অন্তহীন বৈষম্যের পথে

ভালোই কেটে যাচ্ছিল দিন, মাস, বছরগুলো! শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত রেস্তোরাঁয় কাজে তেমন একটা কষ্ট নেই। থাকা-খাওয়া বিনা মূল্যে আর মাস শেষে ১০ হাজার টাকা বেতনের ৮ হাজারই বাড়ি পাঠিয়ে দিত সে। নিজের বেতনের সঙ্গে স্থানীয় বাজারে বাবার ছোট্ট মুদি দোকানের আয়—দুয়ে মিলে সংসারে ও কলেজপড়ুয়া দুই ভাই, এক বোন ও মা-বাবা নিয়ে ছয় সদস্যের পরিবারটিতে খাওয়া পরার অভাবটা অন্তত ছিল না।

ফোনে কথা হচ্ছিল আমার পরিচিত ৩২ বছরের এক টগবগে যুবক জহির উদ্দিনের সঙ্গে। ধানমন্ডির প্রসিদ্ধ একটি চাইনিজ রেস্তোরাঁর ১৮ জন কর্মীর ১ জন সে, বাড়ি হবিগঞ্জের মাধবপুর উপজেলায়। ২৬ মার্চ থেকে শুরু করে এখনো তার রেস্তোরাঁটি বন্ধ, আর বাবার মুদির দোকানের যৎসামান্য আয় দিয়ে সংসার কোনো দিনই চলেনি। দেশের হাজারো হোটেল-রেস্তোরাঁ ও খাবারের দোকানের চিত্র এটি। সংক্রমণের ভয়ে উচ্চবিত্তরা এখন রেস্তোরাঁ খোলা থাকলেও খেতে যান না। আর মধ্যবিত্তদের মধ্যে ভয়ের সঙ্গে তো রয়েছে সামর্থ্যের অভাব। শ্রমিকদের বেশির ভাগের অবস্থাই জহির উদ্দিনের মতো। ঢাকায় থাকার সংগতি তাদের আর নেই, গ্রামে ফিরে গেছেন অনেকেই। অন্তত মাসশেষে মেসভাড়াটা তো সেখানে দেওয়া লাগে না।

ব্রিটিশ অর্থনীতিবিদ জন মেনার্ড কেইনস ১৯২৯ সালের মহামন্দা কাটাতে কর্মসংস্থান সৃষ্টির জন্য সরকারি ব্যয় বিপুলভাবে বাড়ানোর তাগিদ দিয়েছিলেন। তাঁর পরামর্শ ছিল, দরকার হলে একজনকে টাকা দিয়ে গর্ত খোঁড়াতে হবে, আরেকজনকে টাকা দিয়ে সেই গর্ত আবার ভরাতে হবে। এতে বাজারে টাকা ঘুরবে, অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়াবে।

জহিরদের হাতে টাকা থাকলে তাঁরা তা দিয়ে চাল-ডাল-তেল-চিনি কিনবেন। পাড়ার দোকান থেকে টাকা যাবে পরিবেশকের কাছে। পরিবেশক দেবেন মালিক গ্রুপকে। তারা তেল-চিনি আমদানি ঠিক রাখলে ব্যাংকের আয় কমবে না। ব্যাংকের আয় না কমলে কর্মীদের বেতন কমবে না। কর্মীদের বেতন না কমলে টিভি-রেফ্রিজারেটর বিক্রি ঠিক থাকবে। প্রতিটি লেনদেনে সরকার রাজস্ব পাবে—এটাই তো অর্থনীতির নিয়ম। টাকা এভাবে ঘুরে ঘুরে অর্থনীতিকে সচল রাখে। বদৌলতে জিডিপি (মোট দেশজ উৎপাদন) বাড়তে থাকে। কিন্তু যদি টাকাই না থাকে, তাহলে মানুষ ব্যয় করবে কোথা থেকে, কিংবা টাকা ঘুরবেই-বা কীভাবে?

পরিস্থিতি যে এতটা কঠিন হবে তা অবশ্য শুরুর দিকে আঁচ করা যায়নি। লকডাউন শুরুর পর সবচেয়ে বিপর্যয়ে পড়ে নিম্নবিত্ত শ্রেণির মানুষ। তাদের বেশির ভাগই নিজেদের জীবিকা হারিয়ে শহর ছেড়ে চলে যান। মধ্যবিত্তের ওপর আঘাতটা আসে আরেকটু পরে। সঞ্চয় ভেঙে খাওয়া শেষে তারা দেখেন হাতে কিছুই নেই। পরিবর্তিত সময়ে তারা সবচেয়ে বেশি সংকটে পড়ছেন বাসা ভাড়া মেটাতে গিয়ে। টালি খাতার হিসাব মেনে চলা এই শ্রেণি যা বেতন পান দেখা যায় তার অর্ধেকই চলে যায় বাসা ভাড়া মেটাতে। বাকি অর্ধেকে টেনেটুনে চলেন। এমন মধ্যবিত্তের অনেকেই এখন চাকরি হারিয়েছেন। তাদের জন্য এই শহরে টিকে থাকাই অসম্ভব হয়ে পড়েছে। শুনেছি গোটা ঢাকা শহর জুড়েই কেবল টু-লেট আর টু-লেটের ছড়াছড়ি এখন। বেতন আটকে গেছে, কেউবা তিন’মাসে একবার বেতন পাচ্ছেন আবার বেতন কমে গেছে অনেকের। এমনকি কয়েকটি ব্যাংকও কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন ঘোষণা দিয়েই কমিয়েছে। অঘোষিত বাস্তবতা হলো, সরকারি চাকরিজীবী ছাড়া কেউই আসলেই আর ভালো নেই।

অর্থনীতিবিদেরা বলছেন, এই মহামারি শুধু আর্থিক বিপর্যয় ডেকে আনেনি, মানসিক বিপর্যয়ও ডেকে নিয়ে এসেছে। কাজ হারানো, চাকরি হারানো মানুষগুলোর যদি আবার কর্মসংস্থানের সুযোগ না হয়, তাহলে আরও বিপদ। সামগ্রিকভাবে অর্থনীতি নিচের দিকে নেমে যাচ্ছে। অর্থাৎ, যাঁর বাড়িভাড়া দেওয়ার ক্ষমতা ছিল, তাঁর এখন আর সেই ক্ষমতা থাকছে না। আর যিনি বাড়িভাড়া দিয়ে রেখেছিলেন, তিনি বাড়িভাড়া পাবেন না। সামগ্রিকভাবে এই লোকগুলোর সবাই ক্রমান্বয়ে জীবনমানের দিক দিয়ে অনেক নিচে নেমে যাচ্ছেন। কেউ কেউ দারিদ্র্যসীমার নিচে চলে যাবেন। বিআইডিএসের সর্বশেষ জরিপ বলছে, করোনাকালে এখন পর্যন্ত ১ কোটি ৬৪ লাখ মানুষ নতুন করে দরিদ্র হয়েছে। বছর শেষে দারিদ্র্যের হার ২৫ শতাংশ ছাড়াতে পারে।

অন্যদিকে, এই বাংলাদেশে কোটিপতির সংখ্যাটাও বাড়ছে দ্রুতগতিতেই। ২০১৯ সালের ডিসেম্বর শেষে বিভিন্ন বাণিজ্যিক ব্যাংকে এক কোটি টাকা বা এর বেশি আমানত রয়েছে এমন অ্যাকাউন্টের সংখ্যা ছিল ৮৩ হাজার ৮৩৯টি। গত এক বছরে কোটিপতি অ্যাকাউন্ট বেড়েছে আট হাজার ২৭৬টি। এর মধ্যে সেপ্টেম্বর থেকে ডিসেম্বর- এই তিন মাসেই বেড়েছে তিন হাজার ৯৬২টি। বর্তমানে ব্যাংকিং খাতে মোট আমানতের প্রায় সাড়ে ৪৩ শতাংশই কোটিপতিদের দখলে। বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ প্রতিবেদন পর্যালোচনায় এসব তথ্য পাওয়া গেছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে শুধু যেসব ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের হিসাবে কোটি টাকার বেশি জমা আছে, সেই সংখ্যা দেওয়া হয়েছে। এর বাইরে অনেকেই আছেন, যাঁদের কোটি কোটি টাকার সম্পদ রয়েছে। এ ছাড়া সুইস ন্যাশনাল ব্যাংকের সর্বশেষ প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৯ সালে দেশটির বিভিন্ন ব্যাংকে বাংলাদেশিদের জমা করা অর্থের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৬০ কোটি ৩০ লাখ ফ্রাঁ; বাংলাদেশি মুদ্রায় যার পরিমাণ প্রায় ৫ হাজার ৩৬৭ কোটি টাকা। সংবাদমাধ্যমগুলো হিসাব-নিকাশ করে বলছে, এই টাকা দেশের প্রায় ১২টি বেসরকারি ব্যাংকের পরিশোধিত মূলধনের সমান। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশে অর্থনীতির আকার ক্রমেই বড় হচ্ছে। প্রতিবছরই বাড়ছে জিডিপি প্রবৃদ্ধি ও মাথাপিছু আয়। এতে মানুষের সঞ্চয়প্রবণতা বেড়েছে। তবে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির গুণগত মান না বাড়ায় সমাজের একটি শ্রেণির কাছেই বেশি সম্পদ ও অর্থ কেন্দ্রীভূত হয়ে পড়ছে।

একটি দেশের আয়বৈষম্য পরিমাপের মানদণ্ড হলো গিনি কো-এফিশিয়েন্ট। বর্তমান সরকার ২০০৮ সালে যখন ক্ষমতায় আসে তখন গিনি কো-এফিশিয়েন্ট ছিল ০.৩২ শতাংশ। ১০ বছর পর এসে তা বেড়ে ০.৪৯ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। অর্থনীতিবিদদের পরিভাষায় এটা ভয়ংকর। পৃথিবীর কোথাও বা আশপাশের কোনো দেশে কো-এফিশিয়েন্ট এত বেশি না।

মহামারির আক্রমণ ধরিয়ে দিল, আমাদের ছুটে চলা সব উন্নতির অন্তরালে একটা অন্ধকার আছে, আছে এক গভীর শূন্যতাও; আর সেটা হলো ক্রমাগত বাড়তে থাকা সামাজিক বৈষম্য। প্রবৃদ্ধি যেমন বাড়ছে, তেমনি বাড়ছে সুইস ব্যাংকে আমানত, বাড়ছে কোটিপতির সংখ্যা কিন্তু চিড়েচ্যাপটা হয়ে যাচ্ছে দেশ, দেশের মধ্যবিত্ত আর নিম্নমধ্যবিত্ত। কী দ্রব্যমূল্য, কী বিদ্যুৎ-গ্যাস-পানির বিল, কী সার্ভিস চার্জ, কী ব্যাংক আমানত, কী সঞ্চয়পত্রে সুদের হার, কী পরিবহন ভাড়া, বাসাভাড়া, কী স্বাস্থ্য-শিক্ষা খরচ সবকিছুতেই লাঠিটা পড়ছে নির্ধারিত বা সীমিত বা অনানুষ্ঠানিক আয়ের মধ্য ও নিম্ন মধ্যবিত্তের মাথায়।

বিজ্ঞজনদের মতে, রাষ্ট্রের পুঁজিবাদী চরিত্রের জন্যই এটা ঘটেছে। পাকিস্তানি শাসনামলে উন্নতি হচ্ছিল পুঁজিবাদী ধারায়; সেই ধারাতেই স্বাধীন বাংলাদেশেও ধারাবাহিকভাবে যাঁরা রাষ্ট্রক্ষমতায় এসেছেন, তাঁরা সবাই ছিলেন জ্ঞাতে অথবা অজ্ঞাতে পুঁজিবাদে দীক্ষিত। ফলে পুঁজিবাদী উন্নয়নের যে নিয়ম, তার বাস্তবায়নই ঘটেছে। যত উন্নতি হয়েছে, ততই বেড়েছে বৈষম্য।

কথা তখন একটিই থাকে, বাড়তে থাকা অন্তহীন এই বৈষম্যের তাহলে শেষ কোথায়?


লেখক: চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট