অনু গল্প
নিউইয়র্কে এখন বসন্ত। গরম ও শীতের মাঝামাঝি বেশ মিষ্টি একটা আমেজ প্রকৃতিতে। আশার কথা হলো, বর্তমানে নিউইয়র্কে করোনায় মৃত্যু ও সংক্রমণের হারও সহনীয় পর্যায়ে নেমে এসেছে। অন্যদিকে ভারত ও বাংলাদেশের করোনা পরিস্থিতি এই মুহূর্তে ভয়াবহ। আক্রান্তের সংখ্যা ও মৃত্যুহার ঊর্ধ্বমুখী। করোনা মহামারিতে সারা বিশ্বের সব মানুষের জীবনই কম বেশি বিপর্যস্ত। মহামারির কবলে পড়ে বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতি জগতেও নেমে এসেছে বিরাট ধস। ইতিমধ্যেই আমরা হারিয়েছি অনেককেই। চলে গেছেন অনেক আলোকিত, মেধাবী মুখ। তাঁদের যোগ্য উত্তরসূরি হতে হবে আমাদেরই, যারা এখনো বেঁচে আছি। তাই আসুন, বেশি বেশি বই পড়ি, সাহিত্য-চর্চা করি। আলোকিত মানুষ গড়ি। আমাদের এতটুকু প্রেরণা যদি অন্য কাউকে খানিকটা হলেও অনুপ্রাণিত করে তাহলে সেই আনন্দের কোনো সীমা নেই। শুভকামনা সবার জন্য।—শেলী জামান খান
একটি চেয়ার, ব্যালকনি আর রঙ্গন গাছ
অর্ঘ্য রায় চৌধুরী
ব্যালকনির শেষ প্রান্তে একটি চেয়ার। নিস্তব্ধতা এখানে বাঙ্ময়। ব্যালকনি ও চেয়ারটির সখ্যর সাক্ষী পাশের রঙ্গন ফুলের গাছটি।
এই বাড়িতে বাসিন্দা মাত্র দুজন। বৃদ্ধ! তাঁদের একমাত্র সন্তান বিদেশে থাকে।
চেয়ারটি রাত্রি হলে ব্যালকনির কাছে ঘন হয়ে বসে। এ বাড়ির অতীত গৌরবের কথা আলোচিত হয়। রাত্রির বাতাসে মিশে যায় তাদের অস্ফুট স্বর। কেউ জানতেও পারে না, এই দুটি নিষ্প্রাণ সখার সুনিবিড় আলাপের কথা।
চেয়ারটি ফাঁকাই পড়ে থাকে। ব্যালকনিতেও কেউ আর আসে না। শুধু রঙ্গন গাছটি তাদের কাছে দুই একটি ফুল পাঠায়। হাওয়া এসে দুদণ্ড চেয়ারে বসে যায়। তারা চায় ব্যালকনিতে কেউ আসুক, চেয়ারে এসে কেউ বসুক।
এসেছিল, একদিন এক প্রমোটার খুঁটিয়ে দেখে গেল সব। বাড়ির বাসিন্দারা সন্তানের কাছে চলে যাবেন। বাড়িটি ভাঙা পড়ল। চেয়ারটির জায়গা হলো ধ্বংসস্তূপের মধ্যে। মাথা গুঁজে পড়ে থাকে আহত চেয়ার। ব্যালকনিটির দেহাবশেষ ছড়িয়ে থাকে, রঙ্গন গাছটি কাটা পড়ে।
চেয়ারটির ঠিকানা বদল হলো। এক ফুটপাতবাসী চেয়ারটিকে তুলে নিয়ে যায়। সেখানে প্রায়ই কেউ না কেউ এসে বসে, নানা কথা হয়। শিশুরা চেয়ারটিকে নিয়ে খেলা করে।
শুধু কিছু রাতে, একটা রঙ্গন ফুলের গাছ চেয়ারটির পা বেয়ে উঠে আসে। একটা ফুটপাত ব্যালকনি হয়ে জেগে ওঠে। ঘুমন্ত কোনো শিশু মাঝরাতে ঘুম ভেঙে দেখে, চেয়ারটি তাদের পরিচিত চেয়ার আর নেই। সে যেন ময়ূরপঙ্খী হয়ে ভেসে চলেছে, তার মাথায় রঙ্গন ফুলের মুকুট।
ডিম-ভাত
শুচিস্মিতা চক্রবর্তী
ঢং ঢং ঢং ঢং...মিড-ডে মিলের এই ঘণ্টার আওয়াজের থেকে মধুর ধ্বনি বোধ হয় আর কিছু নেই বুধনের কাছে। মায়ে-পোয়ে মিলে মোট দুটি ডিম। ওর মা মালতী আর বেণু মাসি মিলেই তো মিল রাঁধে। দুপুরে একটা ডিমই অর্ধেক করে দুজনে খায়। আরেকটা ডিম ছোট্ট টিফিন বাটি করে মা বাড়ি নিয়ে চলে আসে। রাতে বাবার অর্ধেক আর ওর অর্ধেক। দুবেলা ডিম দিয়ে এক থালা করে ভাত উঠে যায়। নিজেকে ‘রাজা’ মনে হয় বুধনের।
বছরখানেকের বেশি হয়ে গেল স্কুল বন্ধ। মাঝে মাঝে মাস্টাররা এসে অল্প কিছু চাল আলু দেয় বটে তবে ডিম দেয় না! সেই ধোঁয়া ওঠা ভাত আর মায়ের হাতের টকটকে লাল রঙের ডিমের ঝোল কত দিন খায়নি বুধন। বাবার সিকিউরিটির কাজটাও যে আর নেই। কিছু সবজি নিয়ে পাড়ায় পাড়ায় ফেরি করছে বাবা। অচেনা লোকের কাছে মানুষ কিছু কিনতে চায় না। বাজারে বসলে নাকি টাকা দিতে হয়। এক বেলা কোনোমতে শাক-আলু সেদ্ধ দিয়ে চলে যাচ্ছে। কিন্তু ডিম-ভাতের সেই স্বাদ ভুলতে বসেছে বুধন।
মা সকাল সকাল স্নান সেরে পরিপাটি হয়ে স্কুলে রওনা দিয়েছে। বাইরে থেকে নাকি বাবুরা আসবে। মাকে রান্না করতে হবে; ডিম-ভাত। আজ স্কুলে ভোট। বাবাও সারা দিন সেখানে কী সব পার্টির কাজ করবে। কিছু পয়সা পাবে। মা মাথায় হাত বুলিয়ে বুধনকে বলে গেছে, ‘দুপুরের দিকে এক ফাঁকে চলি আসবি বুধু, এত বড় কাজ, একটা-দুটো ডিম বেশি থাকবে লিচ্চয়।’
করপোরেশনের কলে বারোটার জল এলে, নিজেই মাথা ধুয়ে, গা মুছে স্কুলের জামাটা গলিয়ে নেয় বুধন। নাই বা হলো কেলাস, স্কুলে তো যাচ্ছে। দূর থেকে সেই চেনা ডিমের ঝোলের গন্ধটা নাকে আসছে। পেটটা খিদেয় মোচড় দিয়ে ওঠে। তাড়াতাড়ি পা চালায় বুধন।
হঠাৎ কী সব গোলমাল, হইচই শুরু হয়ে যায়। ‘গুড়ুম গুড়ুম’!
ভোট দিতে আসা লোকজনের ছোটাছুটি শুরু হয়ে যায়। বুধিয়া দৌড়ে পেছন দিক দিয়ে মায়ের রান্নার জায়গাটিতে পৌঁছায়। গনগনে আঁচ থেকে সদ্য নামানো ডিমের ঝোলের মস্ত কড়াই। টকটকে লাল। তখনো একটু একটু ফুট ফুট করে ফুটছে। কিছুটা দূরেই বাবার নিথর দেহটা পড়ে। জামা আর মাটিটা লাল রক্তে ভেসে যাচ্ছে।
বুধন কিছুতেই ঠিক করতে পারছে না কোনটায় আগে ঝাঁপিয়ে পড়া উচিত!
আধখানা চাঁদ ও রহস্যময়ী নারী
শুক্লা গাঙ্গুলি
ব্যালকনিতে কাক এসে বসলেই অতসী তেড়ে উড়িয়ে দেয়। কবে কখন এদের স্বজাতি একটি চামচ নিয়ে পালিয়েছে তার। তাই এই বিরূপতা। পুরো সেট নষ্ট ওই একটি চামচের জন্য।
চৈত্রের অলস দুপুর। মেয়ে রুনুর বিয়ে হয়ে যাওয়ায় সে এখন একা। সরকারি চাকরির পাট নিজেই চুকিয়েছে। স্বেচ্ছাবসর নিয়েছে গত বছর। লেখালেখিতেই সময় কাটে এখন। একটা উপন্যাসে হাত দিয়েছে গত দুই মাস হলো। আজ যেমন করে হোক শেষটা লিখতেই হবে। তারপর উপন্যাসের নামকরণ।
মাধবী সেন বাচ্চাদের স্কুল চালান দাপটে। গোয়েন্দা প্রধান দীনেশ ঠাকুর তাঁকে নিয়ে শালডুংরির ফরেস্ট ডাকবাংলোতে। ঝিরঝির বৃষ্টি বাইরে। দুই পেগ হুইস্কি, গরম পাকোড়া আর বিনয় মজুমদারের কবিতা-বেশ জমেছে। বহু পুরোনো এক সকালের হিসেব মেলাতে হবে ঠান্ডা মাথায়।
২৫ বছর আগের সেই সকাল, আদিবাসী মেয়েটি হঠাৎ রক্তবমি করল মাধবীর ঘরের মেঝেতে। কাছেই সরকারি হাসপাতালের ডাক্তার কিরণময় সেখানে উপস্থিত। কালো পাথরের মতো অষ্টাদশীকে সারিয়ে তুলে মাধবীর প্রেমে হাবুডুবু। কিছুদিনের লিভ টুগেদার। মাধবীর বিবাহ নামক আইনে বিশ্বাস নেই। এরপর বছর দেড়েকের মাথায় ডাক্তার অসুস্থ হয়ে ফিরে যায় তার ১৭ বছরের পুরোনো সংসারে। আদর্শ স্ত্রী রঞ্জনা তার লাট খাওয়া সংসারে ডাক্তার স্বামীর সই জাল করে সংসার মসৃণ করার চেষ্টায় পৃষ্ঠাজুড়ে কলমের দাগ কাটে। ব্যাংকের ক্যাশিয়ারের চোখে নিজেকে আবিষ্কার করিয়ে গলবস্ত্র হয় আয়নায়।
কতটা লিখলে উপন্যাসটা পাঠক নেবে, ভাবতে থাকে অতসী মল্লিক। হঠাৎ দরজায় বেল বাজে সশব্দে। এই পড়ন্ত বেলায় অসময়ে কে এল। নব ঘুরিয়ে দরজা টানতেই সামনে ডা. কিরণময়। হুইল চেয়ারে। সঙ্গে দুজন পুলিশ অফিসার।
—ম্যাডাম সই জালিয়াতির অপরাধে আপনাকে গ্রেপ্তার করা হলো, থানায় চলুন!
টান
সৈয়দ নূরুল আলম
ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন। জামিলা খাতুনের নিশ্বাস এইমাত্র বের হয়ে গেল। এত সময় যারা জামিলা খাতুনকে ঘিরে রেখেছিল, তারা সবাই কেঁদে উঠল। কেউ শব্দ করে। কেউ নীরবে।
বাদশা কাঁদল না। শুধু মায়ের মুখের দিকে অপলক চেয়ে রইল। পেছন থেকে বাদশার বড় চাচি আয়শা বেগম এসে বলল, ‘বাবা তোমার জন্য এত সময় নিশ্বাসটা যায়নি। তুমি আইসে এক নজর দেখার পর চইলে গেল।’
বাদশা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা দিতে গিয়েছিল। তিন দিন আগে যখন বাড়ি থেকে যায়, তখনো মায়ের অবস্থা খারাপ ছিল। বাদশা পরীক্ষা দিতে চায়নি। বড় চাচা রহমান সাহেব জোর করে পাঠিয়েছিলেন। বাদশার বাবা বেঁচে নেই। বাবা থাকলে এ কাজটা বাবা-ই করতেন। রহমান সাহেবের বড় মেয়ে রানু, সেও চাচ্ছিল, বাদশা ঢাকা গিয়ে ভর্তি পরীক্ষাটা দিক।
বাবর মাথা নিচু করে বলে, জরুরি একটা সংবাদ নিয়ে এসেছি।
—কী সংবাদ? বাদশা ব্যাকুল হয়ে জানতে চায়।
বাবর সেই একইভাবে মাথা নিচু করে বলে, ‘চাচির অবস্থা ভালো না।
—ভালো না মানে? বেঁচে আছে তো!
—বেঁচে আছে। তবে অবস্থা খারাপ।
—সত্যি করে বল। তুই মিথ্যা বলছিস না তো। মা বেঁচে আছে তো?
—মিথ্যা বলব কেন? রহমান চাচা বলল, ছেলেটাকে জোড় করে ঢাকা পাঠালাম। এখন ওর মার যদি কিছু হয়, আমি ওরে কী জবাব দেব। তুই যা, ওকে নিয়ে আয়। তাই আসা।
রহমান চাচা মসজিদ থেকে ফজরের নামাজ পড়ে এসে, বাদশাকে দেখে অবাক হয়। বিস্ময় ভরা মুখে বলে, ‘তুমি কখন আসলে? কে খবর দিল? এসে মুখে পানি দিতে পারছ?’
পাশ থেকে রানু বলে, ‘হ্যাঁ বাবা, দিতে পেরেছে। যেই এক চামচ পানি দিল, আর দমটা গেল।’ এ কথা বলে, রানু দ্বিতীয় দফায় হাউমাউ করে কেঁদে ওঠে।
চাচা রানুকে সান্ত্বনা দিয়ে বলে, ‘কাঁদিস না মা। কেঁদে আর কী হবে। আমি যাই বাবরকে খবর দিই, বাড়ি থেকে আসার সময়, বাজার থেকে যেন কাফনের কাপড় নিয়ে আসে।’
চাচার কথা শুনে বাদশা অবাক হয়, এখানে বাবর আসবে কীভাবে!
স্বামীহারা
মঈনুল হীরা
বউমা!
জি বাবা!
ইফতার তৈরি করার আগে তুমার শাশুড়িকে জিজ্ঞাসা করে নেবে। সে তোমার থেকে অভিজ্ঞ, তাকে জিজ্ঞেস না করে ইফতার তৈরি করবে না।
বিব্রত সাবিনা শাশুড়ির কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করে, আম্মা ইফতারিতে কী রান্না করব?
শাশুড়ি অনেকটা রাগী চেহারা নিয়ে বললেন, খিচুড়ি রান্না কর। আমরা মানুষ বেশি, দুই কেজি চাল দেবে।
ইফতারের দুই কেজি চালের রান্না করা খিচুড়ি সবাই খেয়ে শেষ করতে পারে না৷ তাই দেখে সাবিনা চিন্তায় পড়ে যায়। শ্বশুর নামাজ শেষে এসে সবার সামনে সাবিনাকে ধমক দিতে থাকেন। ‘এত অপচয়, এত অপচয়! এত অপচয় কোনোভাবেই সহ্য করা হবে না।’
সাবিনার শাশুড়ি সামনেই দাঁড়ানো ছিলেন। ছেলের বউকে বকাবকি করলে শাশুড়ি কেন যেন এক ধরনের আনন্দ পান। সাবিনা কিছু বলার আগেই বাড়ির সবাই তার দিকে বিরক্ত চোখে তাকাতে শুরু করে। বকাবকি করতে কেউ ছাড় দেয় না।
সাবিনা চোখের জল গোপন করতে দৌড়ে নিজের ঘরে চলে যায়। যে মানুষটাকে অবলম্বন করে এই বাড়িতে সে এসেছিল, আজ সে পাশে নেই। বাড়িতে সবাই থাকলেও আজ কেউ তার পাশে নেই।
স্বামীর শার্ট বুকে নিয়ে নিঃশব্দে কাঁদে স্বামীহারা বউটি। যে কান্না দেখার কেউ নেই।
অন্য ভুবনের টার্মিনাস
রুবানা ফারাহ আদিবা
বেশ একটা সুরেলা আমেজ ফ্লোরজুড়ে। ফুরফুরে মেজাজে কেউ গুনগুন করছে প্রিয় সুর, কেউ শেষবারের মতো মিলিয়ে নিচ্ছে গ্রোসারি তালিকা। যারা একটু বেশি সাবধানী তারা কাউকে ফোন করে জেনে নিচ্ছে আরও কিছু লাগবে কিনা। নোভার বেশ সময় কেটে যায় এখানে এলে, সঙ্গের কাজটিও বেশ উপভোগ করে। পুরো সপ্তাহজুড়ে চলে এর প্রস্তুতি। ডিসকাউন্ট কুপনগুলো কাঁচি দিয়ে কেটে ক্যাটাগরি অনুযায়ী সাজিয়ে রাখে সে। না, অভাবের সংসার নয়। তবে স্বাচ্ছন্দ্যের জন্য কিছুটা ঝক্কি পুষিয়ে নিতে হয়। কমলালেবুর স্তূপ থেকে চারটি কমলা, লাল টুকটুকে দুটি ডালিম, মেয়ের জন্য কিছু বেবি ফুড এসব সাজিয়ে রাখে ট্রলিতে।
রান্নাঘরের সিঙ্ক থেকে টুপটুপ করে পানি পড়ছে গত সপ্তাহ থেকে। দুটি সুগন্ধী মোমবাতিতে হাত দিয়েও সরিয়ে নিল হাত। সামনের মাসে সিঙ্কটা ঠিক করতেই হবে বলে কৃচ্ছ্বতা ব্রত চলছে। গুনে গুনে হিসেব করে কিছু সবজি তুলে নেয়। পারসোনাল আইটেমের আইল ঘুরে পছন্দের লোশন, শ্যাম্পু ইত্যাদি দেখতে দেখতে একটা ছোটখাটো উইন্ডো শপিং হয়ে যায়।
ট্রলি নিয়ে পেমেন্ট লাইনে অপেক্ষারত নোভার চোখ পড়ে যায় কনসেশন স্ট্যান্ডগুলোর দিকে। থরে থরে সাজানো রয়েছে ‘Lifestyle’ ম্যাগাজিন। সুসজ্জিত পোশাকে সব মডেলের জীবন নিয়ে একটি ঝকঝকে পত্রিকা। পাতা ওলটাতে ওলটাতে একটা চোখ ধাঁধানো আলো এসে লাগে নোভার চোখে মুখে।
এই মুহূর্তে নোভা দাঁড়িয়ে আছে একটি বিলাসবহুল কিচেনে। দামি মার্বেল পাথরের চকচকে মেঝে। চতুর্দিকে আভিজাত্যের ছাপ সুস্পষ্ট। কিচেন কাউন্টারে পড়ে আছে একটি সুদৃশ্য পত্রিকা ‘Lifestyle’—কভার পেজে নোভার গ্ল্যামারাস ছবি। কিন্তু, প্রকাশিত সংখ্যাটিতে যে বছর এবং তারিখ দেখাচ্ছে তা একটা অন্য সময়কাল। দূর থেকে যেন ভেসে আসছে পিয়ানোর সুর। কনটেমপোরারি সুসজ্জিত ক্যাবিনেট, কাউন্টার। হালফ্যাশনের মেটালিক সিঙ্ক। ছোট্ট একটা ফটোফ্রেমে নোভা ও অপরিচিত একজন পুরুষের অন্তরঙ্গ ছবি। তবে কী...!
বহুদূর থেকে যেন নোভাকে কেউ ডেকে চলেছে, ক্যাশিয়ার ‘এক্সকিউজ মি, এক্সকিউজ মি...’ বলে হাত পা নাড়িয়ে কিছু বলার চেষ্টা করছে। পেছনের কাস্টমাররাও যেন বিরক্ত। নোভা নিজেকে সামলে নিয়ে ট্রলির জিনিসগুলো তুলে দেয় বেল্টের ওপর। ট্রলির কাছে, দোমড়ানো মোচড়ানো একটি পৃষ্ঠা। একটি সুদৃশ্য কিচেন যেখানে একটু আগেই নোভা দাঁড়িয়েছিল।
স্রষ্টার প্রতিজ্ঞা
হাসান মাহমুদ
এক ছেলের মা মারা গেছে। সে কেবলই কাঁদছে, লোকজন তাকে সান্ত্বনা দিচ্ছে, তবু সে থামছে না। স্রষ্টা বললেন—
‘আমি স্রষ্টা। তুমি এত কাঁদছ কেন?’
ছেলেটি কেঁদে উঠে বলল—‘আমার মা মরে গেছে!’
‘সবারই একদিন মা মারা যায়। কষ্টটা সারা জীবন থাকে কিন্তু সবাই কিছুদিন কেঁদে সামলিয়ে নেয়।’
ছেলেটি কেঁদে বলল, ‘সকালে বন্ধুরা কীভাবে ঘুম থেকে ওঠে আর আমি কীভাবে উঠি, তুমি জানো না?
স্রষ্টা বললেন—আমি জানি। কী পেলে তুমি থামবে বল?
—যা চাইব দেবে?
—দেব।
—প্রতিজ্ঞা কর দেবে?
—প্রতিজ্ঞা করছি দেব।
—আমার মাকে ফিরিয়ে দাও।
স্রষ্টা বললেন—আচ্ছা দেব। এখন শোনো। সবাই মৃত মাকে ফিরে পেতে চায়। তোমাকে যদি দিই তবে সবাইকে দিতে হবে, তাই না!
—হ্যাঁ।
—সেই মায়েরাও তাদের মা চাইবে, আমাকে সেটাও দিতে হবে। এভাবে সৃষ্টির প্রথম থেকে সব মা ফিরে আসবে, তাই না!
—হ্যাঁ।
—এত লোক নিশ্বাস নিলে বাতাস ফুরিয়ে যাবে, দাঁড়ানোরও জায়গা থাকবে না। সবাই মরে পচে গিয়ে দুনিয়াটা বিষাক্ত করে দেবে, তাই না?
ছেলেটা ডুকরে কেঁদে উঠে বলল—‘জানি না। আমি কিছু জানি না। আমার মাকে ফিরিয়ে দাও, তুমি প্রতিজ্ঞা করেছ।
স্রষ্টা হেসে বললেন—কালও যদি তুমি চাও তবে আমি নিশ্চয়ই তোমার মাকে ফিরিয়ে দেব। এখন বাসায় গিয়ে পড়ে দেখ সুরা বনী ইসরাঈল, আয়াত ২৪। আমি কাল আবার আসব।
স্রষ্টা অদৃশ্য হলেন, ছেলেটি বাসায় গিয়ে অজু করে খুলল সুরা বনী ইসরাঈল, আয়াত ২৪।
পরদিন স্রষ্টা এলেন। বললেন—তুমি মনস্থির করেছ?
—হ্যাঁ।
—বলো, আমি শুনছি।
ছেলেটি গভীর স্বরে উচ্চারণ করল—‘হে আমার পালনকর্তা! আমার শিশুকালে তাঁরা যেভাবে আমার যত্ন নিয়েছিলেন সেভাবে তাঁদের প্রতি রহম করো।’
স্রষ্টা হেসে বললেন—আমি তার চেয়েও অনেক বেশি আদরে তোমার মাকে রাখব।
—সত্যি রাখবে?
—সত্যি রাখব, প্রতিজ্ঞা করছি। আর, তোমার মায়ের সব ভুল ত্রুটি আমি মাফ করে দিলাম, তুমি শান্ত হও।
ছেলেটি শান্ত হলো।
স্রষ্টা অদৃশ্য হলেন।