অধ্যবসায় মানুষকে লক্ষ্যে পৌঁছায়

অনাগত ভবিষ্যতের জন্য জায়গা ছেড়ে দিতে হয়। পৃথিবীর ধারণ ক্ষমতা যতটুকু, তার জন্য জায়গা খালি করাই নিয়ম। ম্যালথাসের জনসংখ্যা তত্ত্বেও তা বলা ছিল। প্রকৃতি তার আপন প্রয়োজনে প্রাকৃতিক দুর্যোগ দিয়ে কীভাবে জনসংখ্যা হ্রাস করে থাকে, তা যুগে যুগে দেখেছি। বর্তমানে সেই সময়টাই পার করছি আমরা।

মানুষের জীবন ক্ষণস্থায়ী। এ জীবনে মানুষ নিজের জীবনের সব প্রচেষ্টা কাজে লাগিয়ে অর্জন করে খ্যাতি, সুখ, স্বপ্ন। সবাই যে সফল হয়, তা কিন্তু নয়। সফলতা আসতে আসতে কেউ হোঁচট খায়, পিছলে পড়ে। অনেকটা শিশুবেলায় হাঁটতে শেখার মতো। হাঁটতে হাঁটতে পড়ে যায়, ব্যথা পায়, আবার উঠে দাঁড়ায়, দৌড়াতে শিখে। পড়ে গেলেও উঠে দাঁড়িয়ে যেমন দৌড়াতে শিখে তেমনি কখনো সাফল্য না আসলেও ভেঙে পড়লে চলে না। সফল হওয়ার জন্য চেষ্টা করতে হবে।

একটা গল্প বলি। আমার ভাইয়ের ছেলে রাঈদ লেইস। মেট্রোপলিটন ইউনিভার্সিটিতে আইন বিষয়ে অনার্স শেষ করে মাস্টার্স করেছে। তার পারদর্শিতা ব্যাডমিন্টনে।

২০১৬ সালে আন্তঃবিশ্ববিদ্যালয় প্রতিযোগিতা চলাকালে হঠাৎ এক দুর্ঘটনায় পায়ের হাঁটুর কাছে লিগামেন্ট ছিঁড়ে গিয়েছিল। তবে প্রথমে বুঝতে পারেনি। ওই অবস্থা নিয়ে খেলা শেষ করে রানারআপ হয়। পরে হাসপাতালে গেলে ডাক্তার বললেন, সার্জারি লাগবে। সার্জারি হয়। ভেঙে পড়েনি। ছয় মাস রেস্টে ছিল। তারপর আবার খেলা শুরু করেছে।

২০১৮ সালে আন্তঃবিশ্ববিদ্যালয় ব্যাডমিন্টনে চ্যাম্পিয়ন হয়। ২০১৯ সালে হয় রানার আপ। ২০২০ সালে সারা দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে আবারও চ্যাম্পিয়ন হয়েছে। সুতরাং ফোকাস আর অধ্যবসায় মানুষকে তার লক্ষ্যে পৌঁছে দেয়।

নদীভাঙা পরিবার, যারা বারবার ভাঙনের পরও ঘর বাঁধে। নতুন উদ্যম নিয়ে আবার উঠে দাঁড়ায়। এক পরিবারকে জানি যাদের তিন চারবার বাড়ি ভেঙে নদীতে ভেসে গেছে। এমনকি চাষের জমি–জায়গা সব। আমরা তা ভাবতেও পারি না। কিন্তু তারা আবার নতুন করে বাঁচার স্বপ্ন বুনেছে। আবার ঘুরে দাঁড়িয়েছে।

মানুষ পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিমান প্রাণী। আল্লাহ মানুষকে বুদ্ধিমত্তা দিয়ে সৃষ্টি করেছেন। একটা প্রামাণ্যচিত্র দেখলাম। হাত–পাবিহীন মানুষ অবলীলায় সবকিছু নরমাল মানুষের চেয়ে দ্রুততার সঙ্গে করে চলেছেন।

১৯৭১ সালে আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধ হয়েছিল। দেশ স্বাধীন করতে সরাসরি যুদ্ধে যারা যোগ দেন, তাদের বাড়িঘর আগুন লাগিয়ে ভেঙে গুঁড়িয়ে দেয় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী। আমরা তখন অনেক ছোট। আমাদের বাসা থেকে এক শ গজের ভেতর ইশতিয়াক রুপুর বাসা। আমাদের পুকুরপাড়ে দাঁড়িয়ে একদিন দেখলাম আগুন জ্বলছে। না তারও আগে তাঁরা চলে গিয়েছিলেন গ্রামে। একদিন দেশ স্বাধীন হলো। তাঁরা ফিরলেন। বাড়িঘর কঙ্কালসম দাঁড়িয়ে। আবার ঘরদোর তৈরি করলেন।

জীবনের প্রয়োজনে জীবনকে মানুষ সাজায়। গড়ে তোলার পর হঠাৎ ভেঙে গেলে কষ্ট হয়। জীবনের প্রয়োজনে আবার নতুন করে গড়তে হয়। তখন প্রয়োজন উদ্যম। প্রাণপণ শক্তি, সাহস আর মনোবল। আজকাল অনেকে অল্পেই ভেঙে পড়েন। মাদকের আশ্রয় নেন। আত্মহত্যা করেন।

সুশান্ত সিং রাজপুত। গত বছর করোনা নিয়ে সবাই যখন উৎকণ্ঠায়, সে সময় আত্মহত্যা করলেন। এমন তরতাজা যুবক আমার প্রিয় অভিনেতা। আত্মহত্যা কেন করলেন, আজও বুঝে উঠতে পারিনি। কেন যেন মনে হয়, কেউ তাঁকে হত্যা করেছে। হতে পারে, নাও পারে। সময়ের সুসন্তানদের বলব, নিজেকে শক্তিমান করে তোলেন। আপনার পৃথিবী আপন মহিমায় মহিমান্বিত করুন। অন্যের সঙ্গে প্রতিযোগিতা নয়, বরং নিজের মতো করে সাজিয়ে তুলুন নিজের ভুবন। নিজের পায়ে দাঁড়ানোর পর দুর্বল কারও জন্য হাত বাড়িয়ে দিন।

আমার আজকের লেখার মূল উদ্দেশ্য হলো, বিপদ বা বাধা কখনো বলে–কয়ে আসে না। আসলে ভেঙে না পড়ে সাহসের সঙ্গে মোকাবিলা করতে হবে। কাপুরুষের মতো নয়, সাহস ও শক্তি নিয়ে প্রতিহত করতে হবে।

আমি যখন কোনো বিপদে পড়ি, চোখ বন্ধ করে তিনটি শক্তির অস্তিত্ব অনুভব করি। সবার ওপরে মহান আল্লাহতায়ালা। তারপর আমার আব্বা আর মা। মহাবিপদও মেনে নিই। কারণ আল্লাহ যা দেন, তা ভালোর জন্য। এই শিক্ষা পেয়েছি পরিবার থেকে। কষ্ট আমারও হয়। সাধারণত দিন কেটে যায় কাজে কাজে। রাত নামে, কষ্ট বাড়ে। তবু মেনে নিই। ভয়ানক কষ্ট যখন হয়, তখন আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখি হাজারো তারা। মিথের মতো মনে পড়ে আমার বাবা–মাও আকাশের তারা হয়ে আছেন। আব্বা যেন মৃদু হাসিমাখা মুখে বলছেন, মন খারাপ করো না বাবা, সব ঠিক হয়ে যাবে।