অনন্তযৌবনা বসন্তের প্রারম্ভে ইস্টারের স্লোভেনিয়া
এপ্রিল মাস।
ইউরোপে বলতে গেলে বসন্ত এসেই গিয়েছে। কয়েক দিন আগেও রাস্তার ধারে নির্জীব আর প্রাণহীনভাবে যেসব গাছ পড়ে ছিল, এপ্রিল আসতে না আসতে একেবারে অবিশ্বাস্যভাবে গাছগুলো ভরে উঠেছে সবুজ কচি পাতায়।
কেউ বিশ্বাস করবে না কয়েক দিন আগেই প্রকৃতির প্রাণের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া ছিল দুষ্কর; এপ্রিল আসতে না আসতেই প্রকৃতি যেনও একেবারে নতুন প্রাণ ফিরে পেয়েছে। চারদিকে পাখিদের কলতান, মৌমাছিগুলো যেনও ছুটে চলেছে আপন গতিতে ফুল থেকে পুষ্পরস সংগ্রহ করতে। রোদেলা ভোরের বাতাস সত্যি মৃদুমন্দ, এক চিলতে বসন্তের রোদ যেন পৃথিবীর সবচেয়ে দুর্লভ হীরার টুকরো থেকেও দামি।
ইউরোপে বসন্ত যেন সত্যি অসাধারণ, ব্যাকরণের কোনো উপমা দিয়ে তার সৌন্দর্য বলে বোঝানো যাবে না।
প্রকৃতিতে বসন্তের রং লাগলেও পুরো পৃথিবীর মতো ইউরোপে এখনো মানুষের মন যেনও সেই রিক্ত শীতের দিনের তুষারে মুড়ে রয়েছে। স্লোভেনিয়াও তার ব্যতিক্রম নয়। স্লোভেনিয়ার ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব পাবলিক হেলথ প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী এখন পর্যন্ত স্লোভেনিয়াতে প্রাণঘাতী করোনাভাইরাস দ্বারা সংক্রমিত হয়েছেন ১ হাজার ২০০ জনের বেশি। স্লোভেনিয়াতে প্রাণঘাতী করোনাভাইরাসের সংক্রমণের ফলে মৃতের সংখ্যা দাঁড়াল ৪৭ এবং এখন পর্যন্ত সুস্থ হয়ে বাসায় ফিরেছেন ১৪৫ জন। চারদিক যেখানে অন্ধকারাচ্ছন্ন, নিষ্ঠুর করোনাভাইরাসের ভয়াল থাবায় একে একে যেখানে অনেকগুলো প্রাণ ঝরে যাচ্ছে, পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে ঠিক এমন একটি দুর্যোগকালে স্বভাবতই সবাই অনেকটা ভীতসন্ত্রস্ত। তবু মানুষ বাঁচে আশায়, শত বিপর্যয়ের মধ্যেও এক টুকরো আনন্দকে উপজীব্য করে সে চায় সামনে এগিয়ে যেতে।
মার্চের শেষ দশক থেকে আরম্ভ করে এপ্রিল। বসন্তের এ আগমনী মুহূর্তে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের খ্রিষ্টধর্মাবলম্বী মানুষেরা ইস্টার উৎসবে মেতে ওঠেন। ক্যাথলিক চার্চে বিশ্বাসী খ্রিষ্টধর্মের মানুষদের কাছে বড়দিন বা ক্রিসমাসের পর ইস্টার সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব। ক্রুশবিদ্ধ হয়ে মৃত্যুবরণের তিন দিন পরে মৃতাবস্থা থেকে খ্রিষ্টধর্মের প্রবর্তক যিশুখ্রিষ্টের বেঁচে ওঠা তথা পুনরুত্থানের অলৌকিক ঘটনাটিকে স্মরণ করার জন্য খ্রিষ্ট সম্প্রদায়ের মানুষ এ ইস্ট উৎসব পালন করেন। ইস্টারকে বিবেচনা করা হয় পুরোনো জীবনের অবসানের পরে নতুন জীবনের শুরুর প্রতীক হিসেবে। বাসাবাড়ি থেকে আরম্ভ করে রাস্তাঘাট, শপিং মল—সবকিছু সুসজ্জিত করা হয়। তবে ইস্টারের মূল আনুষ্ঠানিকতা থাকে বানি কিংবা ছোট আকৃতির একধরনের খরগোশকে ঘিরে। ইস্টারের সব সাজসজ্জার কেন্দ্রবিন্দু এ বানিকে ঘিরে; যদিও আধুনিক কালে বানির পাশাপাশি স্টার এগ নামে আরও একটি নতুন ডেকোরেশন সিম্বলের প্রচলন ঘটেছে। এমনকি শপিং মল বা বেকারিগুলোতে এ সময় বানি আকৃতির চকলেট বিক্রি করা হয়।
ইউরোপিয়ানদের কাছে বানি অত্যন্ত আদরের প্রতীক এবং খরগোশের বাচ্চা জন্ম দেওয়ার সঙ্গে বসন্তের মতোই নতুন এক আগমনী বার্তা ও উদ্যমতার সম্পর্ক বিবেচনা করা হয়। বছরের এমন সময় উদ্যাপিত এ ইস্টার উৎসবের মূল আকর্ষণ থাকে এ বানিকে ঘিরে।
এ বছর ইস্টার উৎসবের জন্য ১২ এপ্রিল দিনটিকে বেছে নেওয়া হয়েছে। ২১ মার্চ থেকে ২৫ এপ্রিল যেকোনো এক রোববারকে ইস্টার উৎসবের জন্য বেছে নেওয়া হয়। কোন রোববার নির্বাচিত হবে এ ইস্টার উৎসব পালনের জন্য, সেটা নির্ভর করবে আকাশের চাঁদের ওপর। বছরের এ সময় যখন ভরা পূর্ণিমা থাকবে, তার কাছাকাছি কোনো রোববারকে বেছে নেওয়া হবে ইস্টার সানডে উৎসবের জন্য।
যদিও ইউরোপের অন্যান্য অনেক দেশের মতো স্লোভেনিয়ায় মানুষ এখন সে অর্থে আর ধর্ম পালন করে না, তবুও ক্রিসমাস কিংবা ইস্টার ধরনের উৎসবের সময় আনুষ্ঠানিকতার দিক থেকে কোনো ধরনের কার্পণ্য রাখা হয় না। পরিবারের সব সদস্য এ সময় একত্র হন। ক্রিসমাসের মূল আয়োজন থাকে ডিনারকে (রাতের খাবার) ঘিরে আর ইস্টারের মূল আয়োজন থাকে ব্রেকফাস্ট বা সকালের নাশতাকে ঘিরে। স্লোভেনিয়ানরা পারিবারিক জীবনের প্রতি অনেক বেশি মাত্রায় শ্রদ্ধাশীল এবং এখানে ছুটির দিন মানেই সবকিছুকে ভুলে পরিবারকে নিয়ে সময় কাটানো। ইউরোপীয় ইউনিয়নের অন্তর্ভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে স্লোভেনিয়াতে এ কারণে বিবাহবিচ্ছেদের হার সবচেয়ে কম বলে বেশ কিছু গবেষণায় প্রকাশিত হয়েছে।
তবে এ বছর ইস্টারের আনুষ্ঠানিকতা অনেকটাই শূন্যতা দিয়ে গাঁথা। এ কারণ হচ্ছে পৃথিবীর অন্যান্য দেশের মতো স্লোভেনিয়াতেও বিস্তার লাভ করা প্রাণঘাতী করোনাভাইরাসের প্রভাব। তবু মানুষের উৎসাহ থেমে নেই। গত ১৯ মার্চ থেকেই সম্পূর্ণ স্লোভেনিয়া জরুরি অবস্থার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। তবুও বসন্তের আগমনের সঙ্গে সঙ্গে ইস্টার উৎসবকে ঘিরে মানুষ চাইছে নতুন কোনো আশার আলো খুঁজে পেতে।
মধ্য ইউরোপের অন্যান্য দেশের মতো স্লোভেনিয়াতে ইস্টারকে স্বাগত জানানো হয় পোটিছাকে ঘিরে। পোটিছা হচ্ছে এক বিশেষ ধরনের পেস্ট্রি রোল। ভেতরে থাকে ওয়ালনাট বা আখরোটের পুর। তবে অনেক সময় টাররাগোন নামক এক বিশেষ ধরনের দ্বিবর্ষজীবী গাছের পাতা কিংবা কোয়ার্ক নামক এক বিশেষ ধরনের দুগ্ধজাত দ্রব্য অথবা হেজেলনাট কিংবা মিষ্টিকুমড়ার বিচি বা পোস্তদানা ব্যবহার করেও ভেতরের পুর দেওয়া হয়। তবে বেশির ভাগ সময় ওয়ালনাট ব্যবহার করা হয়। ময়দা, ডিম ও বাটারের সহযোগে তৈরি খামিরের ভেতর মিষ্টিজাতীয় ইস্ট দিয়ে গাছের গুঁড়ির আকৃতির খামিরের তৈরি করা হয় এবং এর ভেতর বাটার ও ওয়ালনাটের পুর দিয়ে ওভেনে বেক করা হয়। এভাবেই তৈরি হয় পোটিছা।
মার্চের শেষ থেকে এপ্রিলজুড়ে স্লোভেনিয়াতে মানুষের খাবারের তালিকায় প্রথম স্থান দখল করে থাকে পোটিছা। বেকারিগুলোয় এ সময় পোটিছা বিক্রির ধুম পড়ে যায়। কনফেকশনারি দোকানগুলো পোটিছার বিজ্ঞাপনে ছেয়ে যায়। ইস্টারের দিন সকালে তাই পরিবারের সবাইকে নিয়ে আড়ম্বরের সঙ্গেই স্লোভেনিয়াতে সবাই এ পোটিছা খায়। পোটিছার সঙ্গে অন্যান্য ডেজার্ট আইটেমও থাকে সকালের নাশতায়। এ ছাড়া থাকে বিভিন্ন ধরনের পনির, বাটার, পাউরুটি, সেদ্ধ ডিম, দুধ, সালাদ, কয়েক ধরনের সসেজ ও সেলামি, বিভিন্ন ধরনের ফল ও ফলের তৈরি জুস এবং জ্যাম, মধু এবং মাংসের পাতলা স্লাইস। প্রতীচ্যের ব্রেকফাস্ট বলতে যা বোঝায় আরকি। ছোট বাচ্চাদের অনেক সময় দেখা যায় বিভিন্ন ধরনের কস্টিউমে সজ্জিত হয়ে বিভিন্ন বাড়িতে ছুটে যেতে। সাধারণত, বাচ্চারা এ সময় বাড়িতে এলে তাদের বিভিন্ন ধরনের চকলেট উপহার দেওয়া হয়।
এ ছাড়া ইস্টারের দিন বাচ্চাদের আগ্রহ থাকে ডিমযুদ্ধ নিয়ে। ইস্টার সানডের ঠিক আগের শুক্রবারে ডিম কেনা হয়। ডিম সেদ্ধ করে বিভিন্ন রঙে রঞ্জিত করে রোববারের জন্য অপেক্ষা করা হয়। ইস্টার সানডের সকালে বাচ্চারা ডিমযুদ্ধ খেলে। প্রথমে একজনের ডিম দিয়ে অন্যজনের ডিমকে আঘাত করতে হয়। এরপর প্রতিপক্ষ আবার তার ডিমে আঘাত করবে। যার ডিম বেশি আঘাতপ্রাপ্ত হবে, সেই আগে ডিমটি খাবে। এ ছাড়া ইস্টারের বিশেষ রান্নার মধ্যে থাকে বিভিন্ন ধরনের ফিশ গ্রিল এবং পাশাপাশি ফিশ স্যুপ।
করোনাভাইরাস পরিস্থিতির কারণে এ বছর ইস্টার উৎসব আয়োজনে ভাটা পড়েছিল। স্লোভেনিয়ার অনেক মানুষের বিশ্বাস সদ্য আগত চিরযৌবনা বসন্তের মতো নতুনের বার্তা নিয়ে দুয়ারে কড়া নেড়েছে ইস্টার উৎসব। এ উৎসবের পর খুব শিগগির পৃথিবীর অন্য দেশের মতো স্লোভেনিয়াতেও পরিস্থিতির উন্নতি ঘটবে। খুব শিগগির সবকিছু আবার নতুন উদ্যমে ফিরে যাবে চিরচেনা রূপে।
*লেখক: শিক্ষার্থী, ব্যাচেলর অব সায়েন্স ইন ফিজিকস অ্যান্ড অ্যাস্ট্রোফিজিকস, ইউনিভার্সিটি অব নোভা গোরিছা, স্লোভেনিয়া।