অনীলার সংসার

ছবিটি প্রতীকী

অনীলার ভীষণ মন খারাপ! মাঝেমধ্যে তেমন কোনো কারণ খুঁজে পায় না। হ্যাঁ, দুনিয়ার কোণে কোণে হাজারো জীবন সংশয়ে আছে। কত কিছু হচ্ছে। তবে তার সঙ্গে অনীলার কোনো লেনদেন তো নেই। সুন্দর একটা সকালের প্রত্যাশা তার প্রতিদিনের। যেদিন মনে হয় পৃথিবীটা সুন্দর, এই বেঁচে থাকাটা সুন্দর, ও চায়, সেই ছোটবেলার মতো এক চনমনে সকাল হোক। বিছানা থেকে তিড়িং করে উঠে সে সারা দিনের জন্য প্রস্তুত হোক।

ভাবছে, সে কবে এমন জীবিত, মানে অ্যালাইভ ফিল করেছিল?
ভেবে পায় না। না, ছোটবেলায়ও না। কোনো প্রয়োজনই ছিল না বা তাড়াই ছিল না সেসব দিনে তার জেগে ওঠার! উঠতে হতো বলে উঠত। কোনো রেসপন্সিবিলিটি ছিল না। না, মনে পড়েছে! ছিল মাঝেমধ্যে, সকাল সকাল সে উঠে তৈরি হতো স্কুলে যাওয়ার জন্য। সেটাই তো তার মানুষের সঙ্গে ইন্টারঅ্যাকশনের সময় ছিল! মাঝেমধ্যে ভালোই লাগত।

নাশতা করে যেত? ঠিক মনে পড়ে না। কয় ঘণ্টারই–বা ক্লাস! দুপুরে কিছু খেয়ে নিলেই চলত। আর ১২টার মধ্যেই তো ক্লাস শেষ! বাড়ি ফিরে পেটপুরে খেয়ে নিলেই হতো! ফের কখনো ভাতঘুম, কখনো নয়! কী সাদামাটা জীবন! এক্সাইটিং কিছু ছিল না।
না সে নাচ শিখতে যেত, না গান! না পাশের বাড়ির ছেলে তাকে হাতছানি দিত! হাসছে অনীলা! সাদামাটা–সাদাসিধে আটপৌরে জীবন। কোনো রেসপন্সিবলিটি নেই। জীবনে ভালো করতে হবে, তার কোনো প্রতিযোগিতা নেই কারও সঙ্গে। দিনগুলো নিয়ে প্রত্যাশা নেই, হতাশাও নেই। সেই অনীলার কেন মন খারাপ হয়?

আটপৌরে জীবন তো এখনো। কোথাও কোনো তারে না রং লাগে, না বিবর্ণ হয়। সোজাসাপটা জীবন! এর বেশি কি কিছু চাওয়ার থাকতে পারে কারও জীবনের কাছে?
রোলারকোস্টার রাইড নেই! ভীষণ ম্যাড়মেড়ে, বরং বোরিংই বলা যায় তার জীবনাদর্শকে। সবকিছু কন্ট্রোল্ড, সবদিকে।

অলংকরণ: মাসুক হেলাল

ব্যস্ত স্বামী! তাতে ওর সমস্যা নেই। এভাবেই সে জানে স্বামীকে। ভিন্ন জীবন কেমন, তা তার জানা নেই। তাতে তার সমস্যা নেই। কাজেই ব্যস্ত! চায় সেও ব্যস্ত থাকুক তার মতো করে! কেন যেন তারপরও হাঁপিয়ে ওঠে অনীলা। মানুষের থেকে দূরেই থাকে সে।

নিজের সময়ের সঙ্গে কম্প্রোমাইজ করে বন্ধুত্ব মেনটেইন করা বা হ্যাংআউট করা তার পক্ষে সম্ভব নয়। বিরক্ত হয়ে যায় সে সহজেই। ঘড়ির কাঁটায় জীবনযাপনে অভ্যস্ত সে। খুব একটা হেরফের হয় না। হলেও সেটা তাকে ভীষণ বিরক্ত করে। তাই সে সজ্ঞানে লোকজন অ্যাভয়েড করে বেড়ায়। অথচ ছোটবেলায় প্রতি সপ্তাহে কোথাও না কোথাও পার্টি অ্যাটেন্ড করা নিয়মই ছিল! আর তারা বাসায় সারাক্ষণ লোকজনের আনাগোনা। মায়ের দম ফেলার ফুরসতও ছিল না। সারাক্ষণ রান্নাবান্না, এটা-সেটা নিয়ে ব্যস্ত! সে কি তবে এসব দেখেই অমন জীবনযাত্রার প্রতি বিমুখ? লোকজন সে সজ্ঞানে এড়িয়ে চলে?
বাবাও তার কাজের চাপে সারা দিন বাইরেই থাকত। সপ্তাহে এক দিন ছুটি, আর ডিনার ছাড়া কমই সে বাসায় থাকত। অমন জীবনযাত্রায় অভ্যস্ত হয়ে সে কী করে স্বামীর ব্যস্ততা ভিন্ন চোখে দেখবে?

তাই সে ভাবছে। চায়ের কাপ হাতে নিয়ে কেন তার মন খারাপ?
প্রতিদিন এই শান্ত–নিরিবিলি জীবন থেকে পালাতে কেন তার মন উসখুস করে বেড়ায়? ভাবছে, আসলে সে কি কোথাও গিয়ে কদিন শান্তিতে কাটিয়ে আসতে পারবে? কী জানি! তার ইচ্ছাও হয় না, সাহসও হয় না। সাহস? না কনফিডেন্সের অভাব? এ দুটোর মধ্যেই পার্থক্য করতে পারছে না সে অনেক দিন।

এই যে আজ সকালেও সে ভেবেছে, খাবার টেবিলে পতিদেবতাকে বলবে, ‘পোষাচ্ছে না তোমার সঙ্গে আমার।’ কতবার মনে মনে রিহার্সালও দিয়েছে! তবু মুখফুটে বলতে পারেনি। সাহস, না কনফিডেন্সের অভাব? ভাবছে, কী করে বলবে সে এ কথা? দোষ তো তার স্বামীর নেই কোনো। এমন না যে সে তার স্বামীকে ভালোবাসে না। পৃথিবীতে আপাতত এই একটি ব্যক্তিকেই সে বিশ্বাস করে, ভালোওবাসে ভীষণ! তবে এমন ভাবছে কেন?

এই ‘কেন’টা অনীলাও ভাবছে, উত্তর জানা নেই। শুধু আজকেই নয়, অনেক বছর ধরেই ভাবছে। কেন সে পালাতে চায়! কী বলবে? আজ বুধবার, তোমার শার্টের রংটা আজ চোখে বড় লাগছে? তোমাকে আমার আজ ভালো লাগছে না? আজ আমার ব্রেক চাই সংসার থেকে, জাস্ট বিকজ আমি টায়ার্ড? হাঁপিয়ে উঠেছে সে। তাই বলে সংসার ফেলে চলে যাওয়া যায়? এমন তো নয় সংসার যে আজ ভালো লাগল না, আজ তোমার সঙ্গে আড়ি, দুদিন পরে ভাব! সংসারটা যে কী! ঘর ছেড়ে গেলে ফেরা যায়? কী দোষে ছেড়ে যাচ্ছে, তা–ই যদি না বোঝে, ক্ষমা করা যায়? কাপে চুমুক দিল সে। কী সব হাবিজাবি ভাবছে!

সংসারটা অনীলার যতটা, তার চেয়ে ওর স্বামীর বেশি। এত সংসারী ভালোমানুষের বউ তাকে ছেড়ে গেল? এ প্রশ্নের জবাবটা কী হতে পারে? কঠিন বিব্রতকর প্রশ্ন!
নাহ। এমন না যে অনীলার অন্য কারও সঙ্গে চক্কর চলছে। এমন না যে সে কারও প্রেমে পড়েছে! কী করে মানুষকে বোঝাবে, অনীলা খুব টায়ার্ড আজকাল! তার কিছুই ভালো লাগে না। না সংসার, না নিজেকে, না বেঁচে থাকাটাকে! কেন এভাবে বেঁচে থাকতে হয়? এটাই মাথায় আসছে না তার! অথচ তার কারও ওপর কোনো বিরক্তি নেই, ক্ষোভ নেই। শুধু বেঁচে থাকাটার ইচ্ছাগুলো মরে গেছে!

ভাবছে, অনিন্দ্য, মান ওর স্বামী, সে কি সুখী ওকে নিয়ে? ভীষণ সংসারী, রেসপন্সিবল স্বামী তার। কোনো অনুযোগ, অভিযোগ নেই। সে তো অনীলারও নেই। ভাবছে জিজ্ঞাসা করবে একদিন! সে কি সুখী অনীলার সঙ্গে, না শুধু শুধু সেও শুধু সংসার করার জন্যই সংসার করে যাচ্ছে? বিয়েটা পারিবারিকভাবে হলেও নিজেরাই কথা বলে নিয়েছে বিয়ের আগেই। বোঝাপড়া খারাপ নয় দুজনের; বরং একজন আরেকজনের পরিপূরক! তবু কোথায় যে সে অপ্রাপ্তির খেদ!

অনীলা কখনো জানতে চায়নি অনিন্দ্য কাউকে পছন্দ করত কি না! এটা তার জানার কথা মনেও হয়নি, হয় না। দুজনে মিলে সিদ্ধান্ত নিয়েছে সংসার করবে। তার বাইরে কারও সঙ্গে সম্পর্ক ছিল কি না, তা জেনে কী লাভ? কমিটেড তারা একে অন্যের প্রতি।
অনীলা ভালোবাসত কাউকে?

সেটাও অনিন্দ্য জানতে চায়নি কখনোই। বিয়ের আগে তাদের কারোই হয়তো অন্য কারও সঙ্গে সম্পর্ক ছিল না। তবে অনীলা কি কখনো কাউকে ভালোবাসেনি?
বেসেছিল, বলা যায় চেষ্টা করেছিল! তার কোনো পরিণতি হয়নি। ভালোবাসার কমতি ছিল অনীলার? না, তা সে ভাবে না। তবে তাকে নিয়ে সুবর্ণ যে পজেসিভ ছিল! একই সঙ্গে অবহেলা অথচ তাকে হারানোর ভয়ে ভীত হয়ে থাকতে দেখেছে তাকে! মানে ভয়ানক মাথাব্যথার কারণ হয়ে গিয়েছিল অনীলা তার জন্য। মাত্র কয়েক সপ্তাহের সম্পর্কে দুজনই ভিন্নভাবে হাঁপিয়ে উঠেছিল। দুদিনেই সে সম্পর্ক ভেঙে নিজেকে মুক্ত করে নিয়েছিল সুবর্ণ! আজ অনীলা ভাবে, সেটাই সঠিক ছিল সুবর্ণের দিক থেকে। সুখী হওয়ার সব অধিকারই তার ছিল। সুবর্ণের সে সম্পর্কে সাফোকেটেড মনে হয়েছে, সে নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছে! বরং আজ অনীলার মনে হয়, সেটা দুজনের জন্যই সঠিক সিদ্ধান্ত ছিল। নয়তো অনীলা সে অসুখী সম্পর্কও হয়তো চুপচাপ বয়ে নিয়ে যেত।

প্রতীকী ছবি

যদিও অনীলার পক্ষে সুবর্ণের অযথা পজেসিভনেস, সঙ্গে অবহেলা আর কটু কথা সহ্য করে যাওয়া সম্ভব ছিল না দিনের পর দিন। কমিউনিকেশনের গ্যাপ সুবর্ণ ধরতেই পারেনি কখনো। পারতই না; বরং ও–ই ভালো হয়েছে। দুজন দুজনের মতো সুখী হওয়ার প্রত্যয়ে ছেড়ে এসেছে দুজনকে। যদিও ব্যাপারটা এত সহজ ও ছিল না। তবে সুবর্ণের জন্য কঠিনও ছিল না। সুবর্ণের এমন কাউকে দরকার ছিল, যেখানে সে সিকিউর্ড ফিল করে। অনীলারও এমন কাউকে দরকার ছিল, যেখানে সে স্বস্তির নিশ্বাস নিতে পারে। মিউচুয়াল আনডারস্ট্যান্ডিং আর রেসপেক্ট! সুবর্ণকে সে কারণে আজ ধন্যবাদ দিতে ইচ্ছা হচ্ছে খুব। বুদ্ধিমান ছিল সে।

অনীলার মানসিকভাবে ভীষণ শক্ত একজনের দরকার ছিল, যে তার ছেলেমানুষিগুলো মেনেই তাকে ভালোবাসবে! সুবর্ণেরও তাই। কী বাচ্চা ছিল তখন!
দুজনই তারা তাদের জীবন গুছিয়ে নিয়েছে। সে কবেকার কথা! অল্প বয়সের বোকা বোকা প্রেম। হাসে অনীলা। না, সেসব নিয়ে তার কোনো খেদ নেই। সে সম্পর্ক ভেঙে যাওয়ার পর অনীলা নতুন করে কারও সঙ্গেই জড়ায়নি। তারও অনেক বছর পরেই বিয়ে করেছে সে। কিছুটা তো পরিণত ছিল সে সময়ে।

আজ সে অনেক পরিণত। অথচ সম্পর্কে সাফোকেটেড ফিল করে! করার কোনো কারণ নেই। অথবা সে ভাবতে চায় নেই। সুখী না হওয়ার কোনো কারণ নেই তার। অথচ ভাবতে পারে না কী করবে? কেন করবে? কী দোষে ছেড়ে যাবে সে তার এত দিনের সংসার? অনীলা ভীষণ কনফিউজড ফিল করে। অথচ নিজের মনে বিন্দুমাত্র সুখ খুঁজে পায় না। এর জন্য তো সে অনিন্দ্যকে দোষ দিতে পারে না!

মন খারাপের কোনো কারণ সে খুঁজে পায় না। অথচ সে প্রতিদিন একটু একটু করে মরে যাচ্ছে নিজের ভেতর। নিজের ভেতরে যে অশান্তির ঘুণপোকা, তা সে কী করে দমাবে? সে কি পাগল হয়ে যাচ্ছে? কোনো সলিড কারণ নেই। দুম করে মনে হলো আজ সকালে আমি নিজের মতো বাঁচতে চাই? এটা ভাবা কি অন্যায়?

ঠিক নিজের মতো বাঁচতে চাই–ই না, সব ছেড়েছুড়ে অনীলা দূরে কোথাও চলে যেতে চায়! সেটা কি মতিভ্রম তার? কী করে সে এমন অবিচার করবে অনিন্দ্যের সঙ্গে? বেচারার তো আসলেও কোনো দোষ নেই।

অনীলা নিজের মনেই পাগল হয়ে যায় ভাবতে ভাবতে। সমাজ তার এমন ভাবনা মেনে নিতে প্রস্তুত তো নয়। সে নিজেও কি প্রস্তুত? জানেও না সে কী করতে চায়? কোথায় যেতে চায়?

না, কারও কাছে সে যেতে চায় না, অতটুকু সে জানে। সে কি স্বার্থপর হয়ে যাচ্ছে? সেটা হওয়া কি অন্যায়? নিজের মত, নিজের টার্মে সে কি বাঁচতে চাইতে পারে না?
পরক্ষণেই প্রবোধ দেয় নিজেকে, কী পাগলের মতো আবোলতাবোল ভাবছে? এও কি হয়? সে কী করে তার জীবনের সঙ্গে জড়িয়ে যাওয়া, অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে যাওয়া সত্তাগুলোকে কষ্ট দিতে পারে? এতগুলো জীবন তার জীবনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত! চাইলেই খামখেয়ালি হওয়া যায়? সংসারের দায়, ভালোবাসার দায় অস্বীকার করা যায়?

চায়ের কাপের চা শেষ করে অনিন্দ্যকে জিজ্ঞাসা করে, আজ দুপুর কী খাবে সে? টেবিল ছেড়ে উঠে পড়ে রান্নার জোগাড় করবে বলে। আজ নাহয় অনীলার মন খারাপ কেউ না বুঝুক! আরও একটা দিন এভাবেই ক্যালেন্ডারের পাতা থেকে হারিয়ে যাক। আরও একটা দিন নাহয় কমেই গেল অনীলার জীবন থেকে! সে যে কাউকে অসুখী করতে জানে না। না জেনে, না বুঝে তাও সে নিশ্চয়ই প্রিয়জনদের দুঃখী করে। যদিও তা তার উদ্দেশ্য নয়। সুখ কী, জানা বরং না–ই হলো তার!

*দূর পরবাসে [email protected] এ লেখা পাঠাতে পারবেন।