অনু গল্প

নিউইয়র্কে এখন বসন্ত। গ্রীষ্ম আসি আসি করছে। চারদিকে ফুলের রাজত্ব। কী তাদের রং! বাহারি রঙের সব ফুল। তেমনি বাহারি সব প্রজাপতি উড়ে উড়ে বেড়াচ্ছে ফুলের গায়ে। দক্ষিণা বাতাসে যেন প্রাণের ছোঁয়া। একটু একটু করে যেন প্রাণ ফিরে আসছে শহরটির। মহামারির প্রকোপে ঘুমিয়ে পড়া, ঝিমিয়ে পড়া শহরটি জেগে উঠছে। স্তূপ করা লাশের সমাধি হয়েছে। কিন্তু এখনো বড় ভীরু, বড় সচকিত জনগণ। মাস্ক খুলব না রাখব, নিরাপদ দূরত্ব মানব না আলিঙ্গন করব—এসব দ্বিধা এখনো কাটেনি।

একটা বড় ঝড় আসুক, চৈত্রের দাবদাহ আসুক, সব রোগ-শোক ধুয়ে যাক, মুছে যাক, পুড়ে ছারখার হোক অতিমারি। শুদ্ধ হোক, সুস্থ হয়ে উঠুক আমাদের এই বসুন্ধরা। আবারও প্রেম, ভালোবাসা, জীবনের নানা রং বদলের গল্প জমে উঠুক আমাদের জীবনের পরতে পরতে। এমনি শুভদিনের প্রত্যাশায়।—শেলী জামান খান

জটিল অঙ্ক

ইব্রাহীম চৌধুরী

জর্জ দ্বিতীয় গ্লাসের দিকে হাত বাড়িয়েছেন। মোবারক স্ত্রীকে নিয়ে শপিংমলে গেছেন। কেনাকাটা করে স্ত্রী চলে যাবেন। মোবারক যোগ দেবেন আমাদের সঙ্গে।

‘বুঝলে ইব্বি, তুমি বলেছিলে আগের চেনা-জানা ছাড়াই নাকি তোমরা বিয়ে করো?’

‘আলবৎ জর্জ, আমি নিজেও করেছি!’

‘বিয়ের পর সবাই এক।’ বলতে বলতে মোবারক এসে যোগ দেন।

জর্জের নেশা ধরেছে। তৃতীয় দফা পানীয় অর্ডার করেছেন। নিজের জন্য রেড ওয়াইন। মোবারকের জন্য তাঁর প্রিয় ককটেল লং আইল্যান্ড আইস টি!

‘বুঝলে ইব্বি, যৌবনের প্রথম ধাক্কার কথা মনে পড়ে গেল।’

মোবারক নড়ে-চড়ে বসলেন। স্ত্রীর উদ্দেশ্যে গজগজ করছেন তখনো।

‘‘সদ্য স্কুল পাস করেছি। এক সন্ধ্যায় আমার প্রথম মেয়েবন্ধু জেসিকা এসে উপস্থিত। বলল, ‘জর্জ, সুসংবাদ। আমি প্রেগন্যান্ট!’’’

‘ওয়াও! এমন সুসংবাদের জন্য আমি ঠিক প্রস্তুত ছিলাম না।’

জর্জ বলে যাচ্ছিলেন, ‘বাবা হওয়ার সুসংবাদে জেসিকাকে জড়িয়ে ধরি। ঠোঁটে ঠোঁট রাখতে যাব, এমন সময় জেসিকার ভয়ংকর বার্তা।

‘দুঃখিত জর্জ। এই সন্তানের বাবা তুমি নও।’

জর্জ জীবনের শুরুতেই এমন একটা ধাক্কার স্মৃতি বয়ে বেড়াচ্ছেন। কষ্টের স্মৃতি বলতে গিয়ে আবেগাপ্লুত জর্জ। পরিবেশ স্বাভাবিক করার উদ্যোগ নিলেন মোবারক।

‘আমার মিসরীয় এক বন্ধুর গল্প শোনাই বন্ধুরা।’

‘হাসান স্ত্রীর কাছে শপথ করেছেন, গোপনে জীবনে কিছু করবেন না। স্ত্রীকে মেসেজ পাঠালেন, প্রিয়তমা স্ত্রী, তুমি জানো আমার সব প্রয়োজন এখন আর তোমার ৫৪ বছর বয়সে পূরণ করা সম্ভব হচ্ছে না। আজ কাজ শেষে ১৮ বছর বয়সী অফিস সেক্রেটারিকে নিয়ে কমফোর্ট ইন হোটেলে থাকছি। আশা করি তুমি ভুল বুঝবে না। তুমি তো আমার সুখই চেয়েছ সারা জীবন। লাভ ইউ।’

এরপর ঘরে ফিরে স্কুলশিক্ষিকা স্ত্রীর চিরকুট পেলেন হাসান। তাতে লেখা—‘প্রিয় স্বামী, তোমার বয়সও যে ৫৪ হয়েছে, তা স্মরণ করিয়ে দেওয়ার জন্য ধন্যবাদ। আমার ক্লাসের সুদর্শন ছাত্র অ্যান্ড্রু। রেডিসন হোটেলে রুম বুক দিয়েছে। সেখানেই যাচ্ছি। ছেলেটি শুধু সুদর্শনই নয়, স্কুলের ক্রিকেট টিমের ক্যাপ্টেনও। তুমি একজন সফল ব্যবসায়ী, মেধাবী মানুষ। অঙ্কে চৌকস। আর হ্যাঁ, ছেলেটির বয়সও ১৮। আমি তো জোড়াতালির অঙ্ক কষে ২৫ বছরের দাম্পত্য পার করলাম। দেখ তো এই সরল অঙ্কটির ফলাফল কোনো বার্তা দেয় কিনা—

৫৪-৫৪ = ০০

১৮ x ৩ = ৫৪’

ঝড়ের পরে

কেয়া চ্যাটার্জি

ঝড় শেষে দরজা খুলে বাইরে আসে কুন্তী বুড়ি। উঠোনে এক হাঁটুজল। দক্ষিণ দিকের আমগাছের বড় ডাল ভেঙে পড়েছে গোয়াল ঘরের চালে। ভাগ্যিস রাতেই গরু বাছুরগুলোকে দাওয়ায় তুলে রেখেছিল। বাছুরটা এতক্ষণে হয়তো সব দুধ খেয়ে নিয়েছে। আহা! খাক বেচারা। আজ কেউ দুধ খাবে না, ভাত চাই সবার। নিজেরটুকু রেখে ড্রাম থেকে বাকি চাল একটা কাপড়ের ব্যাগে ঢেলে নিয়ে, কুলঙ্গি থেকে দুটি মুড়ির ঠোঙা পেরে নিয়ে জল ভেঙে চলল। পা চলছে না, তবু কোমর অবধি জল ঠেঙিয়ে কুন্তী বুড়ি এসে পৌঁছাল নদীর কাছে। গতকালের বিধ্বংসী ঝড়ের পরে ছারখার হয়ে গেছে গ্রামের পর গ্রাম। নদীর বাঁধ ছাপিয়ে জল ঢুকে গেছে চাষের জমিতে, বাড়িতে, ধানের গোলায়। বাঁধের কাছে লোকারণ্য। গ্রাম ভেঙে পড়েছে শুটিং দেখতে। কিছু লোক মাইক হাতে ক্রমাগত উচ্চ স্বরে কথা বলে চলেছে। কুন্তী বুড়ি এসব বোঝে না, জানেও না। তার স্বামী মরেছে দুই দশক হলো। একটা মেয়ে ছিল। ম্যালেরিয়াতে মরেছে। কুন্তী বুড়ি একা একা বেঁচে রইল ভিটে আগলে। একটিমাত্র গাইয়ের দুধ দুয়ে যে টাকা পায়, চলে যায়।

কুন্তী তার কোঁচকানো চামড়া ঢাকা চোখের ওপর বাঁ হাতের তালু রেখে আরও দূরে কিছু দেখার চেষ্টা করল। হ্যাঁ, ওদের দেখা যাচ্ছে। জল ভেঙে এসে দাঁড়াল নদীর কাছে। নদীর বাঁধ গেছে ভেঙে। একেবারে ভাঙতে দেওয়া যাবে না। তাহলেই ভেসে যাবে গ্রামের পর গ্রাম। হয়ে উঠবে মৃত্যুপুরী। তাই শুনে অবুঝ ছেলেগুলো ছুটে এসেছে রাতেই। নিজেদের পিঠ দিয়ে ধরে রেখেছে বাঁধ। সংবাদমাধ্যম বাংলার মানুষকে সেই দৃশ্য দেখাচ্ছে। কুন্তী বুড়িকে দেখে একটি ছেলে কাঁপতে কাঁপতে বলে, ও বুড়িমা তুমি এখানে কেন গো? বুড়ি চালের ব্যাগটা একটি মহিলাকে দিয়ে বলে, একটু ভাত রেঁধে দে মা, ওদের খাইয়ে দিই। তারপর একমুঠো মুড়ি তুলে বলে, হাঁ করত বাছা। ছেলেটি মুখ খুলল। কুন্তী বুড়ি সাবধানে তার মুখের ভেতর ফেলে দিল মুড়ির শুভ্র দানা।

কুঁজো পিঠ নিয়ে আবার ফিরে চলল বুড়িমা। নিজের সম্বলটুকু দিয়ে তার ভারী আরাম বোধ হচ্ছে। গোটা গ্রাম বোকা ছেলেগুলোর মজার খেলা দেখতে ব্যস্ত থাকলেও, তার ঢের কাজ বাকি।

একমুঠো চেরি ব্লসম

কেয়া ওয়াহিদ

সকালের সোনা রোদ যখন জানালার কার্নিশে, সলাজ পর্দা জেগে ওঠে আত্মিক টানে। অনঙ্গ রাত মিশে যায় মেঘের কোলে। ঘুমিয়ে থাকা হৃদেশের গায়ে কম্বল টেনে দিয়ে আমি বিছানা ছাড়ি। উলেন স্লিপার পরে শোয়ার ঘর থেকে বেরোই সন্তর্পণে। বাড়ির মধ্য দিয়ে নেমে যাওয়া কাঠের সিঁড়িতে মৃদু আলোর লুকোচুরি খেলা। তার পাশ ঘেঁষে ধীর পায়ে নিচতলায় নেমে এলাম। গায়ে পশমিনা শাল জড়িয়ে টেরেসে এসে দেখি শূন্য ফুলের টব অপেক্ষার বালুচরে বসে জিজ্ঞেস করছে—প্রিয় মিতা, কবে মাটি ও ফুলের চারা কিনতে যাবে? আমি মৌন উত্তর দিই, প্রকৃতিকে একটু সময় দাও। শীত বিদায়ী অনুষ্ঠান সেরে আসুক টিউলিপ বাগান থেকে। আরেকটু চোখ তুলে তাকাতেই দেখি মধুকূপি ঘাসেরা হিম জড়তায় কুয়াশার চাদর টানাটানি করছে, রৌদ্র গাড়ির অপেক্ষায়। সামনে এগোতেই দেখলাম, গাছের নিচে বিছানো ফুল। চেরি ব্লসম এসেছে আঙিনায়। একমুঠো ফুল হাতে তুলে নিলাম। কী সুন্দর লজ্জাবতী গোলাপি কোমল!

‘গুড মর্নিং’ চেনা কণ্ঠে চেনা ডাক শুনে আমিও তাকালাম। তিনি রবার্ট ফ্রস্ট, পাশের নেইবারহুডে থাকেন। মাঝে মধ্যে দেখা হয় হাঁটতে বেরোলে। কাছে এসে ফিসফিস করে বললেন, ‘কার জন্য ফুল কুড়াচ্ছ ডার্লিং?’ অপ্রস্তুত আমি হাত বাড়িয়ে বললাম, ‘এই নাও তোমার জন্যই!’ তিনি হো হো করে হেসে হাত বাড়িয়ে ফুলগুলো নিলেন। হাতে হাত লাগতেই হকচকিয়ে বললেন—এ কী তোমার হাত এত ঠান্ডা কেন? নিশ্চয়ই অনেকক্ষণ বাইরে, হাত মোজাও পরোনি, যাও যাও ভেতরে যাও।

তাঁর কথা শুনে আমার মনে হয় ঠান্ডাটা বেড়ে গেল। বিদায় নিয়ে তাড়াতাড়ি বাসায় ঢুকলাম। হাতে হাত ঘষতে ঘষতে পুরোনো গন্তব্যে ফিরি, শোয়ার ঘরে। কম্বলের নিচেও ঠান্ডা লাগছে। ওম খুঁজতে হৃদেশের পিঠের কাছে ঘেঁষলাম। এখনো শীতে ঠোঁট কেঁপে নিশ্বাস নিচ্ছি। হৃদেশ ঘুমঘোরে জিজ্ঞেস করল, ‘কী হয়েছে, কাঁপছ কেন?’

বন্ধ চোখ, ক্ষীণ কণ্ঠে বললাম, খুব শীত লাগছে, কেবল বাইরে থেকে এলাম।

মৃদু উত্তেজনায় এখন হৃদেশের জিজ্ঞাসা, ‘বাইরে কখন গেলে? তাও আবার এত রাতে, কেন?’ তাৎক্ষণিক ঘড়ি দেখে বলল, এখন তো মধ্যরাত, সাড়ে তিনটা বাজে। এরপরের ঘটনা আমি নিজেও মনে করতে পারছি না।

সাজা

সালমা মঞ্জুলিকা

মাঝ রাতে জানালার কপাট বাড়ি খাওয়ার শব্দে ঘুমটা ভেঙে গেল। পশ্চিমের খোলা জানালাটা দিয়ে ঝোড়ো বাতাস ঢুকছে। উঠে জানালাটা লাগিয়ে দিলাম। পায়ের কাছে কুঁইকুঁই শব্দ শুনে তাকিয়ে দেখি টাইগার আমার গা ঘেঁষে ভয়ার্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। ওর শরীরের লোমগুলো সব দাঁড়িয়ে গেছে। ভয়ার্ত টাইগার আমার দুই পায়ের ভেতর ঢুকতে চাইছে। বেচারা। প্রচণ্ড ভয় না পেলে ও এমন করে না। কী দেখে এমন ভয় পেল? বাসায় তো এখন আমি আর ও ছাড়া আর কেউ নেই। সাজ্জাদ তো সেই তিন মাস আগেই চলে গেছে। আমাকে শাস্তি দিতে ডিভোর্স লেটারও পাঠিয়ে দিয়েছে। অযাচিত সন্দেহ করাই ছিল তার বাতিক।

টাইগারকে কোলে নিয়ে ঘুমানোর চেষ্টা করি। একবার ঘুম ভেঙে গেলে আর ঘুম আসে না। গত তিন মাস আগের ট্রমা এখনো ভালোভাবে কাটিয়ে উঠতে পারিনি। চোখ বুজলে এখনো দেখি থানা, পুলিশ আর কয়েদখানার মোটা মোটা শিক। কম টাকা ঢালিনি মামলা তুলতে।

দেয়াল ঘড়িতে ঢং ঢং করে চারটা বাজার আওয়াজ এল। চা খেতে খুব ইচ্ছা করছে। রান্নাঘর থেকে খুটখাট শব্দ ভেসে আসছে। খুব ইঁদুরের উপদ্রব হয়েছে আজকাল। হঠাৎ কল থেকে পানি পড়ার শব্দ ভেসে এল। কল খোলা রেখে ঘুমিয়েছিলাম নিশ্চয়ই। বিরক্ত মনে রান্নাঘরের দিকে এগোলাম।

রান্নাঘরে চুলার পাশে রাখা আমার চায়ের কাপ থেকে ধোঁয়া উড়ছে। মরিয়মের হাতে বানানো দুধ-চায়ের মিষ্টি সুবাস পুরো রান্নাঘর জুড়ে। কে চা বানাল? আশ্চর্য! গত তিন মাস ধরে আমি তো কোনো হেল্পিং হ্যান্ড রাখিনি।

মরিয়মের ঘর থেকে নষ্ট ফ্যানটা ঘোরার ঘটাং ঘটাং শব্দ ভেসে আসছে। বাসায় কি চোর ঢুকেছে নাকি? সাহস করে আমি মরিয়মের ঘরে উঁকি দিলাম। রান্নাঘরের আলোয় স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে ফ্যানটা আস্তে আস্তে ঘুরছে আর ফ্যানের সঙ্গে গলায় দড়ি দেওয়া অবস্থায় ঘুরছে মরিয়ম! সেদিনের মতো ওর ঠোঁটের দুই পাশ বেয়ে রক্ত গড়িয়ে নেমেছে, জিভ অনেকখানি বের হয়ে আছে। তিন মাস আগে মরিয়মের গলায় ওড়না পেঁচিয়ে ঠিক এভাবেই ওকে ফ্যানের সঙ্গে ঝুলিয়ে দিয়েছিলাম।

মরিয়মের আধখোলা চোখের সঙ্গে বারবার আমার চোখাচোখি হচ্ছে। ওর ঠোঁটের হাসিটি এখনো অম্লান।

ঝড়

স্বপন বিশ্বাস

চারদিকে গ্রীষ্মের দাবদাহ। বসন্ত শেষ না হতেই প্রকৃতিতে গ্রীষ্ম এসে ছোবল দিচ্ছে।

কুশি এবার প্রাইমারি স্কুল শেষ করে হাইস্কুলে যাওয়া শুরু করেছে। স্কুল থেকে ফিরে বই খাতা নিয়ে চলে যায় রাস্তার ধারের আম বাগানে। সেখানে গাছের ছায়ায় দখিনা হাওয়া আসে। বাগানের চারা গাছটাতে এবারই প্রথম একটা আমের কুঁড়ি এসেছে। পলান ছেলেটা গরু চরায় আর গাছ থেকে কাঁচা আম পেড়ে খায়। কুশি পলানকেও ডেকে বলে দিয়েছে এই আমটা না পাড়ার জন্য। পাকলে খাবে। তখন পলানকে ভাগ দেবে।

কুশি আর পলান মাটিতে দাগ কেটে বাঘবন্দী খেলে। আম গাছের পাতার ফাঁকে একটা কোকিল ডাকে, কুহু কুহু।

চেয়ারম্যানের মোটরসাইকেল এসে থামে আমতলায়।

—কী নাম তোমার?

—কুশিয়ারা খাতুন।

—বাহ! সুন্দর নাম তো তোমার। আমাকে চেনো?

কুশি বইয়ের ভেতর থেকে চেয়ারম্যান ইলেকশনের সময়ের একটা হ্যান্ডবিল বের করে সামনে ধরে বলে, আম মার্কা।

চেয়ারম্যান বলেন, বাজারে পাকা আম আসলে তোমার জন্য এক ঝুড়ি আম কিনে আনব। তোমার আব্বাকে আজ আমার সঙ্গে দেখা করতে বলবে।

চেয়ারম্যান তাঁর বড় বউকে তালাক দেওয়ার পর যে বিয়ে করেছিল, সে বউটা মাস ছয়েক আগে গলায় দড়ি দিয়ে মরেছে। বিয়ের প্রস্তাব দেওয়ার পর কুশির বাবা মেয়ের বয়স কম বলে এড়িয়ে যেতে চেয়েছিল। চেয়ারম্যান বলেছেন জন্ম মৃত্যুর সনদ তো তাঁর হাতে। তাই কোনো সমস্যা নেই।

বাসর রাতে কুশিকে চেয়ারম্যানের ঘরে তুলে দিয়ে প্রতিবেশী নারীরা সবাই তাড়াহুড়া করে বাড়ি ফেরে। আকাশে তখন অনেক মেঘ। কিছুক্ষণ পরেই ঝড় ওঠে। যদিও ঝড় শুরুর আগে কেউ কেউ কুশির কান্না আর চিৎকারের আওয়াজ শুনেছিল। তুমুল ঝড় আর দমকা হাওয়ার সঙ্গে চিৎকারের শব্দ মিশে গেছে।

ভোর রাতে চেয়ারম্যান বাড়ি থেকে কুশিদের বাড়িতে খবর আসে। তখন ঝড়ের পরে চারদিকে নিঃসীম স্তব্ধতা। কুশির বাবা ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটতে থাকে চেয়ারম্যান বাড়ি দিকে। পথে চোখে পড়ে চারা গাছের আমটা মাটিতে পড়ে আছে।

ছোট্ট আমের কুঁড়িটি এত বড় ঝড়ের দমকা হওয়ায় টিকতে পারেনি।

বনের বাঘে খায় না

সজল আশফাক

কোথাও একা একা দূরে ঘুরতে যেতে ভয় পায় মেহেদী। একা মানে একদম একা নয়, মেহেদী আর লিরা, নবদম্পতি। ভয়টা অন্যরকম। এই বুঝি কেউ লিরাকে নিয়ে বাজে কমেন্ট করল, ওড়না ধরে টান দিল। ভয়টা একেবারে অমূলকও নয়। তাই বলে, কি কেউ ঘুরছে না। পার্কে, সৈকতে হাত ধরাধরি করে ছেলেমেয়েরা হরহামেশাই ঘুরছে। মেহেদীর সঙ্গে ঘুরতে না পারা নিয়ে লিরার যখন অনেক অভিযোগ, তখনই সুযোগ এল পরিবারের সবাই মিলে সুন্দরবন যাওয়ার। সবাই মিলে গেলে মেহেদীর সেই ভয়টা অন্তত থাকছে না। বিয়ের পর প্রথম ভ্রমণ, তাও আবার সুন্দরবন! মেহেদী আর লিরার ভাবনায় রোমান্স আর শিহরণ তুঙ্গে। খুলনায় লিরার ভাইয়ের বাসায় উঠবে সবাই, ভাই বড় কর্মকর্তা। লিরার বাকি তিন বোনের পরিবার আছে এবারের ভ্রমণে।

সদলবলে সুন্দরবন গিয়ে পৌঁছাল মেহেদী। সেখানে পৌঁছানোর পর কাঠের সাঁকো ধরে জঙ্গলের গভীরে যাওয়ার পথে মেহেদী আর লিরা সবার আগে। চারদিকের গভীর জঙ্গল দেখার মুগ্ধতায় আচ্ছন্ন ওরা এক সময় সাঁকোর শেষ প্রান্তের ঢাল বেয়ে বনের গভীরে ঢুকে পড়ে। সময়টা পড়ন্ত বিকেল হলেও জঙ্গলের অন্দরে সন্ধ্যা নামার অন্ধকার। সেই সান্ধ্যকালীন আঁধারে একটু এগোতেই ঝোপের আড়ালে বাঘ দেখার আতঙ্কে আঁতকে ওঠে মেহেদী। তারপর ঊর্ধ্বশ্বাসে মেহেদীর উল্টো দৌড়। ডান হাতে চেপে ধরা লিরাও উপায়ান্তর না দেখে দৌড়াচ্ছে। দৌড়ানোর সময় মেহেদী লক্ষ্য করল, পেছনে থেকে কে যেন তার বাম কাঁধের ক্যামেরার ফিতা টেনে ধরেছে। ক্যামেরার মায়া ছেড়ে দৌড়ে সাঁকোতে উঠে আসতেই দেখল সঙ্গীরা এগিয়ে এসেছে। ঘটনা শুনে ফরেস্ট বিভাগের লোকসহ প্রস্তুতি নিয়ে অনুসন্ধানে বনে ঢুকল কয়েকজন। কিছু দূর যেতেই দেখল ক্যামেরাটা শীর্ণ গাছের ডালে ঝুলছে। তার অদূরে কয়েকটা চিত্রল হরিণ। হরিণকে বাঘ ভেবেছিল মেহেদী। এবার মেহেদীকে নিয়ে সবাই হাস্যরসে মেতে উঠল।

এমন সময় আবার জটলার মধ্য থেকে কে একজন চিৎকার করে বলল, বাঘ...।

এবার মেহেদী আর লিরা ছাড়া বাকিরা ভোঁ দৌড়। মেহেদী আর লিরা হাত ধরাধরি করে সবার পেছনে হাঁটছে আর ভাবছে—বনের বাঘে খায় না, মনের বাঘে খায়।

তিন অধ্যায়

রাজিয়া নাজমী

মমতা বেগমকে বিয়ের কনের সাজে সাজিয়ে সবাই বর দেখতে চলে যেতে যেতে বলল, কবুল করার জন্য তৈরি হয়ে থাক।

হই হই রই রই করতে করতে সবাই এসে জানাল, তার বিয়ে হয়ে গেছে। মমতার বাবা নাকি মেয়ের হয়ে কবুল বলে দিয়েছে। ‘কবুল’ বলতে কেমন লাগে তা আর বোঝা হলো না মমতার।

বর দেখতে সবাই যাওয়ার পরে মমতার খুব ইচ্ছে হলো বরকে একবার দেখার। জানালার পর্দা একটু সরাতেই ভাই দেখে ফেলে ধমক দিয়ে বলল, বিয়ের কনের লজ্জা থাকতে হয়। বেহায়াপনা করে বাড়ির সম্মান নষ্ট কর না।

বিয়ের এক মাস পরে এক রাতে স্বামীর কাছে নিজের আবেগ প্রকাশ করতেই স্বামী বলল, এমন বেহায়ার মতো করবে না। মেয়ে মানুষের লজ্জা থাকতে হয়। সেই থেকে কোনো কিছুর জন্য আর আবদার করেনি সে। পাছে আবার বেহায়া হয়ে যায়।

মমতার অনেকবার ইচ্ছা হয়েছিল বাপকে জিজ্ঞাসা করে, বাবা আমার কি বিয়ে হয়েছিল? কেউ যে জানতে চায়নি বিয়েতে আমি রাজি কিনা। আমি যে কবুল বলিনি বাবা! কবুল না বললে বিয়ে কি হয় বাবা? জিজ্ঞাসা করার সাহস হয়নি।

ভাইকে একবার বলতে চেয়েছিল, তুমি নিজে দেখে পছন্দ করেই বিয়ে করলে আর আমি শুধু একবার দেখতে চেয়েছিলাম সেই রাতে আমি কার সঙ্গে বাবার বাড়ি ছেড়ে যাব।

কতবার মনে মনেই স্বামীকে বলেছে তার কামনার কথা। স্বামী সেসব না বুঝে, না পেয়ে, না দিয়েই চলে গেল।

বাবা নেই, ভাই নেই, আজ স্বামীও চলে গেছে। মমতা বেগমের তাঁদের কিছুই বলা হলো না। তাঁরাও কোনো দিন মমতার কাছে কিছু জানতে চাইল না। শুধু বলেই গেল।

বাপকে কবরে নামিয়ে দিয়ে ছেলে সামনে এসে দাঁড়িয়ে মা ডাকতেই, মমতা বেগম আরেক অধ্যায়ের জন্য তৈরি হয়ে বলল, বল কী বলবে! আমি শুনছি।