অনু গল্প

দেখতে দেখতে অনুগল্প পাতার দুই বছর হতে চলল। সময়ের হিসেবে বয়স বেড়েছে ঠিকই, কিন্তু আদৌ কী আমরা অনুগল্পের বর্ণ, গন্ধ, স্বাদ বুঝতে পেরেছি?

শুরুতে ভেবেছিলাম, শুধু প্রতি মাসে একটার পর একটা সংখ্যা করাতেই এই পাতাটি সীমাবদ্ধ থাকবে না। আশা ছিল, এই অনুগল্প প্রকাশের মধ্য দিয়ে আমরা অনুগল্পের একদল গল্পকার এবং আগ্রহী পাঠক শ্রেণি গড়ে তুলতে সক্ষম হব।

কিন্তু দিন শেষে প্রাপ্তির ঘরে অনেকগুলো গল্প জমলেও সেগুলো আদৌ অনুগল্প হয়ে উঠছে কিনা সেটাও জানার বা ভাববার বিষয়। এ ক্ষেত্রে জহুরি গল্পকারের মতোই পাঠক, সমালোচক ও গল্প বিশ্লেষক প্রয়োজন। আমরা সেই অতি-উৎসাহী গল্পকারদের সন্ধানে। যারা সোনার কলম হাতে অনুগল্পের জন্ম, আঁতুড়ঘর, নাড়ি-নক্ষত্র ঘেঁটে নিরলসভাবে যথার্থ অনুগল্প লিখবেন। আমরা নিবিষ্ট পাঠকের খোঁজে। যারা আমাদের অনুগল্প পড়ে তাঁদের সুচিন্তিত মতামত জানাবেন।—শেলী জামান খান

বৈধ হনন

মোস্তফা তানিম

দুটি সুন্দর পাখি ঘরের ঘুলঘুলিতে বাসা বেঁধেছিল। ছোট দুটি ছানাও হয়েছে। বাচ্চা দুটি চুই-চুই করে ডাকে। মা পাখিটা সারা দিন কিচিরমিচির শব্দে কোত্থেকে খুঁজে খাবার নিয়ে এসে ফুড়ুৎ করে সেখানে ঢোকে। খাবার পেয়ে বাচ্চারা চুপ করে যায়। বাবা পাখিটা আরও কিছু খড়কুটো নিয়ে আসে। সারাটা রাত তারা ঘুমায়, কোনো শব্দ করে না। ভালোই সুখের সংসার পেতেছে।

একদিন সকালে তাদের সংসারের দৈনন্দিন চেঁচামেচি শোনা গেল না। দুটি পাখির কোনোটাই গাছের ডালে বা রেলিংয়ে এসে বসল না। ছানাদের কুঁই-কুঁই ডাকও নেই।

বেলা এগারোটার দিকে শোভন বাবার সঙ্গে অনুসন্ধানে বেরিয়ে এল। একটু খুঁজতেই দেখা গেল নিচে, ঘাসের ওপর ওদের পালক স্তূপ হয়ে পড়ে আছে। বাবা আফসোস করে বললেন, ‘কী নিষ্ঠুর, কোন ভক্ষক প্রাণী পাখি দুটিকে খেয়ে ফেলল রে?’

ওপরে ভেন্টিলেটরের ফাঁকে তাকালেন তিনি। লন্ডভন্ড বাড়ির মতো খড়কুটো বেশি করে বেরিয়ে আছে। কিছু নিচেও পড়েছে। ‘ছানা দুটি হয়তো খিদেয় মরে গেছে। অথবা...’ আশঙ্কাটা তিনি আর বললেন না। তাঁকে বিষাদগ্রস্ত লাগছে।

একটু দূরে, বরই গাছের নিচে কিছু হাঁসের পালক। নিশ্চয়ই বুয়ার কাজ। কাল যে হাঁস দুটি কিনে আনা হয়েছিল, তাদের লোম ছাড়ানোর পর, সেসব ময়লার ঝুড়িতে না ফেলে ওদিকে ফেলে রেখেছে। শোভন একবার এদিকে তাকায়, আরেকবার ওদিকে। হঠাৎ কী মনে হতেই সে বরই গাছটার দিকে আঙুল দেখিয়ে প্রায় আর্তনাদ করে বলল, ‘বাবা!’

ছেলের দৃষ্টি অনুসরণ করে রহমান সাহেব ভাবলেন, দুটি সম্পূর্ণ ভিন্ন ব্যাপার। বিষয়টা ছেলেকে বোঝানোর জন্য মুখ খুলবেন, তখন চকিতে কেন যেন মনে হলো, দুটিই আসলে এক।

তিনি কিছু বলতে গিয়েও বলতে পারলেন না। বিদ্যুৎ চমকের মতো কী একটা তীব্র সত্য পরিষ্কার হয়ে দেখা দিল। সেটা আবার পাখিতেই থামল না। রহমান সাহেব বিস্ফারিত চোখে সামনের বরই গাছটার নিচে একগাদা ছেঁড়া পালকের দিকে তাকিয়ে থাকলেন।

আলো

শুচিস্মিতা চক্রবর্তী

প্রায় চার বছর হতে চলল অভিজিৎ আর অমৃতা গাঁটছড়া বেঁধেছে। উদারচেতা, পরোপকারী, সংস্কারমুক্ত অভিজিৎ যেদিন ছোট্ট মুনিয়া সমেত অমৃতাকে ঘরে এনে তুলেছিল, তার মা-বাবার মনে ছিল হাজারটা প্রশ্ন। চাল চুলোহীন, বংশ পরিচয়হীন, অজ্ঞাত বাচ্চাসহ কোনো মহিলাকে এক কাপড়ে ঘরে তোলার কোনো ইচ্ছেই দুজনের ছিল না। শুধু অভিজিতের জন্যই কিছুদিনের আশ্রয় দিতে তাঁরা রাজি হয়েছিলেন।

রাস্তা-ঘাটে, বাজারে-দোকানে, পাড়া প্রতিবেশীর কুট কাচালি আর প্রশ্নের ঠেলায় প্রাণ ওষ্ঠাগত হয়ে উঠেছিল। সমাজ যখন কেবল মনুষ্যত্ব ছেড়ে কোনো সম্পর্ককে একটা নামে বাধতেই চায়, অভিজিৎও তৎক্ষণাৎ সিদ্ধান্ত নিয়ে অমৃতাকে বিয়ে করে, মুনিয়াকে দত্তক নেয়। সমাজের হাজারো বাঁকা হাসি, অভিজিতের মা-বাবার ঠারেঠোরে নানা অপমানেও অমৃতা কেবল অভিজিতের দেওয়া সম্মান আর ভালোবাসার খাতিরে মানিয়ে চলেছিল।

ভুলতে বসেছিল তার পঙ্কিল, অন্ধকারাচ্ছন্ন অতীতের কথা। সেই এঁদো গলির ছোট্ট খুপরি-ঘর, যেখানে রাতের পর রাত তার এই শরীরটাকে বহুজনে ভোগ করেছে। কতবার এই কলুষিত জীবনটা শেষ করে দিতে চেয়েছে, পারেনি। কেবল মুনিয়ার মুখ চেয়ে। কিন্তু যেদিন ছোট্ট মুনিয়ার ভবিষ্যতেও নেমে এসেছিল তার জীবনের অন্ধকার, সেদিন আর স্থির থাকতে পারেনি। সেদিন লুটিয়ে পড়েছিল অভিজিতের পায়ে। একটু আশ্রয়ের জন্য। কিন্তু পুরোনো অতীত ঘা হয়ে অভিজিতের বাবা-মার সামনে ফিরে এল।

‘বংশ পরিচয়হীন, অনাথ তাও ঠিক ছিল। কিন্তু তাই বলে বেশ‍্যা!’

অভিজিতের মা কষিয়ে দিয়েছিলেন এক চড়।

‘শেষে এভাবে ঠকালে আমাদের? কী করে মুখ দেখাব সমাজে? দূর হয়ে যাও তোমরা এই মুহূর্তে।’

‘ওনাকে তাড়াবেন না মা। উনি আমাদের ভগবান। আমাদের মতো অভাগীর বাচ্চাদের শিক্ষা আর স্বাস্থ্যের জন্য উনি প্রাণপাত করেন। ওনার কোনো দোষ নেই; আমিই ওনাকে আশ্রয়ের কথা বলেছিলাম। না হলে যে মুনিয়াকে বাঁচাতে পারতাম না। বহুজনের কুনজর পড়েছিল। আমি চলে যাচ্ছি, শুধু মুনিয়াকে একটু থাকতে দিন। ওই অভিশপ্ত জীবনের অন্ধকারে ওকে যেন ঠেলে দেবেন না। ও অন্তত পড়াশোনা করে নিজের পায়ে দাঁড়াক। ওর জীবনটা আলোময় হোক।’

—‘আমরা জানি, সমাজের পিছিয়ে পড়া, দরিদ্র অনেকের জন্য অভি অনেক কিছু করে। ওর স্বাধীনতায় আমরা কোনো দিন হস্তক্ষেপ করিনি। ওর মন অনেক উদার। তবে সত্যটা তোমাদের আগেই বলা উচিত ছিল। প্রকৃত শিক্ষা যে আমাদেরও দরকার। মুনিয়া পড়বে, নিশ্চয়ই পড়বে’- খুব ধীর কণ্ঠে কথাগুলো বললেন অভিজিতের বাবা।

অভিজিৎ মায়ের পায়ে লুটিয়ে পড়লে, আঁচলে চোখ মুছলেন অভিজিতের মা। বললেন, ‘তোমরা ভেতরে এসো। অভি আমার অন্ধ চোখে আলো ফিরিয়েছে। এবার অন্তরটাও আলোকিত হোক।’

ভোর

রুবানা ফারাহ

ব্যালকনিতে একটার পর একটা সিগারেট শেষ করছে অর্পণ। অস্থির হয়ে আছে ভেতরে-ভেতরে। শেষ পর্যন্ত মা যে ওকে এমন একটা পরিস্থিতির মধ্যে ফেলবে ভাবতেও পারেনি। এমন অবস্থায় তার স্ত্রী সুমনাও পাশে নেই।

স্কুল থেকে সেদিন ফিরে জামা কাপড় পাল্টাতে পাল্টাতেই বাবার গাড়ির আওয়াজ পেয়ে বারান্দায় ছুটে যায় অর্পণ। ড্রাইভার মাকে কিছু বলছিল, ওর কথাগুলো শুনতে না পেলেও অর্পণ বুঝেছিল, ভীষণ রকম বিপদ হয়েছে। দুলিখালা জোর করে রাতের খাবার খাইয়ে তাকে বিছানায় শুইয়ে দিয়েছিল। এক সময় চোখও লেগে এসেছিল। কত রাত হয়েছিল, আজ তা মনে করতে পারে না অর্পণ। মার কান্নায় ঘুম ভেঙে যায়। এরপরের ঘটনাগুলো ছিল দুঃস্বপ্নের মতো।

হঠাৎ করে অর্পণ যেন অনেকটাই বড় হয়ে যায়। নানা বাড়িতে বিরক্তি আর দয়া দাক্ষিণ্যে বেড়ে ওঠে অর্পণ। মা এনজিওতে চাকরি শুরু করেছে। মাকে বাড়িতে নামিয়ে দিয়ে যেত একজন সহকর্মী। দীর্ঘদেহী সুঠাম সুদর্শন এক ভদ্রলোক। অর্পণের কিশোর মনে জমে উঠেছিল অভিমানের চর। ধীরে ধীরে অসহিষ্ণু হয়ে উঠেছিল অর্পণ। খিটিমিটি লেগেই থাকত। মা কারণটা আঁচ করতে পেরেছিলেন। আশ্বস্ত করতে চেষ্টা করেছিলেন অর্পণকে। কিন্তু ওদের সহজ বন্ধুত্বকে সে মেনে নিতে পারেনি। এরপর, মার জীবনে আর কোনো দ্বিতীয় পুরুষ আসেনি।

গত মাসে, সুমনা জানায় মার সঙ্গে দেখা হয়েছে হারিয়ে ফেলা এমন একজন বন্ধুর, যার সঙ্গে মায়ের জীবনটা হয়তো জুড়তে পারত। কিন্তু, নানাজানের প্রবল আপত্তিতে সম্পর্কটার সমাপ্তি হয়।

আজ সব দায়িত্ব শেষে মা নিজেকে নিয়ে ভাবতে চায়। সিদ্ধান্ত নিয়েছে বাকি জীবনটা তারা এক সঙ্গে থাকবে। সুমনা বন্ধুর মতো মায়ের পাশে দাঁড়িয়েছে। অর্পণ মায়ের পাশে বাবাকে ছাড়া আর কাউকেই ভাবতে পারছে না।

কিছুক্ষণ আগে মা চলে গেছে। অর্পণের বুকের ভেতরে জেগে উঠছে এক গহিন বন আর সে যেন একাকী এক ডাহুক পাখি। সুমনা নিঃশব্দে ব্যালকনিতে এসে দাঁড়িয়েছে কখন। চোখে চোখ পড়তেই অর্পণের হাত মুঠোর মধ্যে সযত্নে জড়িয়ে নিল সুমনা। ফিসফিস করে বলল, ‘অর্পণ, আমার তুমি আছ, আমাদের জীবন আছে। মা সারা জীবন অন্যের জন্য বেঁচে ছিলেন। আজ মাকে মুক্ত করে দাও। সে তার বাকি জীবনটুকু নিজের জন্য বাঁচুক।’

রেফ্রিজারেটর

অর্ঘ্য রায় চৌধুরী

ফ্রিজটা ঘরের এক কোণে, ডাবল ডোর, গোদরেজ। সংকলন ফ্রিজটার সামনে দাঁড়াল। তারপর ঘরে ঢুকে একটা সিগারেট ধরিয়ে জানালাটা বন্ধ করে দিল।

সংকলন সমাদ্দার মায়ের সঙ্গে থাকে। উত্তর কলকাতার যদুনাথ দত্ত লেনে বাড়ি। সরকারি চাকরি করত, রিটায়ার্ড। বৈশাখী ছেড়ে যাওয়ার পর আর বিয়ে করেনি। মা-ই তার একমাত্র ধ্যান জ্ঞান। যদিও মায়ের কারণেই বৈশাখী সংকলনের সঙ্গে থাকতে পারেনি। ছোট থেকেই সংকলনের কাছে মা সবচেয়ে আগে। তাই মা যখন বলেছিল বৈশাখী মেয়েটা ভালো না, তখন থেকেই বৈশাখীর প্রতি সংকলনের একটা অনীহা কাজ করতে শুরু করে। যার ফলশ্রুতি ডিভোর্স।

মায়ের শরীরটা কয়েক দিন ধরে ভালো ছিল না। তাই চেষ্টা করেছে আজ একটু আরাম দিতে। রেফ্রিজারেটরটা নিজেই পরিষ্কার করেছে, ঘরে একটা ধূপ জ্বালিয়েছে। তারপর নিজেই রান্না করেছে। দুপুরে মাকে খাইয়ে নিজে খাবে। তারপর মাকে ঘুম পাড়িয়ে নিজেও শোবে।

তবে একটাই অসুবিধা। মা এখন ওই রেফ্রিজারেটরের ভেতর। বারবার ফ্রিজটা খুলে দেখতে হচ্ছে মায়ের কিছু লাগবে কিনা।

কাল রাতে মায়ের হঠাৎ জ্বর এল। জ্বর এতটাই বেড়ে গেল যে, ওষুধেও কাজ হলো না। এত রাতে ডাক্তার পাওয়াও মুশকিল। গাড়ি বের করতে করতেই মা নিথর হয়ে গিয়েছিল। ওষুধে জ্বর কমছে না দেখে সংকলন জ্বর কমানোর জন্য তাই মাকে রেফ্রিজারেটরে ঢুকিয়ে রেখেছে। এখন জ্বর নেই, মা ঘুমাচ্ছে। শুধু কাজের মেয়েটাকে কাল থেকে আসতে না করে দিতে হবে।

মাকে ছাড়া সংকলন এক মুহূর্তও থাকতে পারবে না।

কাঠি কাবাব

সোহানা নাজনীন

কুইন্স হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে সামনের ফুটপাথ লাগোয়া বাসস্টপে অপেক্ষা করছিল করবী। চারদিকে এপ্রিল মাসের দুপুর বারোটার রোদ। কিন্তু তাতে গা পোড়ানো তাপ নেই। মোবাইলে ট্রান্সপোর্টেশন অ্যাপসে দেখাচ্ছে কিউ-৬৫ বাসটা এখন কুড়ি মিনিট দূরে। কি আর করা! চারদিকে উঁকিঝুঁকি দিয়ে সবার অবস্থান দেখে নিচ্ছে করবী। যাত্রী ছাউনির নিচে বেশির ভাগ অপেক্ষমাণ যাত্রীই বয়স্ক, ডাক্তার দেখিয়ে হাসপাতাল থেকে বের হওয়া।

সামনে রেশমি চুলের দুই চায়নিজ বাচ্চা ছোটাছুটি খেলছে। তাদের মা মোবাইলে কথা বলায় ব্যস্ত। করবী নিজেও চার মাসের অন্তঃসত্ত্বা, আজকে সে জেনেছে তার মেয়ে হবে। সেই থেকেই তার মেজাজ ফুরফুরে, ক্ষণে ক্ষণে হাত বুলাচ্ছে পেটের ওপর, যেন মেয়েকে আদর করছে। করবীর চঞ্চল চোখ চলে গেছে আরও দূরে, একটা হালাল কাবাব স্ট্যান্ডের দিকে। মাংস পোড়া চনমনে গন্ধ ছাপিয়ে যে জিনিসটা করবীকে কৌতূহলী করেছে, তা হলো স্ট্যান্ডের সামনে দাঁড়ানো দুজন নারী। একজন ষাটোর্ধ্ব, পরনে সালোয়ার কামিজ, ছাইরঙা সোয়েটার, মাথায় সুতির ওড়না টেনে দেওয়া। আরেকজনের বয়স কম, জিনসের ওপরে টি-শার্ট আর পাতলা হুডি পরা, চোখে বড় রোদ চশমা। দুজনের হাতেই কাবাবের কাঠি, মাঝে মাঝে কাঠি থেকে কাবাবের টুকরো খুলে একে অন্যকে খাইয়ে দিচ্ছে। কী হতে পারে দুজনের সম্পর্ক? মা-মেয়ে, খালা-বোনঝি? আর যাই হোক বউ-শাশুড়ি হবে না। করবীর সন্দিহান মন অগোচরে হাঁটতে থাকে।

—মা, তাড়াতাড়ি খেয়ে নেন, একটু পরেই তো আপনার ছেলে কল দিয়ে খোঁজ করবে। এ ছাড়া রক্ত দিয়েছেন না আজকে।

—এইতো বউমা, তুমি কাবাবের কথা বলতে যেও না, রাস্তার ধারের খাবার খেয়েছি শুনলে বকবে।

যারপরনাই অবাক হয়ে বিস্ফোরিত নয়নে কথাগুলো শুনল করবী। এসব শুধু সাহিত্যে মানায়, কারও জীবনে অসম্ভব। শাশুড়ির ব্যবহার তাকে মায়ের অনুভূতির কাছাকাছিও যেতে দেয়নি কোনো দিন। আজ মনে পড়ল আমেরিকার ভিসা পেয়েই করবী জিগাতলায় ভাশুরের বাড়িতে গিয়েছিল। অসুস্থ শাশুড়িকে সালাম করতেই উনি মুখ ঘুরিয়ে বলেছিলেন, ‘এইবার আমার ছেলের ইনকামের টাকাগুলো তোমাকে পালতে পুষতেই শেষ হবে, উত্তরার বাড়িটা আর তোলা হবে না।’

পানি ভরা চোখে সামনে তাকাতেই অস্পষ্ট বাসটা নজরে এল করবীর।

হ্যালুসিনেশন

ফারহানা হোসেন

বহুদিন আগে এমন হয়েছিল, আজও একই অনুভূতি হলো। হয়তো একাকিত্বের কারণে এমন হচ্ছে। সারা ঘর খাঁ খাঁ করছে। বাইরে কনকনে ঠান্ডা। খুব বাজে লাগছে অন্ধকারে শুয়ে থাকতে। ঘরভর্তি লোবানের গন্ধ পাচ্ছি। তবে হ্যালুসিনেশন হচ্ছে বুঝতে পারছি। আমার প্রায়ই এমন হয়।

আজ বহুদিন পর আবার এই অনুভূতিটা হলো। শরীর জুড়ে প্রচণ্ড জ্বর। মাথা ভার। জ্বর হলেই ইদানীং আমার এমন হচ্ছে। জ্বরের ঘোরে লোবানের গন্ধ পাই। আগে ভাবতাম মনের কল্পনা। এখন মনে হয় সত্যি সত্যি পাই।

বেডসাইড টেবিলে ফোনটা বাজছে। অনেকক্ষণ ধরেই বাজছে। প্রচণ্ড অনিহা সত্ত্বেও ফোনটা তুলতে হলো। ওপারে সাগরের গমগমে কণ্ঠস্বর, ‘ময়না, কেমন আছিস দোস্ত?’

—ভালো নেইরে। খুব জ্বর।

—তাই বুঝি? আমিও ভালো নেই, বুঝলি। কিছুক্ষণ আগে একটা খুব বিপদ হলো।

সাগরের কথা শেষ না হতেই লাইনটা ডিসকানেক্ট হয়ে গেল। বহু চেষ্টা করেও আর ওকে ফোনে পাওয়া গেল না।

মনের ভেতর নানা প্রশ্নের উঁকিঝুঁকি। মাথা জুড়ে লাশের গন্ধ। তীব্র গন্ধটা যেন আমার পিছু ছাড়ছে না। ঝাঁজালো গন্ধ। আচ্ছা লাশের কি নিজস্ব কোনো গন্ধ আছে? মানুষ মরে গিয়ে কেবল লাশ হয়ে যায়। তার নামটা আর থাকে না। যে মানুষটার সঙ্গে আমি সারাক্ষণ ছিলাম, অথচ মরে গেলে বলবে, ‘এই তো লাশটা, এই ঘরে আছে।’

গন্ধটা তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে। না, আর পারা যাচ্ছে না। মাথা ব্যথাটা আবার বাড়ল। ডোরবেল বাজছে, কেউ এসেছে। এবার উঠতেই হবে।

—বাবু, তুমি এসেছ...বড্ড ভয় পেয়েছি জানো।

—একটা খুব খারাপ খবর আছে ময়না। সাগরের মারাত্মক একটা অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছে। স্পট ডেথ।

মায়া

মনিজা রহমান

‘ও খুব কষ্ট পাচ্ছে। আপনারা অনুমতি দিলে ওকে আমরা শুট করে মেরে ফেলতে চাই। আপনারা কী বলেন?’

রাত তখন আড়াইটার বেশি হবে। স্বামী ও দুই ছেলেকে নিয়ে নুসরাত মাত্র হাসপাতাল থেকে বাসায় ফিরেছে। সেই মুহূর্তে বড় ছেলের মোবাইলে হাসপাতাল থেকে ফোন এল। ওলি যে এখন জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে।

চার সদস্যের পরিবারের প্রত্যেকে যেখানে যে দাঁড়িয়ে বা বসেছিল ছবির মতো নির্বাক হয়ে গেল। কী উত্তর দেবে তারা ডাক্তারকে? প্রথমে হাউমাউ করে কান্নায় ভেঙে পড়ল নুসরাত। তারপর কেউ আর নিজেকে ধরে রাখতে পারল না। সারা বাড়িতে কান্নার রোল উঠল।

মাত্র তো এক সপ্তাহ আগে ওলি এসেছিল ওদের বাসায়। ব্রুকলিনের যে দোকান থেকে ওরা কিনেছিল ওকে, তারা একটি তথ্য কেন যেন ঠিকঠাকভাবে দেয়নি। আট সপ্তাহের আগে কোনো বাচ্চা বিক্রি করার নিয়ম নেই আমেরিকার কোথাও। মায়ের দুধ ঠিকভাবে না পেলে তো রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা সৃষ্টি হবে না।

অলির মাত্র ছয় সপ্তাহের বয়সের কচি শরীর ভ্যাকসিন নিতে পারল না। প্রথমে জ্বর, তারপর সারা দিন কিছু খায় না। অলিকে খাওয়ানোর জন্য চার সদস্যের পরিবারের চেষ্টার কমতি নেই। এমনকি নুসরাতের স্বামী কবির সব কাজ ফেলে ওলিকে কোলে নিয়ে দিনভর খাওয়ানোর চেষ্টা করে।

শেষ পর্যন্ত হাসপাতালে নেওয়ার পরে সিরিঞ্জের সাহায্যে ডাক্তাররা খাওয়ায় ওলিকে। ওই দিন ছিল ঈদের আগের দিন। সন্ধ্যার দিকে ডাক্তারেরা অবস্থার উন্নতির কথা জানাতেই নুসরাত স্বামীর সঙ্গে বাজারে ছুটল। শ্বশুরবাড়ির সবাই ঈদের সকালে বাসায় নাশতা খেতে আসবে। রাত জেগে রান্না করল নুসরাত।

দুপুরের দিকে মেহমানরা বিদায় নিলে কোথাও বেড়াতে না গিয়ে ওরা আগে ছুটল হাসপাতালে ওলিকে দেখতে। আসার আগে নুসরাতের মনে হলো, ওলি ছোট্ট হাতের আঙুল দিয়ে জড়িয়ে ধরল ওর একটি আঙুল। ওই শেষ স্পর্শ।

ঈদের দিন রাতে চিরতরে চলে গেল ওলি। ডাক্তারদের গুলি করার আগেই স্বাভাবিক মৃত্যু হলো ওর। হাসপাতালে নিয়ম অনুযায়ী, পোষা বিড়ালের শরীর পুড়িয়ে ছাই দিয়ে দেওয়া হয় পরিবারকে। নুসরাতরা ছাই না, ওলির মৃতদেহ নিয়ে এল বাসায়।

বাড়ির উঠানে ওলিকে কবর দিয়ে ওখানে একটা গাছের চারা লাগাল নুসরাত।