অন্য বাংলাবোধের জীবনতৃষ্ণা

সম্প্রতি একটি লিটল ম্যাগাজিনের চাহিদা মেটাতে গিয়ে একটি প্রবন্ধ লিখতে হয়েছে। বাংলাদেশের বাইরে কয়েক মাস থেকে আমার মনোজগতে কিছু অনুভবের সঞ্চার ঘটেছে। সেই অনুভবলোক নিয়ে লেখা আমার সেই প্রবন্ধটির নাম ‘অন্য বাংলাবোধ’। ‘বাংলাবোধ’ শব্দটি বাঙালিত্ব বা বাংলাদেশিত্ব শব্দের একটি নিছক প্রতিশব্দ হিসেবে ব্যবহৃত হয়নি। কারণ আমার কাছে এখন এসবের থেকে খানিকটা স্বতন্ত্র এক বোধের পরিচায়ক এই ‘বাংলাবোধ’ শব্দটি।
‘বাংলাবোধ’ শব্দটির তাৎপর্য ‘বাঙালিত্ব’ কথাটির চেয়ে আরও একটু প্রসারিত অর্থের গভীরে নিহিত। এর উপজীব্য অন্য দেশে বসবাসরত বাংলার মানুষ। বিরাটসংখ্যক বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত মানুষ এখন স্থায়ীভাবে বিদেশে থাকেন; কেবল বিদেশে কোনো রকমভাবে থাকেনই না, থাকেন ভবিষ্যৎ জীবনের সমৃদ্ধি অর্জনের কল্পনা নিয়ে। তাঁরাই এই শব্দটির ধারক।
এই শব্দটি তাঁদেরই মনোভঙ্গি প্রকাশ করে যাদের স্বপ্ন আর বাংলাদেশ কেন্দ্রিকতায় সীমিত নয়। এমনকি কোনো দিন বাংলাদেশে ফিরে জীবনযাপন করতে হবে এমন ভাবনাও তাঁদের অনেকের মধ্যেই নেই। অন্য দেশে বসবাসকারী বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত মানুষের সন্তানসন্ততিরা জন্মাচ্ছে সেই অন্য দেশের অধিবাসী হয়েই। বাংলার সাংস্কৃতিকতার অনেক কিছু থেকেই যে তারা বঞ্চিত থাকবে সেটাই স্বাভাবিক। তা সত্ত্বেও তাঁরা কিন্তু বাংলাবোধকে পুরো ত্যাগ করতে পারেন না। বাংলাদেশে কোনো দিন ফেরা না হলেও বাংলাদেশের সাংস্কৃতিকতার সঙ্গে তাঁদের ঠিকই সম্পর্ক রাখতে হবে। অন্য দেশে বাস করেও তাঁদের বহন করে চলতে হবে বাংলাদেশের নানা অঞ্চলের স্মৃতি।
বাংলাভাষার চর্চা না করলেও, এমনকি বাংলা লিখতে পড়তে না জানলেও তাঁদের সন্তানদের বহন কেরে চলতে হবে বাংলারই সাংস্কৃতিক-মনস্তাত্ত্বিক উত্তরাধিকার। বাংলার সাংস্কৃতিক স্মৃতিবাহিত এই উত্তরাধিকার নিয়ে অন্য দেশের সংস্কৃতিতে মিশে বেঁচে থাকাকেই আমি বলতে চাই ‘অন্য বাংলাবোধ’ নিয়ে বেঁচে থাকা। ‘অন্য বাংলাবোধ’ শব্দযুগল ব্যবহার করতে চাই তাঁদের বোধের পরিচয় তুলে ধরার জন্য। কারণ তাঁরা তাদের বাংলাবোধকে সম্প্রসারিত করে নিয়েছেন বাংলাদেশের ‘বাংলাবোধ’ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে! তাঁদের জীবনবোধ বাঙালিত্বের উৎসভূমির অনুষঙ্গের সঙ্গে মিলে আরও সম্প্রসারমাণ। আবহমান বাংলার সাংস্কৃতিকতার সঙ্গে অন্য যে দেশে স্থায়ীভাবে বাস করছেন সে দেশের সাংস্কৃতিকতা যুক্ত হয়ে তা পাচ্ছে ভিন্ন মাত্রা।
আমরা যদি বাংলার ইতিহাসের দিকে তাকাই তাহলে লক্ষ করব বাংলাদেশের মানুষের কাছে সবচেয়ে বড় ঘটনা তাদের স্বাধীনতা অর্জন। কারণ নিজেদের সমষ্টিবদ্ধ জীবনতৃষ্ণা থেকেই বাঙালি অর্জন করেছে বাংলাদেশ নামের একটি স্বাধীন রাষ্ট্রকে। অন্য বাংলাবোধের জীবনতৃষ্ণা থেকে তাহলে কী অর্জনের সম্ভাবনা? অনেকেই লক্ষ করেন না যে বাংলাদেশ থেকে আসা মানুষেরা উন্নতি লাভের আকাঙ্ক্ষায় অদম্য। এটাই তাঁদের জীবনতৃষ্ণা। অনেকেরই মধ্যে লক্ষ করেছি আমেরিকার জীবনযাত্রার মূলধারায় প্রবেশ করার আকাঙ্ক্ষা বেশ তীব্র! নিজেরা হয়তো পারলেন না, কিন্তু তাঁদের সন্তানসন্ততিরা পারবেন এই আশায় তাঁরা বুক বেঁধেছেন। অনেককেই দেখছি আমেরিকাকেই আরেক বাংলাদেশ বানিয়ে তাঁরা বসবাস করছেন।
এখানে ওখানে বাংলা স্কুল গড়ে উঠছে। গড়ে উঠছে নতুন নতুন বাংলার গান নাচ আবৃত্তি শেখার স্কুল ও সাংস্কৃতিক কেন্দ্র। বাংলা গানের বৈচিত্র্য এরাও অল্পস্বল্প ধারণ করতে শুরু করেছে। এর থেকে উৎসারিত বাংলাবোধও এখানকার সংগীত জগৎকে প্রভাবিত করবে। শুধু তাই নয়, এরা মূলধারায় সফল হলে বাংলাদেশে তাদের সমাদর বাড়বে। যখন সে রকমটি প্রায়শই ঘটতে থাকবে তখন প্রাণশক্তিতে ভরপুর বাংলাদেশি সমাজ তাদের এগিয়ে চলার আকাঙ্ক্ষাকে আরও তীব্র করে তুলবে।
বাংলাদেশের বিভিন্ন জাতীয় দিবসে নতুন প্রজন্মের অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে বাহিত হচ্ছে বাংলাবোধের উত্তরাধিকার। এই সব অনুষ্ঠানাদি এখন এতই বেড়ে গেছে যে কোনটাতে কে যাবেন তার অগ্রাধিকার নিয়েও ভাবতে হয়। একসময় শীতকালে এখানে তেমন বাংলার সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানাদি হতো না। কিন্তু এখন শীতেও নিস্তার নেই! অনেক সময় একত্রে সকলকে দেখে আর বোঝোই যায় না যে তাঁরা বাংলাদেশে নয় আমেরিকায়ে বসবাস করছেন। তীব্র তুষারপাতের সম্ভাবনাও পিঠা উৎসব আয়োজনকে দমিত করতে পারে না। এখানকার পুরোনো অধিবাসীদের তুলনায় প্রায় আর্থিক সামর্থ্যহীন বাংলাদেশি সমাজ নিয়মিত আয়োজন করে চলেছে অনুষ্ঠানের পর অনুষ্ঠান। এই যে অদম্য উৎসাহ এইই তো তাদের জীবনতৃষ্ণা!
প্রথম প্রজন্মের মানুষ সংগঠন গড়ে তুলছে স্ব স্ব উৎসভূমির আঞ্চলিকতাকে অবলম্বন করে। এখন এই সব সংগঠনের কাজ নিজেদের একত্র করার অনুশীলনের মধ্যে সীমিত থাকলেও অচিরেই প্রবেশ করবে পরবর্তী ধাপে। সাংস্কৃতিক চর্চায় এখন যেখানে রুচির দুর্ভিক্ষ পীড়িত করে একসময় সেখানে সম্মিলিত মেধা, শ্রম ও অর্থ বিনিয়োগে হয়ে উঠবে আনন্দময়তায় উজ্জ্বল। এই স্বপ্নই তো বাংলাবোধের জীবনতৃষ্ণা!
বাংলাদেশি সমাজের এই সব অনুষ্ঠানে নতুন প্রজন্মের অল্পস্বল্প অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে তাদের মূলধারায় প্রতিষ্ঠা লাভের স্বপ্নের সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে ‘বাংলাবোধ’। আবার এদের মধ্য থেকেই কেউ কেউ হয়ে উঠছে নতুন এই বাংলা অঙ্গনের তারকা। ফলে বাংলার সাংস্কৃতিকতার অন্তর স্রোত বয়ে চলছে তাদের আত্মপ্রতিষ্ঠার স্বপ্নের সঙ্গে মিশে গিয়ে। এটাকেই আমরা বলতে পারি অন্য বাংলাবোধের জীবনতৃষ্ণা!
যতই দিন যাচ্ছে ততই এই জীবনতৃষ্ণা বৃদ্ধি পাচ্ছে! তাই তো আমরা দেখতে পাচ্ছি এখানে জাতিসংঘের সামনে শহীদস্মৃতি ভাস্কর্য স্থাপনের মধ্য দিয়ে বেশ বড় আয়োজন চলে একুশে ফেব্রুয়ারি উদ্‌যাপনের। স্বাধীনতা দিবসে, বিজয় দিবসে, দুই ঈদে, এমনকি এপ্রিলের তীব্র শীতানুভবের মধ্যেও পয়লা বৈশাখের খরতাপের কল্পনায় বাংলাদেশি সমাজের মানুষের উৎসব আয়োজনে উৎসাহের অন্ত নেই! বাংলাদেশি সমাজের জীবনতৃষ্ণার এই তীব্রতা যে কারওই চোখে পড়বে। সারা আমেরিকায় এই জীবনতৃষ্ণার জাগরণের যে মাত্র শুরু হলো এখন! পুরো পথ তো সামনে!