার্থপর মানুষের কাছে ভালোবাসার কোনো মূল্য আছে কী? হোক সে প্রেমিক-প্রেমিকা, স্বামী কিংবা স্ত্রী। এদের স্বার্থ ফুরিয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ভালোবাসাও ফুরিয়ে যায়। প্রয়োজনে তারা ভালোবাসার মানুষকে লাথি মেরে ঘর থেকে বের করে দিতেও দ্বিধাবোধ করে না।

কল্লোল ভালোবেসেই বিয়ে করেছিল সালমাকে। এক দু-দিন নয়, প্রায় পাঁচ বছর দুজন দুজনকে ভালোবেসে তারা বিয়ের সিদ্ধান্ত নেয়। বিয়ে হয়। সংসার হয়। ভালোবাসার কোনো কমতি ছিল না ওদের সংসারে। কিন্তু সব ভালোবাসা ফিকে হয়ে যায় একটি সন্তানের প্রত্যাশায়! বিয়ের পাঁচ বছর পার হয়ে গেলেও কোনো সন্তান আসেনি ওদের সংসারে। ডাক্তারি সব চেষ্টা করেও কোনো লাভ হয়নি। এখন একমাত্র উপায় টেস্টটিউব। অস্ট্রেলিয়ায় টেস্টটিউবে বাচ্চা নেওয়া অনেক ব্যয়বহুল। শুধু অর্থই নয়, টেস্টটিউবের ব্যাপারে খুবই অনীহা কল্লোলের। তাই সব আশা ছেড়ে দিয়ে সন্তানের জন্য কল্লোল এখন বিকল্প চিন্তা করছে।

সালমা কল্লোলের কষ্টটা বুঝতে পারে। তাই তার সবটুকু ভালোবাসা দিয়ে কল্লোলকে সুখী করতে চায় সালমা। কিন্তু বিধিবাম। কল্লোল আর আগের সেই কল্লোল নেই। প্রায়ই মদ খেয়ে মাতাল হয়ে বাসায় ফেরে। খুব প্রয়োজন ছাড়া সালমার সঙ্গে কথা বলে না। সালমা সব বোঝে, বিভিন্নভাবে কল্লোলকে বোঝাতে চেষ্টা করে, কিন্তু তাতে হিতে বিপরীত হয়ে যায়। কল্লোল যখন-তখন চিৎকার-চেঁচামেচি শুরু করে দেয়।

সালমা বুঝতে পারে তার প্রতি কল্লোলের এ ধরনের আচরণের কারণ।

সন্তানের জন্য কল্লোলের হৃদয়ে ভালোবাসার স্থানে অবজ্ঞা আর অবহেলা বাসা বেঁধেছে। সালমা মনে মনে ভাবে, এত দিনের ভালোবাসা, এত দিনের সংসার সন্তান জন্ম দেওয়ার অপারগতায় সব শেষ হয়ে যাবে!

কল্লোল যদি সালমাকে সত্যিকারে ভালোবাসত, তাহলে কী সন্তানের জন্য বা সন্তান জন্ম দেওয়ার অপারগতায় সেই ভালোবাসা এত সহজেই মন থেকে নিঃশেষ হয়ে যেত!

দাম্পত্য জীবনে অশান্তি দেখা দিলে সংসার যতই গভীর বা দীর্ঘদিনের হোক, সেখানে বিচ্ছেদ হতেই পারে। কিন্তু একজন ভালোবাসার প্রিয় মানুষ যখন একটি সন্তান জন্ম দিতে অপারগ হয়, তখন সেই প্রিয় মানুষটিকে তালাক দিয়ে ঘর থেকে বের করে দেওয়া কী সম্ভব!

বিবাহিত জীবনে সন্তান কে না চায়। প্রত্যেক নারী-পুরুষই চায় সন্তানের মা কিংবা বাবা হতে। ক্ষেত্রবিশেষে কোনো নারী মা হতে পারে না, আবার একইভাবে কোনো পুরুষ সন্তান জন্ম দিতে অপারগ। যদিও বিষয়টি পুরুষ ও নারী উভয়ের জন্যই দুঃখজনক। তারপরও সৃষ্টিকর্তার ওপর কারও হাত নেই।

চিকিৎসা বিজ্ঞানীরা বলেন, মেয়েদের জন্য ইনফার্টিলিটি বা বন্ধ্যত্ব একটি গুরুতর সমস্যা। সারা বিশ্বে খুঁজলে এমন অনেক দম্পতি পাওয়া যাবে, যাদের সন্তান হয় না। নারী-পুরুষ সমানভাবেই এ সমস্যার জন্য দায়ী বা ভুক্তভোগী হতে পারে। বর্তমানে মানুষের এ ব্যাপারে সচেতনতা বেড়েছে, চিকিৎসা বিজ্ঞানে প্রযুক্তির উন্নয়নে এ সমস্যা সমাধানে অনেক বিকল্প ব্যবস্থা এসেছে। কোনো বিকল্প ব্যবস্থা গ্রহণ না করেই সব দোষ স্ত্রীর ওপর চাপিয়ে দিয়ে একটি মেয়েকে ঘর থেকে বের করে দেওয়া কোনো শিক্ষিত সভ্য মানুষের কাজ নয়!

কথায় আছে, নারীই নারীর বড় শত্রু। কল্লোল না যতটা, তার চেয়ে এক ধাপ এগিয়ে তার মা অর্থাৎ সালমার শাশুড়ি। এই শাশুড়িই একদিন একজনের বউ হয়ে সংসারে এসেছিলেন। একবার কী তিনি ভেবে দেখেছেন, তিনি যদি জীবনে মা না হতে পারতেন আর তার প্রতি যদি তার স্বামী বা শাশুড়ি এ ধরনের আচরণ করতেন, তাহলে তার জীবনটা এখন কোথায় থাকত, কেমন হতো? না, কিছু মানুষ খুবই স্বার্থপর। মানুষের সমস্যা, অপারগতা এসব নিয়ে তাদের মাথাব্যথা নেই। ভাবার সময় নেই। তাদের নিজের চাওয়া-পাওয়াটাই জীবনে মুখ্য।

কল্লোলের মায়ের কথা, ‘যে মেয়ে সন্তান জন্ম দিতে পারবে না, সে মেয়ে অপয়া। তাকে সংসারে রাখা অমঙ্গল। একটি মেয়ের জন্য ছেলের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম থাকবে না, বংশধর থাকবে না, সেই মেয়েকে দিয়ে তুমি কী করবে? এ ধরনের একটা মেয়ে পোষার চেয়ে একটা গরু পোষা অনেক লাভজনক।’

মায়ের কথায় যুক্তি আছে ভেবে কল্লোল সালমাকে ডিভোর্স দেওয়ার কথা বলে বাংলাদেশে গিয়ে বিয়ে করে আসে।

গত এক বছর সালমা ও কল্লোল একই বাসায় থাকলেও দুজন দুরুমে থাকে। কারও সঙ্গে কারও দেখা হয় না বললেই চলে। কল্লোল অনেক রাত করে বাসায় ফেরে। প্রথম প্রথম সালমা কল্লোলের জন্য খাবার নিয়ে অপেক্ষা করত কিন্তু কল্লোল রাতে বাইরে থেকে খেয়ে আসত। নিজের রুমে ঢুকে দরজা বন্ধ করে ঘুমিয়ে পড়ত। একদিন কল্লোল সালমাকে ওয়ার্নিং দেয়, সে যেন যত তাড়াতাড়ি সম্ভব একটা বাসা দেখে। কারণ, তাদের সেপারেশনের এক বছর পূর্ণ হলেই তাদের ডিভোর্স হবে এবং কল্লোলের নতুন বউ আসবে। কল্লোল চায় না তার নতুন বউ এসে সালমাকে এই বাসায় দেখুক।

কথাগুলো শুনে সালমার মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়ে। অকস্মাৎ যেন সবকিছু এলোমেলো হয়ে যায়।

এই প্রবাসে একমাত্র স্বামী ছাড়া কেউ নেই সালমার। নিয়তির কী পরিহাস! সেই স্বামীও এখন আর তার নয়। কোথায় যাবে সে? কার কাছে থাকবে? হোক না বিদেশ। হাজার হলেও বাঙালি তো। একটি মেয়ে ইচ্ছে হলেই হুট করে কারও বাসায় গিয়ে উঠতে পারে না।

এসব চিন্তা করতে করতে সালমা অসুস্থ হয়ে পড়ে। রাতের পর রাত নির্ঘুম কেটে চোখের নিচে কালি জমে গেছে। মনটা এখন বেদনার সাগর। মনের অজান্তেই যখন-তখন দুচোখ বেয়ে পানির ঝরনা বয়ে যায়।

সালমার খুব রাগ হয় সৃষ্টিকর্তার ওপর। মেয়ে হয়ে জন্মানোটাই একটা অভিশাপ। জন্ম যখন হয়েছেই, তখন আবার সন্তান জন্ম দিতে না পারা যে কত বড় অভিশাপের, সেটা সালমা হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে। জীবনের প্রতি সালমার ঘৃণা জন্মে গেছে। মাঝে মাঝে মন চায় আত্মহত্যা করতে, কিন্তু পারে না। এত সাহস নেই সালমার। আবারও বাঁচার স্বপ্ন দেখে। স্বপ্ন দেখে একটি সন্তানের মা হওয়ার।

একদিন বিছানা থেকে নামতে গিয়ে সালমা ফ্লোরে পড়ে যায়। শ্বাসকষ্ট শুরু হয়। কষ্ট করে মোবাইল ফোনে অ্যাম্বুলেন্স ডাকতে গিয়ে হাতটা থেমে যায়। ভাবে, কী হবে হসপিটালে গিয়ে। কী হবে বেঁচে থেকে। তার চেয়ে এখানে এভাবে মরে পড়ে থাকলে মন্দ কী। জীবনের সব কষ্ট দূর হয়ে যাবে। যে কখনো একটি সন্তান জন্ম দিতে পারবে না, তার বেঁচে থেকে কী লাভ।

সালমার জ্ঞান ফিরলে দেখে, সে হসপিটালের বেডে। চারদিকে তাকিয়ে খোঁজে তার পাশে কেউ আছে কিনা। আসলে কেউ নয়, খোঁজে তার স্বামী কল্লোলকে। কিন্তু না, নেই। তাহলে তাকে হসপিটালে আনল কে? ডাক্তারের কাছে সালমা জানতে পারে, তার এক প্রতিবেশী অ্যাম্বুলেন্সে ফোন করে তাকে হসপিটালে পাঠিয়েছে। মনটা তার খারাপ হয়ে যায়। প্রতিবেশীর ওপর তার অনেক রাগ হয়। কেন সে অ্যাম্বুলেন্সে ফোন করে তাকে হসপিটালে পাঠাল। সে তো বাঁচতে চায় না, তাহলে সৃষ্টিকর্তা তাকে কেন বাঁচিয়ে রেখেছে? শুধু কষ্ট পাওয়ার জন্য বেঁচে থাকার কোনো মানে হয় না। সালমা যখন এসব ভাবছে, ঠিক তখনই রিপোর্ট নিয়ে একটা মিষ্টি হাসি দিয়ে ডাক্তার এসে দাঁড়ায় সালমার পাশে। এসব এখন সালমার কাছে বিষের মতো লাগছে। সবকিছু মেকি, অভিনয় মনে হয়।

: ডু ইউ নো, ইউ আর প্রেগনেন্ট? কনগ্র্যাচুলেশন।

সালমার কোনো অনুভূতি নেই। শুধু ফ্যালফেলিয়ে তাকিয়ে আছে।

: সালমা, ইউ আর প্রেগনেন্ট। কনগ্র্যাচুলেশন।

: আই থিংক, ইউ গট আ রং রিপোর্ট।

: রং! হোয়াই ডু ইউ থিংকস দ্যাটস? আর ইউ সালমা কল্লোল?

: আই ওয়াজ। বাট নাউ আই অ্যাম অনলি সালমা।

: হোয়াট এভার, ইউ আর প্রেগনেন্ট।

সালমা যেন আকাশ থেকে পড়ে! কিছুতেই ডাক্তারের কথা বিশ্বাস করতে পারছে না।

: আর ইউ কিডিং উইথ মি?

: হোয়াই আই শুড? হেয়ার ইজ ইউর পজিটিজ রিপোর্ট।

সালমা ভাবে, এটা কী করে সম্ভব! রিপোর্টে কোথাও কোনো ভুল হচ্ছে। গত এক বছর সালমা কল্লোলের সাথে সেপারেশনে আছে। যদিও একই বাসায় থাকে কিন্তু একবারের জন্যও সে কল্লোলের সাথে মেলামেশা করেনি।

শুধু একদিন সালমা কাজ থেকে এসে শরীরের ক্লান্তি দূর করার জন্য বাথরুমে ঢুকে ঝরনার পানিতে অঝোরে ভিজতে থাকে। ঝরনার পানির সঙ্গে সঙ্গে সালমার দুচোখ বেয়েও অঝোরে পানি ঝরছিল সেদিন।

বাথরুম থেকে বের হয়ে সালমা একটা সাদা তাওয়াল বুকে পেঁচিয়ে বিছানায় বসে ভয়ে আঁতকে ওঠে। তার বিছানায় এক পা নিচে আর এক পা খাটে দিয়ে চিত হয়ে মাতাল অবস্থায় পড়ে আছে কল্লোল। সে ইদানীং প্রায়ই ড্রিংকস করে বাসায় ফেরে, কিন্তু কখনো সালমার রুমে আসে না। হয়তো মাতাল হয়ে ভুলে নিজ রুম ভেবে সালমার রুমে ঢুকে পড়েছে। সালমা কী করবে বুঝে উঠতে পারছিল না। মনে মনে ভাবে, এখনো তো তাদের ডিভোর্স হয়নি। সেপারেশনে থেকে অনেকেই আবার সংসারে ফিরে আসে।

সালমা কল্লোলের পা থেকে জুতো খুলে পা-টা খাটে উঠিয়ে কল্লোলের গায়ে ব্লাংকেট দিতে গেলে সালমার বুকের তাওয়ালের গিট খুলে যায়। ঠিক তখনই মাতাল কল্লোল চোখ খুলে সালমাকে দেখে নিজেকে আর ঠিক রাখতে পারেনি। সে ভুলে যায় যে তারা এখন সেপারেশনে আছে। কল্লোল সালমাকে জড়িয়ে ধরে পাগলের মতো আদর করতে থাকে। সালমার একবার ইচ্ছে হচ্ছিল ধাক্কা মেরে কল্লোলকে ফেলে দিতে। কিন্তু না, সে কল্ললকে বুকে জড়িয়ে নেয়। কারণ সালমা ভাবে, এই উছিলায় যদি কল্লোলের সঙ্গে আবার সংসারটা কনটিনিউ করা যায় তাতে মন্দ কী। তাদের তো এখনো ডিভোর্স হয়নি। এরপর ওরা দুজনই ভালোবাসার আদিম খেলায় মেতে ওঠে।

সকাল হলে কল্লোল নিজেকে সালমার বিছানায় বিবস্ত্র অবস্থায় দেখে আঁতকে ওঠে। লাফ দিয়ে বিছানা থেকে নেমে তার প্যান্টের পকেট থেকে এক শ ডলারের একটা নোট বের করে সালমার সামনে ছুড়ে মেরে বলে—‘আজকের এই অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার জন্য আমি দুঃখিত।’ এ কথা বলেই কল্লোল তার রুমে চলে যায়।

ডাক্তারের কথায় সংবিৎ ফিরে আসে সালমার। সে খুশিতে ডাক্তারকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেলে।

দিনটি ছিল শনিবার। সময় বেলা এগারোটা। হসপিটাল থেকে এক সাগর বুকভরা আশা আর ভালোবাসা নিয়ে একটা ট্যাক্সিতে করে বাসায় ফেরে সালমা। রাস্তায় ট্যাক্সি থামিয়ে একগুচ্ছ গোলাপ কিনে নেয় কল্লোলের জন্য।

পৃথিবীর সবচেয়ে দামি একটি উপহার আজ সে কল্লোলকে দেবে। যার জন্য আর মাত্র কয়েক দিন পার হলেই সালমাকে ডিভোর্স দিত কল্লোল। বিধাতার খেলা বোঝা বড় কঠিন। ভাবতেই খুশিতে সালমার দুচোখের কোণে পানি চলে আসে।

সালমা খুব সাবধানে বাসায় ঢোকে। কল্লোলের দরজায় নক করতে গিয়ে দেখে, দরজা খোলাই আছে। সালমা আস্তে করে দরজাটা ঠেলে ভেতরে ঢুকে স্তব্ধ হয়ে যায়। নিজের চোখকে যেন আর বিশ্বাস করতে পারছে না।

কল্লোল সম্পূর্ণ বিবস্ত্র অবস্থায় বিবস্ত্র একটা সাদা অস্ট্রেলিয়ান মেয়েকে জড়িয়ে ধরে ঘুমিয়ে আছে। মনের অজান্তেই সালমার হাত থেকে ফুলের গুচ্ছটা মাটিতে পড়ে যায়।
...

বেলাল হোসেন ঢালী: সিডনি, অস্ট্রেলিয়া। ইমেইল: <[email protected]>