অন্যরকম

বছর দশেক আগের কথা। আম গাছ, জাম গাছ ছিল আরেফিনের প্রিয় স্থান। কী সকাল আর সন্ধ্যা! বাড়ি, পরের বাড়ি, রাস্তাঘাট, বাগান এক কথায় ঘুম ছাড়া অধিকাংশ সময় তাকে দেখা যেত কোনো গাছের মগডালে। আম গাছে থাকলে আম, জাম গাছে থাকলে জাম আপন ভেবে খেতে কখনো দ্বিধা করেনি। গাছ মালিকের সঙ্গে কখনো যে বাগ্‌বিতণ্ডা হয়নি এমন নয়। একবার মারুফ সাহেব কী একটা কাজে শহর থেকে বেশ রাত করে বাড়ি ফিরছেন। ভদ্রলোক হাইস্কুলের মাস্টার। সে সময় গ্রামের মানুষ বাইরে গেলে যদি বুঝতেন ফিরতে রাত হবে, টর্চ লাইট নিতে ভুল করতেন না। তখন গ্রামে বিদ্যুৎ ছিল না। সন্ধ্যা নামতেই ঘুটঘুটে অন্ধকারে ছেয়ে যেত সারা গ্রাম। তারপরেই পিনপতন নিস্তব্ধতা। গুড়িগুড়ি বৃষ্টির ভেতর মারুফ সাহেব এদিক-ওদিক আলো ছড়িয়ে দ্রুত বেগে বাড়ির দিকে ছোটেন। বাড়ির কাছাকাছি চলে এসেছেন। মাথার ওপর কী একটা এসে পড়তেই কেঁপে ওঠেন। আলো ফেলে দেখেন, আমের আঁটি। বাদুড় আম খায় তবে পরিচ্ছন্ন আঁটি দেখে নিশ্চিত হন কিছু কিন্তু আছে। ওপরের দিকে লাইট মারতেই দেখা যায় আরেফিনকে। বেশ আয়েশি ভঙ্গিতে বসে আম খাচ্ছে। জামাকাপড় ভিজে শরীরের সঙ্গে লেপ্টে একাকার। দেখেই গা জ্বলে ওঠে মারুফ সাহেবের।

—চাচা চোখে লাইট মারেন ক্যান?

—এই নাম। এত রাতে বৃষ্টির ভেতর কোনো শয়তানও গাছে উঠবে না। তুই কোন

কোয়ালিটির শয়তান রে!

আরেফিন হাসে। কী যে বলেন! আম দুধ তো বহু খাইছেন আম বৃষ্টি খেয়েছেন? দারুণ।

—গাছটা কি তোর বাপ লাগাইছে?

আরেফিন হাসে। বলে কি! সেই ছোটবেলা বাবা চলে গেছেন। মাটির নিচে কী অবস্থা কে জানে! থাকলে এ গাছটা বাবাও লাগাতে পারতেন। গাছ থেকে নেমে মারুফ সাহেবের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বলে, বাপ তুলতে হয় না চাচা। আপনি না মাস্টার। বোঝেন না?

—না, বুঝি না। তুই কি লেখাপড়া করিস? ভবঘুরে, বদমাশ। আমি মাস্টার হই আর না হই তাতে তোর কী?

—এ জন্যই তো মাথায় আঁটি পড়ে। যেদিন গাছ পড়বে সেদিন বুঝবেন।

মারুফ সাহেব ঠাস করে একটা থাপ্পড় কষে দেন। যা ভাগ আজ কিছু বললাম না। ফের যদি দেখি, সেদিন বুঝবি কত মাসে বছর।

থাপ্পড়ের ওজন আছে। আরেফিনের মাথা ঘুরে ওঠে। আজ কিছু বললেন না! আরেফিন অবাক হয়। সেদিন এমন একটা চড় হজম করেছিল নিতু! বাবা হারা আরেফিনের পড়ালেখায় চেষ্টার ত্রুটি করেনি তার মা। স্কুলে যে যায়নি এমনও নয়। শিক্ষকেরাই বলে দেন, এর পড়ালেখা হবে না। মানুষ না। আরেফিনের মনের ভেতর এই যে মানুষ হওয়ার ইচ্ছা, জাগেনি কোনো দিন। যে হারে মানুষ মরছে, তাতে মানুষ হওয়ার চেয়ে না হওয়াই ভালো! মায়ের আক্ষেপ, দীর্ঘশ্বাস উপেক্ষা করেই চলত রুটিনমাফিক কাজ। স্কুলের নাম করে গাছের ডালে বসে থাকা। পরীক্ষায় উত্তরের জায়গা ভুল কথায় ভরা। অবশ্য বিষয়গুলো আরেফিনের কাছে আজগুবি মনে হতো না। একবার প্রশ্ন এসেছিল, প্রাকৃতিক দুর্যোগ বন্যা মোকাবিলায় করণীয় কি?

আরেফিন লিখেছিল, বন্যায় চারদিক নদী হয়। সাঁতার কাটার বড় প্রতিযোগিতার আয়োজন করা যেতে পারে। নদী দেখতে কারও নদীর পাড়ে যেতে হয় না। গাছ আমাদের বাড়িঘর হয়ে ওঠে...।

ক্লাসের সবাই হাসে। একজন হাসে না। মারুফ সাহেবের মেয়ে নিতু। আরেফিন যখন সবার সামনে কান ধরে দাঁড়ায়, গোটা ক্লাসে চোখ বুলিয়ে নিতু ছাড়া সবার হাসিমুখ, চোখে খুশির ঝিলিক দেখে। ছুটির ঘণ্টা পড়লে আরেফিন হাফ ছেড়ে বাঁচে। স্কুল আর কবরস্থান দুটো এক রকম। পার্থক্য কবর থেকে ছুটির ঘণ্টা পেয়ে কেউ দৌড়ে বের হয় না। কবর ফুঁড়ে বেরিয়ে আসে না।

কিছু দূর এগিয়ে জহুর আলীর পুরোনো শিরীষ গাছটা চোখে পড়ে। কিছুক্ষণ বিশ্রাম নেওয়া দরকার। বইখাতা নিচে ফেলে গাছে উঠবে এমন সময় পেছন থেকে কেউ ডাকে। আরেফিন ভাই। আরেফিন পেছন ফিরে দেখে নিতু।

—আরে তুমি?

—অবাক হয়েছেন?

—অবাক হওয়ার কী আছে। গাছে উঠবে?

নিতু হাসে। হাসিতে মায়া আছে। পারি না তো। উঠতে মন চায়। আচ্ছা ওপর থেকে আমাদের গ্রাম কেমন দেখায়?

—সবুজের ভেতর কিছু ঘরবাড়ি, কিছু মানুষ ও প্রাণীর চলাফেরা। দূরে দেখা যায় নদী। এঁকেবেঁকে চলে গেছে, যেখানে আকাশের সঙ্গে তার মিতালি।

মুগ্ধতা নিয়ে আরেফিনের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে নিতু।

—আমার দিকে হাঁ করে তাকিয়ে আছ কেন!

—আপনার দিকে তাকানো যাবে না?

—যাবে না কেন! কারও চোখ তো আমি কিনে রাখিনি।

নিতু খিলখিল করে হেসে ওঠে। হাসি শেষ হয় না। আরেফিনের চোখে পড়ে মারুফ সাহেব সাইকেল চালিয়ে গ্রাম্য রাস্তা ধরে এগিয়ে আসছেন।

—নিতু তোমার বাবা আসছে। নিতুর যেন কোনো ভয় নেই। ভয়হীন কণ্ঠে বলে, আসুক।

মারুফ সাহেব নিজের মেয়েকে আরেফিনের সঙ্গে দেখে লাল চোখে তাকান, কীরে এখানে দাঁড়িয়ে কী করিস?

—আরেফিন ভাইয়ের সঙ্গে গল্প করি।

—ওর সঙ্গে গল্প! অমানুষ থেকে দূরে থাকতে হয় জানিস না?

—জানি। এ জন্যই তো মানুষের সঙ্গে নিরিবিলি কথা বলছি।

কথা শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে নিতুর গালে থাপ্পড় আছড়ে পড়ে। মুখটা লাল হয়। বাড়ি চল বেয়াদব। সেদিন থাপ্পড় খেয়ে নিতু নীরবে চলে গিয়েছিল। হেঁটে যাওয়া দেখেছিল। বুকের ভেতর দেখার ক্ষমতা কই! নিতুর গালে কষে দেওয়া মারুফ সাহেবের সেই থাপ্পড়ের মুহূর্তটা বৃষ্টি ভেজা রাতের আঁধারে একেবারে জীবন্ত হয়। চড়-থাপ্পড় এক প্রকার ট্যাবলেট। এ জন্য সম্ভবত মানুষ বলে, মাইরের ওপর ওষুধ নেই। ভাবতে ভাবতে নীরবে নিঃশব্দে নদীর পাড়ে গিয়ে বসে। আকাশ থেকে বৃষ্টি পড়ে! আকাশ কি পৃথিবী! মেঘমালা! এরা পৃথিবী না হলে পৃথিবীতে আছড়ে পড়ে কেন! পৃথিবী কী! তার বাবা তো ছিল। ছোটবেলা দেখা সে মুখ চোখের পাতায় ভাসে। কোথায় গেলেন!

রাতভর উদ্ভট সব ভাবনা ১৬ বছর বয়সী আরেফিনকে ভাবনার ভিন্ন এক জগতে নিয়ে যায়। যেখানে সে কোনো কূল খুঁজে পায় না। দ্রুত রাত পেরিয়ে যায়। সকাল হতে না হতেই মা এসে হাজির। পূর্ব দিগন্তে তখন মেঘ সূর্যের লুকোচুরি খেলা চলছে। বাড়ি থেকে নদী দূরে নয়। হাঁটাপথে মিনিট পাঁচেক লাগে। কান্না জড়ানো কণ্ঠে বলেন, আমাকে কি বাঁচতে দিবি?

—কেন কী হয়েছে?

—কী আর হবে! তুই পাগলামি করে বেড়াবি আর আমি সারাক্ষণ চিন্তায় মরব। পড়ালেখা তো আর শিখলি না। ভ্যান চালাস।

আরেফিন কিছু বলে না। কয়েক দিন পরের ঘটনা। বেশ গরম পড়েছে। মাঝে মাঝে বৃষ্টি। আরেফিন রাস্তার পাশে একটা সড়া গাছের ওপর বসে আছে। কিছুক্ষণ পর গাছের নিচে এসে উপস্থিত হয়, কালু, নিলু, সাগর আর ও পাড়ার কয়েকজন। সবাই মাস্তান। মানুষজন তাদের দেখলে ভয়ে কে কোথায় পালাবে, পথ খোঁজে। ছোটখাটো একটা মিটিং হয়। সারসংক্ষেপ এই, আজ রাতে মারুফ সাহেবের বাড়িতে ডাকাতি হবে। তেমন বাধা আসবে বলে তারা মনে করে না। আর যদি আসে তো প্রয়োজন মতো হত্যা করা হবে। সম্পদের সঙ্গে নিতুকেও আনা হবে। তবে তাকে বাঁচিয়ে রাখা যাবে না। ঘটে চলা শত ঘটনার মতো নিতুও হবে এক ঘটনা।

সড়া গাছে বসে আরেফিন ভাবে কী করা যায়! আপন মনে একটা ছক আঁকে। প্রতীক্ষা রাতের। সন্ধ্যা নেমে রাত একটু গভীর হতেই নিতুদের ঘরের কাছে বড় আম গাছে উঠে বসে আরেফিন। এক ব্যাগ পাথর, পাঁচ টাকার বাদাম তার সম্বল। মৃদুমন্দ বাতাসে রাতের আঁধারে বাদাম খাওয়ার মজাই আলাদা। আকাশে ঝিলিমিলি তারা। রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে অন্ধকার তীব্র হয়। মধ্য রাত। ৮-১০ জনের একটা দল এগিয়ে আসে। কাছাকাছি আসতেই চিকন গলায় খিকখিক করে হেসে ওঠে আরেফিন। আসবি জানতাম। ভড়কে যাওয়া মানুষগুলো একে অপরের দিকে তাকায়। আরেফিন সুর চড়িয়ে বলে, ভূত সম্রাটের প্রিয়তমা নিতুর বাড়ি লুট, নিতুকে নিয়ে মজার স্বপ্ন! সড়া গাছের নিচে পরিকল্পনা! ঘাড় মটকাতে সম্রাট আসছে। কথা শেষ করেই একটা পাথর গাছ পালার ঝোপে ছুড়ে মারে। পাতায় পাতায় খচমচ শব্দ। গাছপালা ভেঙে সম্রাট আসছে! দ্বিতীয় পাথর ছুড়তে গিয়ে ঘটে যায় বিপত্তি। পাথর ছোড়ার সঙ্গে হাত ফসকে যায়। পড়ে যাওয়া থেকে বাঁচতে একটা ডাল ধরে, সেটা ভেঙে একেবারে সোজা নিতুদের টিনের চালে। মাঝরাতে বিকট আওয়াজ। কে একজন বলে, ওরে বাবা গাছপালা ভেঙে টিনের চালে সম্রাট নামছে। বাঁচতে চাইলে পালা। দৌড়ে পালানোর শব্দ আরেফিনের কানে আসে। চালের ওপর কয়েক ডজন ঘুরপাকের পর মাটিতে আছড়ে পড়ে আরেফিন। কিছুক্ষণ মাটিতে পড়ে থাকে। যখন উঠে বসে তখন হুড়মুড় করে দরজা খুলে বেরিয়ে আসেন মারুফ সাহেব। টর্চ লাইটের আলো ফেলতেই দেখেন, দরজার সামনে কাদামাটি মাখিয়ে বসে আছে আরেফিন। চিৎকার করে ধেয়ে আসেন, আজ তোর ভণ্ডামি ছোটাব। এত রাতে আমার টিনে ইট ফেলছিস! হাতের টর্চ লাইট দিয়ে একের পর এক আঘাত করেন। আরেফিন বলতে থাকে, আমি ইট ফেলিনি। ভূত সম্রাট টিনের চালে আছড়ে পড়েছে। মারুফ সাহেব আরও রেগে যান। হাত, পা, পিঠ, মাথা কিছুই বাদ পড়ে না। অল্প সময়ের মধ্যে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে আরেফিন। একটু পরেই ঘর থেকে দৌড়ে বের হয় মারুফ সাহেবের স্ত্রী ও মেয়ে নিতু। দুজন অনেক চেষ্টা করে মারুফ সাহেবকে থামান। নিতু কাঁদতে কাঁদতে বলে, ও মরে যাবে বাবা।

রক্ত, মাটি ও বৃষ্টি ভেজা শরীর। নিতু মেয়েটা কাঁদে কেন! তিনজন মানুষের তিন রকম আচরণ। একজন ক্ষিপ্ত, তার স্ত্রী সহমর্মী আর মেয়ে ব্যথিত। শেষতক রাতের গভীরতা উপেক্ষা করে আরেফিনকে ধরে বাড়ির দিকে নিয়ে চলে তিনজন মানুষ। আরেফিনকে এভাবে দেখে প্রথমে হতভম্ব হয়ে যান তার মা। তারপর ডুকরে কেঁদে বলেন, আমার ছেলের এ অবস্থা কেন?

—সেটা আপনার ছেলের কাছ থেকেই শুনবেন।

বাড়ির দিকে পা বাড়াতেই নিতু বলে ওঠে, বাবা ওকে ডাক্তার দেখানো জরুরি। মারুফ সাহেব ধমকের সুরে বলেন, এত রাতে ডাক্তার পাবে কোথায়? যাদের কাজ তারা করবে। নিতুর হাত ধরে বাড়ির পথ ধরেন। পেছন পেছন হাঁটেন তাঁর স্ত্রী।

আরেফিনকে খাটে শুইয়ে দিয়ে তার মা চিৎকার করে কাঁদতে কাঁদতে বলেন, তোর কী হয়েছে বাবা! কী করে এমন হলো?

আরেফিন জবাব দেয় না। গভীর রাতে কান্নাকাটি শুনে প্রতিবেশীরা জড়ো হতে থাকে। ক্ষতস্থান পরিষ্কার করে কাপড়ের পট্টি বাঁধা হয়। কেউ কেউ হাত-পায়ে তেল মালিশ করে। বেশ উপভোগ্য। আরেফিন ভাবে, পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর, পবিত্র, উপভোগ্য দৃশ্য হলো—মানুষের দ্বারা মানুষের উপকার। সেবা। খবর ছড়িয়ে পড়ে। মানুষের ভিড় বাড়ে। আরেফিন শুয়ে আছে। কালু, নিলুর দলও এসেছে। কেন মারল, কে মারল? কিছুটা উত্তেজিত কালু। এরা ধান্দায় থাকে। কিছু একটা ঘটলে সেখানে তাদের উপস্থিতি অনিবার্য।

আরেফিন কালুকে ইশারায় ডাকে। কালু মুখের কাছে কান দেয়। আরেফিন ফিসফিস করে বলে, ভাই আমি নিতুকে পছন্দ করি। কিন্তু ভাই!

কালুও ফিসফাস করে বলে, কিন্তু কী?

—কিন্তু যেই না বাড়ির সামনে গেছি...

—হ্যাঁ।

—বিরাট এক আগুনের দলা ধপ করে আমার সামনে এসে পড়ল।

—তারপর! কালু ঘেমে যাচ্ছে।

—তালগাছের মতো একটা দানব। চোখে আগুন। বিকট গর্জন ছেড়ে বলে, আমার নিলুর বাড়ি। নিলুকে আমি ভালোবাসি। তুই এসেছিস! একটুর জন্য চোরের দল ধরতে পারিনি, তোকে পেরেছি। বলেই এক আছাড়... ভাই…।

কথা শেষ না হতেই কালু উঠে দাঁড়ায়। আচ্ছা যাই। নিলু, সাগর বাধা হয়ে দাঁড়ায়। যাবে মানে! ছেলেটাকে মারল বিচার হবে না? কালু এক ঝটকায় হাত সরিয়ে পড়িমরি করে বেরোয়। যেতে যেতে বলে, বিচার! আগে তো নিজে বাঁচি।

ওভাবে কালুকে চলে যেতে দেখে নিলু, সাগর দাঁড়ায় না। তারাও পেছনে ছোটে। মাস্তানদের ভয়ে পালাতে দেখে আগন্তুক এলাকাবাসী বুঝে নেয়, ঘটনা জটিল। ভয়াবহ। তারাও আস্তে আস্তে কেটে পড়ে। আপন মনে হাসে আরেফিন। বিড়বিড় করে বলে, মানুষের দল, প্রিয় প্রতিবেশী। মা কাছেই ছিলেন। কিছু বুঝে উঠতে পারেন না। তুই চুরি করতে গিয়েছিলি!

—হ্যাঁ, চোর কি মানুষ না?

—ছি, ভাবতে লজ্জা হচ্ছে তুই আমার সন্তান।

রাতেই তার মামার কাছে ফোন করেন। ভাগনে চোর হয়েছে। ভূতে আছাড় মেরে কী করেছে দেখে যা, নিয়ে যা। ভদ্রলোক আশ্বস্ত করেন। অনেক আঁকাবাঁকা কথার পরও মা দূরে যাননি। আরেফিনের পাশে নির্ঘুম রাত কাটে তার।

মারুফ সাহেব ভয়ে ছিলেন। কী জানি হয়! সকালে যখন মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়া কথাটা কানে আসে—আরেফিনকে ভূত আছাড় মেরেছে। একেবারে খুশিতে আটখানা। মারবেই তো, বদটা সারা দিন গাছে গাছে যা করে ওকে ভূতে আছাড় মারবে না তো মারবে কাকে। মুখে অনেক কথা বললেও মারুফ সাহেব হিসেব মেলাতে পারেন না।

চার দিন পর আরেফিনের মামা আসেন। ভাগনেকে মনে হয় নিজেই একটা ভূত। প্রায় সারা শরীরে ব্যান্ডেজ লাগানো। মমতা নিয়ে বলেন, এখানে আর থাকতে হবে না। কালই আমার সঙ্গে ঢাকা যাবি। অনেক বোঝানোর পর রাজি হয় আরেফিন। সেখানে গাছ না থাকলেও বড় বিল্ডিং আছে। অনেক ওপরে আকাশের কাছাকাছি যাওয়া যায়! দেখা যায়।

আরেফিন ঢাকা চলে যাচ্ছে। বিদায় বেলায় নিতু ছুটে এসেছিল। মুখের দিকে তাকিয়ে একটা আবেদন করে, আরেফিন লেখাপড়া শিখে ওদের দেখিয়ে দিন না, আপনি কতটা পারেন।

আরেফিন নিতুর দিকে তাকায় না। মামার সঙ্গে শহরের উদ্দেশ্যে পা বাড়ায়। সেই যে আসা আর গ্রামে যাওয়া হয়নি। মাঝে মাঝে মা এসেছে শুধু। কত বছর পেরিয়েছে! হিসাব করতে ইচ্ছা করে না। এসএসসি, এইচএসসি পরীক্ষায় ভালো রেজাল্ট করে সৌভাগ্যক্রমে মেডিকেলে চান্স পেয়ে যায়। মামা বলেছেন, যা এবার গ্রামে গিয়ে মাকে সারপ্রাইজ দিয়ে আয়?

আরেফিন গ্রামে যাবে। নদী, গাছ, মা আর নিতুর কথা মনে পড়ে খুব। সব কী অন্যরকম হয়ে গেছে, নিতু!