অন্যরকম বাড়িফেরা

সরকারি স্কলারশিপ পাওয়ার মধ্য দিয়ে চার বছর আগে চীনে পাড়ি দিয়েছিলাম উচ্চশিক্ষা অর্জনের উদ্দেশে। চোখের নিমেষেই চার বছরের এ দীর্ঘ জার্নি প্রায় শেষের পথে। মাঝে অল্প কদিনের জন্য দেশে গিয়েছিলাম। সেটাও তিন বছর আগে। তখন দেখে এসেছিলাম বাড়ির সামনের ছোট্ট বাগানটিতে বাবার হাতে লাগানো আম, জাম, সফেদা, জামরুল, কাগজি লেবু, করমজা, তাল, নারকেলসহ নানা প্রজাতির পেয়ারাগাছ।

বাড়ির বারান্দার একেবারে ধার ঘেঁষে বেড়ে উঠেছিল শিউলি ও গন্ধরাজ ফুলের গাছগুলো। সন্ধ্যায় গাছগুলোতে ফোটা ফুলের সৌরভে সমস্ত বাড়ি ম-ম করত। সারা রাত সুভাস ছড়িয়ে গাছের নিচে শরতের ভোরে ঝরে পড়া ফুলগুলো দেখে মনটা ভরে যেত। চীনে আসার আগের কয়েক দিন গ্রামে কাটিয়ে এসব স্মৃতি মনটা বেশ আবেগাপ্লুত করে তুলেছিল। এরপর পাড়ি দিয়েছিলাম ভিনদেশে। অনেকটা অজানার উদ্দেশে।

এক বছর পর স্ত্রী ও কন্যাকে (অন্তু) নিয়ে আসার মধ্য দিয়ে চীনে ছোট্ট সংসার শুরু হয়। দেশ থেকে নিয়ে আসা তিনটি লাগেজের জিনিসপত্রের ওপর ভর করেই এখানকার সংসার শুরু। আবার ঠিকই তিনটি লাগেজ নিয়েই দেশে ফিরব। কিন্তু মাঝ দিয়ে চলে গেছে অনেক স্মৃতিবিজড়িত চারটি বছর। যার অধিকাংশ সময় কেটেছে অজানা আতঙ্ক, বেঁচে দেশে ফেরার শঙ্কা এবং সর্বোপরি প্রিয়জন হারানোর দুশ্চিন্তায়। চাওয়া-পাওয়ার অনেক অপূর্ণতা থাকলেও এখানকার জীবনযাত্রায় আমরা বেশ অভ্যস্ত হয়ে উঠেছি।

বিশেষ করে এখানকার আবহাওয়া, প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, খাদ্যাভ্যাস, সার্বিক নিরাপত্তা ও নিরাপদ জীবনযাত্রা আমাদের অনেক বেশি আকর্ষণ করেছে। তারপরও আমাদের ভাবনায় সর্বদা স্থান পেত নিয়মের পরিক্রমায় একদিন দেশে ফিরতে হবে এবং ধীরে ধীরে সেই দিনের সন্নিকটে আমরা এগিয়ে যাচ্ছি।

করোনা মহামারির প্রাদুর্ভাব চীনে প্রথম শুরু হলেও নিজেরা কখনো এ আতঙ্কে থাকিনি, যতটা না থেকেছি দেশের প্রিয়জনদের নিয়ে। প্রতিটি ক্ষণ, প্রতিটি দিন যেন এক একটা নিদারুণ কষ্টের মধ্যে দিয়ে পার করেছি বা বর্তমানে এখনো করছি। বরাবরই বাড়ির ফোন রিসিভ করি মনের ভেতর আতঙ্ক নিয়ে। কথা বলার আগে ভাবি, না জানি কোন দুঃসংবাদ অপেক্ষা করছে। কাপা স্বরে শুনি সবাই ভালো আছে কি না।

মা প্রতিদিন আঙুল টিপে টিপে হিসাব করতে থাকে আমাদের বাড়ি ফিরতে এখনো কত দিন বাকি। মায়ের এই হিসাবের ক্ষণ শুরু হয়েছে সেই চার বছর আগে থেকে। বর্তমানে প্রতিদিন কথা শুরু হওয়ার একপর্যায়ে মাকে বলি এইতো আর মাত্র দুই-তিন মাস পরেই বাড়ি ফিরব।

এক বছরেরও আগে থেকে এই ডাহা মিথ্যা কথাটা নিয়ম করে বলে আসছি শুধু মাকে সান্ত্বনা দেওয়ার জন্য। তারপরও আমাদের নিয়ে মায়ের দুশ্চিন্তার শেষ নেই। দীর্ঘদিনের কথা শুনলে মন খারাপ করবে—এ ভয়ে বারবার মিথ্যার আশ্রয় নিই। আমি যে মিথ্যা বলছি, সেটা মা বুঝতে পারে। কিন্তু শত চেষ্টা করেও মা-বাবাকে বোঝাতে পারি না আমরা এখানে ভালো আছি।

ভিডিও কলে ফ্যালফ্যাল দৃষ্টিতে মোবাইলের স্ক্রিনে চেয়ে থাকে মা। আমরা সবাই স্পষ্ট মাকে দেখলেও মা চোখে দেখে না। আমাদের সব কথা মা অন্তর দিয়ে বুঝে একটা প্রতিচ্ছবি কল্পনা করে। সব কথা শুনতে পায়। চোখ দিয়ে দেখতে চেষ্টা করে। কিন্তু পারে না। মায়ের দুটো চোখই এখন নষ্টপ্রায়। দেশে যখন করোনার ভয়াবহতা চলছিল তখন মায়ের চোখে রক্তক্ষরণ হয়। মহামারির মধ্যেও দ্রুত চিকিৎসা নিয়ে একটি মোটামুটি ভালো হলেও অপরটি পুরোপুরি নষ্ট হয়ে যায়।

এরপর থেকে নিয়মিতভাবে খুব ভালো মানের চিকিৎসা নেওয়ায় একটি চোখ ভালো ছিল। কিন্তু পুনরায় রক্তক্ষরণ হয়ে সেটিও এখন নষ্ট। তিন মাস পরপর ডাক্তার চোখের রক্ত পরিষ্কার করিয়ে দিলে সামান্য কিছুদিন ঝাপসা দেখার পরে আবার খারাপ হয়। ডাক্তার বলে দিয়েছেন এর থেকে ভালো হবে না। মায়ের লাগামহীন ডায়াবেটিস ও উচ্চ রক্তচাপ কিছুতেই নিয়ন্ত্রণে আসে না। যার ফলে চোখ নষ্ট।

অন্তু ভিডিও কলে ছাড়া কথা বলতে চায় না। মা চোখে না দেখলেও অন্তু ভাবে ঠাম্মি ঠিকই চোখে দেখছে। শুদ্ধ বাংলা বলাতে অন্তুর সামান্য সমস্যা হয়। তাই হঠাৎ করে নতুন কারও তার ভাষা বুঝে ওঠা একটু দুষ্কর। আধো আধো কথা বলতে শেখার পরেই অন্তু চীনে চলে আসে। তাই বাংলা ভাষার প্রতি ওর একটু দুর্বলতা আছে। কিন্তু অন্য সবাই না বুঝলেও ঠাম্মি ঠিকই অন্তুর কথা বুঝতে পারে। অন্তু প্রতিদিন দীর্ঘক্ষণ ঠাম্মির সঙ্গে ভিডিও কলে কথা বলে। ডাক্তারি নানা ধরনের খেলনা সরঞ্জাম দিয়ে ঠাম্মির চোখের ট্রিটমেন্ট দেয়।

আবার প্রতিদিন ঠাম্মি-দাদুর জন্য মিছিমিছি রান্না করে বিভিন্ন বাটিতে জমিয়ে রাখে। সারা দিন অধীর আগ্রহে থাকে ঠাম্মি-দাদুর কলের অপেক্ষায়। ঠাম্মি কল দিলে ওর মিছি মিছি করা রান্না খেতে দেয়। ঠাম্মি-দাদুর নানা ধরনের চিকিৎসা দেয়। টকজাতীয় ফল অন্তুর খুব বেশি পছন্দ। তাই অন্তু ঠাম্মি-দাদুকে বেশি করে টক ফলের গাছ লাগাতে বলেছে। সে বাড়ি ফিরে খাবে। দাদু তাই শুনে অনেক আমড়াগাছ লাগিয়েছে। সব গাছে এখন ফল আসা শুরু করেছে।

ভিডিও কলে অন্তুকে গাছে ঝুলন্ত ফল দেখায়। অন্তু দেখে মজা পায়। কিন্তু ঠাম্মি অন্তুকে দেখে না। বাবার ২০১৪ সালে হার্ট অ্যাটাক হলে রিং পরানো হয়। এরপর ভালো থাকলেও বর্তমানে আবার নানান জটিলতা দেখা দিতে শুরু করেছে। চিকিৎসা নিচ্ছে কিন্তু সুস্থ হচ্ছে না। আমরা ফেরার আগপর্যন্ত তিনিও তাঁর শারীরিক সুস্থতা নিয়ে বারবার সংশয় প্রকাশ করেন। দাদু-ঠাম্মির এসব কথা শুনে অন্তুর মনটা মুহূর্তের মধ্যে খারাপ হয়ে যায়। আমরাও মাঝেমধ্যে তাকে বোঝানো বা সান্ত্বনা দেওয়ার ভাষা হারিয়ে ফেলি।

এখানে আসার কিছুদিনের মধ্যেই শ্বশুর মহাশয় পরলোকগত হন। অ্যাজমার সমস্যা ছিল তাঁর। কিছুদিন পরপর ডাক্তারি চেকআপে যাওয়া লাগত। কিন্তু দেশে তখন করোনা মহামারির তাণ্ডবের মধ্যে চলা লকডাউনে আর সেটা সম্ভব হয়ে ওঠেনি। তাই একরকম বিনা চিকিৎসায় তিনি মারা যান। অন্তু চীনে আসার ছয় মাসের মধ্যে তার দাদাকে হারানোর বিষয়টি এখনো মেনে নিতে পারে না। মেনে নিতে পারি না আমরাও। অন্তুর মা যখন তাঁর বাবার স্মৃতি মনে করে ডুকরে কেঁদে ওঠে তখন নিজেও পারি না সামাল দিতে। এত কঠিন বাস্তবতার মধ্য দিয়ে কেন সবাইকে যেতে হয়, এই প্রশ্ন মনে বারবার উঁকি দেয়।

জননী ও জন্মভূমি সর্বদা সবার কাছে অতুলনীয়। অপূর্ব তার রূপ, রস ও গন্ধ। যে মোহতায় সব বাধা, বিপত্তি অতিক্রম করে মন ফিরতে চায় মায়ের কোলে। কিন্তু মা যে আমার এখন চোখে দেখে না। হয়তো গায়ে, মুখে, মাথায় হাতের পরশ বুলিয়ে মা বুঝবেন তাঁর কাছে আমাদের ফেরা। অন্তুকে কোলে জড়িয়ে ধরে অনুভব করবেন ছোট্ট অন্তুর বড় হয়ে যাওয়াকে। এরপর হয়তো মায়ের চোখ দিয়ে পানি ঝরবে। ছেলের বাড়ি ফেরার আনন্দাশ্রু।

বাবা হয়তো কেঁদে বলবেন, ‘চিকিৎসা করেও আমি পারলাম না তোমার মায়ের চোখের দৃষ্টিশক্তি স্বাভাবিক রাখতে’। শাশুড়ি হয়তো বিধবাবেশে কাঁদতে কাঁদতে সামনে এসে বলবেন, ‘আমি পারলাম তোমাদের বাবাকে বাঁচিয়ে রাখতে।’ এসবের কোনোটাই শোনার জন্য আমরা প্রস্তুত ছিলাম না। কিন্তু বাস্তবতা বড়ই নিষ্ঠুর ও নির্মম হয়। যে নির্মমতায় মন ডুকরে কেঁদে ওঠে।

বাড়ি ফেরার আনন্দে ভাটা পড়ে। ভালো কিছু ভাবতে পারি না। চারপাশের বাতাস বেশ ভারী হয়ে আসে। চারপাশের সবকিছু বদ্ধ মনে হয়।

লেখক: অজয় কান্তি মণ্ডল, গবেষক, ফুজিয়ান অ্যাগ্রিকালচার অ্যান্ড ফরেস্ট্রি ইউনিভার্সিটি, ফুজিয়ান, চীন