অন্ধ হলে প্রলয় বন্ধ হবে না
দেশে কোভিড-১৯ সংক্রমণ আশঙ্কাজনকভাবে বেড়ে যাওয়ায় সরকার আবার লকডাউন দিতে বাধ্য হয়েছে। যেকোনো দেশের জন্য এটা দুঃসংবাদ, কিন্তু আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশের জন্য এটা ভয়াবহ দুঃসংবাদ। জীবন বাঁচাতে এত কঠিন পদক্ষেপ নিতে হয়েছে একই মহামারিতে আবার বছর খানেক পর। একটু সাবধান হই সবাই। বন্ধু–বান্ধবী নিয়ে আনন্দ–আড্ডা করতে পারব যদি বেঁচে থাকি সবাই। গরিব মানুষ, যাঁরা ‘দিন আনি, দিন খাই’ করে বাঁচেন, তাঁদের কথা চিন্তা করে রাতের ঘুম হারাম হয়েছে।
কয়েকটা কথা শেয়ার করছি।
১.
যাঁদের ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, হার্ট ফেইলিওর, কিডনি ফেইলিওর–জাতীয় রোগ আগে, তাঁরা চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে রোগগুলো নিয়ন্ত্রণে রাখুন। হাসপাতালগুলো খোলা আছে যাতে কোভিড হবে ভয় করে ঘরে বসে থেকে এসব রোগে মারা না যান। লকডাউনের নিয়ম মেনেও চিকিৎসা নেওয়া সম্ভব। আমেরিকার হাসপাতালে কোভিড রোগীর সংখ্যা আপাতত অনেক কম, কিন্তু এসব ক্রনিক সমস্যা না খেয়াল করাতে অনেকে আসছেন অনেক বেশি কমপ্লিকেশন নিয়ে, যেটা সারিয়ে তুলতে এখন হিমশিম খাচ্ছি আমরা।
২.
যাঁরা টিকা নিয়েছেন, ভবিষ্যতে নেবেন, তাঁদের জন্য কিছু কথা বলছি। ডিসেম্বরের মাঝামাঝি এসেছে কোভিড–১৯–এর টিকা। ফাইজার-বায়োএনটেকের টিকা আমি নিয়েছি, মডার্না কোম্পানির টিকাও পেয়েছেন পরিচিত অনেকেই। এখন জনসন অ্যান্ড জনসন কোম্পানি এনেছে তৃতীয় টিকা। দেশে এসেছে অক্সফোর্ডের টিকা, যেটা প্রায় ৭০ ভাগ কার্যকর কোভিড-১৯ রোগ প্রতিরোধে।
যেকোনো ওষুধে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া আছে। এ দেশে তাই সবাইকে বলি বেনিফিট দেখি আমরা। যদি বেনিফিট রিস্কের চেয়ে অনেক বেশি হয়, নেই সামান্য রিস্ক। এ টিকা এখন পর্যন্ত খুব অল্পসংখ্যক মানুষের সিভিয়ার এলার্জিক রিঅ্যাকশন হয়েছে। এক লাখ মানুষে একজন বা আরও কম যাঁদের এ টিকা দেওয়ার পর রক্তচাপ কমে গিয়ে দম বন্ধ হয়ে এসেছিল। একটি ইনজেকশন দিয়ে তাঁদের সুস্থ করা হয়েছে।
আমাদের মতো সাধারণ মানুষের জন্য এটা একটা মৌমাছির কামড়ের মতো। টিকার জায়গায় ফুলে যাওয়া, ব্যথা, অনেক সময় জ্বর বা শীত শীত ভাব, দুর্বলতা ও মাথাব্যথা হতে পারে এক থেকে তিন দিনের মধ্যে, থাকেও এক থেকে তিন দিন। টিকা যে কোম্পানিরই হোক, কয়েক সপ্তাহ সময় লাগে কার্যকর হতে।
ভাইরাস যেহেতু নিত্য বদলাচ্ছে, শতভাগ প্রতিরোধ কোনো টিকার পক্ষে দেওয়া সম্ভব নয়। তবে রোগের সিভিয়ারিটি কমে জীবন বাঁচে। কোভিড-১৯ ইনফেকশন হলেও এ টিকা নেওয়া উচিত।
মাস্ক এবং সামাজিক দূরত্ব মেনে যেতে হবে। কারণ, আমি হয়তো ক্যারি করছি এ রোগ। অন্য কাউকে এ রোগ দিয়ে মেরে ফেলার কোনো অধিকার আমার নেই।
৩.
কোভিড-১৯ শুধু সরাসরি পরীক্ষার মাধ্যমে ডায়াগনোসিস করা যায়, অন্য কোনো ল্যাব টেস্ট দিয়ে এই ইনফেকশন হচ্ছে কি না, সেটা কোনোভাবেই নির্ণয় করা সম্ভব না। হাসপাতালে ভর্তি রোগীদের ওষুধ দেওয়া হচ্ছে, উপুড় করে শুইয়ে রাখা হচ্ছে, নিউট্রিশাস খাবার দেওয়া হচ্ছে। নিউমোনিয়ার আশঙ্কা থাকলে অ্যান্টিবায়োটিক দেওয়া হচ্ছে। যাঁদের অ্যাজমাসহ অন্যান্য রোগ আছে, তাঁদের অক্সিজেন স্যাচুরেশন ৯৪–এর ওপরে থাকলে অ্যান্টিবডি চিকিৎসা, উপুড় করে শুয়ে থাকা, ব্রিদিং এক্সারসাইজ ইত্যাদি করে ভালো রাখা হচ্ছে।
৪.
মাইল্ড বা মডারেট ইনফেকশন হলে ৭ থেকে ১০ দিন আইসোলেশনে থাকতে হবে এবং সিভিয়ার কোভিড হলে রোগীকে ২১ দিন আইসোলেশনে থাকতে হবে, যাতে রোগ না ছড়ায়
৫.
মানসিকভাবে দুর্বল হয়ে যাওয়া এখন সবার সমস্যা। সবাই সবার হাত ধরে এ মহামারি পার করব, পৃথিবীতে অনেক মহামারি এসেছে, তারপরও মানুষ বেঁচে আছে, থাকবে। সবাই আইসোলেশনে থেকে এ রোগ প্রতিরোধ করি।
*লেখাটা এফডিএ এবং সিডিসির গাইড লাইন মেনে লেখা। আমি যে হাসপাতালে কাজ করি, এ লেখার সঙ্গে সরাসরি তার কোনো সম্পৃক্ততা নেই।
*লেখক: ফারহানা আহমেদ লিসা, মেডিসিন বিশেষজ্ঞ, আমেরিকা