
বিকেল পাঁচটা। সারা দিন অফিস শেষে ফয়েজ বাসার সামনে পার্ক করে গাড়ি থেকে বের হওয়া মাত্রই অপর দিক থেকে আসা রমিজ ট্যাক্সিটা ফয়েজের ঠিক সামনে দাঁড় করিয়ে বলল, কী ভাই, আপনের ভাগিনা অন্তুরে দেখলাম বেশ আমোদেই আছে।
কেন সে আবার কী করেছে?
কী না করছে, ওইডা কন। হাইড পার্কে দেখলাম নেপালি এক মাইয়া লইয়া ঢলাঢলি করতাছে।
সারা দিনের ক্লান্তিতে মনের ওই স্থিরতা ছিল না ফয়েজের। চিৎকার দিয়ে রমিজের ট্যাক্সির ওপর যেন ঝাঁপিয়ে পড়ল।
ওই মিয়া! আমার ভাইগ্না কোথায় কোন মেয়ের সঙ্গে ঢলাঢলি করে ওই খবর রাখতে কী আপনেরে আমি নিয়োগ দিছি? আমার ভাইগ্নার ভালো-মন্দ আমি বুঝমু। আপনে কে?
অপ্রস্তুত রমিজ ফয়েজের এমন কঠিন আচরণ কল্পনাও করেনি। মিনতি জানিয়ে বলল, ভাই রাগ করেন কেন? আজ এই মেয়ে, কাল ওই মেয়ে দেখতে কেমন লাগে? এক হাজার ডলার ধার নিছে আজ দুই বছর। আপনেরে সম্মান করি তাই লজ্জায় কিছু বলি না। ধরে নিচ্ছি, ভাইগ্নারে এমনিই টাকা দিছি।
উত্তপ্ত কথাবার্তা শুনে বাসা থেকে শিরিন নেমে আসে।
স্ত্রীকে লক্ষ্য করে ফয়েজ বলল, এই শিরিন, তুমি রমিজ ভাইকে এক হাজার ডলার এনে দাও তো। ড্রেসিং টেবিলের ড্রয়ারে ক্যাশ আছে। আর এই রমিজ ভাই, আপনি ট্যাক্সিটা পার্ক করে বাসায় আসেন। মনটা ভালো না ভাই। কিছু মনে করবেন না।
আরে না ভাই। আপনার ভাইগ্না কী আমার ভাইগ্না হতে পারে না? টাকা চাইছে। দিছি। ফেরত দিতে হবে না ভাই।
শিরিন কিছু বলতে চাইলেও রমিজ আর কোনো দিকে না তাকিয়ে শাঁই করে ট্যাক্সিটা চালু করে চলে গেল।
ফয়েজ বাসায় এসে মুখ ভোঁতা করে স্টাডিরুমের বসে রইল।
কিছুক্ষণ পর শিরিন এসে বলল, এই তোমার কী হইছে? রমিজ ভাইকে এত বড় ধমক দিছ? ঘটনাটা কী...।
ফয়েজের মনটা আরও খারাপ হয়ে যাচ্ছে দেখে শিরিন তখনকার মতো সরে পড়ল।

দীর্ঘদিন অসুখে ভুগে ফয়েজের বড় বোন রানু মারা গেলে মাস পার হতে না হতেই অন্তুর বাবা আবার বিয়ে করে। তখন চার বছরের এই অন্তু। মা মরা ভাগিনাটা। ওকে কয়েক দিন পরপর না দেখলে ফয়েজের বুকটা যেন ভেঙে যায়। খেতে পারে না। ঘুমাতে পারে না।
ফয়েজ তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শেষ বর্ষের ছাত্র। ভগ্নিপতি আবার বিয়ে করছে শুনে ভাগিনাকে দেখতে ছুটে গেল। সকাল সাড়ে আটটা। ফয়েজ গিয়ে দেখল, অন্তু বারান্দায় বসে শুকনো রুটি খাচ্ছে। সারা মুখ–পায়ে ফোঁটা ফোঁটা লাল দাগ। রক্তাক্ত অবস্থা। ভাগিনার এই অযত্ন দেখে মনটা তার কেমন করে ওঠে। অকালে পরলোকগত বোনের কথা স্মরণ করে কান্নার উচ্ছ্বাস গলায় চেপে ধরে বলল, অন্তু মামা, কেমন আছ?
মামাকে দেখে অন্তু যেন প্রাণ ফিরে পেল। তখনো সব কথা বুঝিয়ে বলতে পারে না। মামা, আমি স্বপ্নে দেখছি...।
কোলে উঠে মামার গলা জড়িয়ে ধরে অন্তুর কথা যেন আর শেষই হয় না। হাত, পা, মুখটাও ফুলে আছে দেখে ফয়েজ বলল, মামা, তোমারে কি পিঁপড়া নাকি মশা কামড়াইছে?
মশা কামড়াইছে মামা। আম্মু মইরা গেছে। আমি অহন মাটিতে থাকি। খাটে মশারি আছে। আব্বু থাকে।
অতি কষ্টে চোখের জল চেপে ফয়েজ ভেতরবাড়িতে গিয়ে দেখল, অন্তুর বাবা নতুন বউকে নিয়ে ডিম ভাজি দিয়ে পরোটা খাচ্ছে। কিছুক্ষণ কথাবার্তা শেষে ফয়েজ অন্তুকে উদ্দেশ করে বলল, মামা, তোমাকে নিতে আসছি। চল আমার সঙ্গে।
সঙ্গে সঙ্গেই অবুঝ অন্তুর আনন্দ আর ধরে না। অন্তুর বাবা কাপড়-জুতা সব ঠিকঠাক করে একটি ব্যাগ গুছিয়ে দেন। ব্যাগটা কাঁধে আর অন্তুকে কোলে নিয়ে ফয়েজ ঘর থেকে বের হয়ে পড়ে। অকালে পরলোকগত তার বড় বোন রানুর তিল তিল করে গড়া এই সংসার। বাড়িটার সর্বত্র রানুর স্মৃতি। বেশ কয়েকটা পেঁপেগাছ, কলের পাশে লিচুগাছটা আর ওই জানালার সামনে আমড়াগাছটা-ফলের ভারে নুয়েপড়া এ গাছগুলো তাকে কী যেন বলতে চায়। এসব ভাবতে ভাবতে বাড়ি থেকে বের হয়ে কিছু দূর আসার পর হঠাৎ মনে হলো, তার দুলাভাই হয়তো পেছন থেকে তাদের গতিপথ লক্ষ করে চেয়ে আছে। ফয়েজ ফিরে তাকিয়ে দেখল, কেউ নেই তো ওই আঙিনায়। অথচ তার অসুস্থ বোন ভাইকে বিদায় দিতে ঠিক এ আঙিনায় দাঁড়িয়ে যত দূর দেখা যায় চেয়ে থাকত। অভাবের সংসার। তাও ভাইয়ের হাতে কয়েকটি টাকা গুঁজে দিয়ে বলত, ভাই, তুই খরচ করিস।
না, আজ আর কেউ নেই ওই আঙিনায়। তার মেজাজটা এবার বিগড়ে গেল। মনে মনে বলল, পঞ্চাশ বছইরা বলদ। বিয়া কইরা আনছে এক দামড়ি। চৌদ্দো পাতিলের ফ্যান খাওয়া ওর স্বভাব। আমার ভাইগনাটার খোঁজখবর করার সময় কী তার আছে?
কিরে অন্তু, স্বপ্নে কি দেখছ মামা?
ফয়েজের গলা আরও নিবিড়ভাবে জড়িয়ে ধরে অন্তু বলল, মামা, আমি স্বপ্নে দেখছি, আমি নানার কোলে বইস্যা রইছি। আম্মু আর তুমি আমার জন্য চকলেট নিয়া আসছ। ক্যাডবেরি চকলেট।
ঠিক আছে বাবা। তোমাকে এখনই চকলেট কিন্না দিমু।
এরপর অন্তুর আর বাড়ি ফিরে যাওয়া হয়নি। নানার বাড়িতে থেকেই চলল লেখাপড়া। মাস্টার্স শেষ করার পর ফয়েজ অস্ট্রেলিয়ায় চলে এলেও এখান থেকেই অন্তুর সব ধরনের তত্ত্বাবধান করেছে সে।
যা হোক ভাগিনা খুবই মেধাবী। এসএসসি, এইচএসসিতে খুবই ভালো রেজাল্ট। সবদিক থেকে ফয়েজ শক্ত দেয়ালের মতো ভাগিনাকে প্রতিহত করে চলেছে। দিয়েছে সব ধরনের সাপোর্ট। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার পর অন্তুর পড়াশোনা চলছে ভালোই। রেজাল্টও ভালো। তদুপরি দেশে ফোন দিলেই বিভিন্ন রকম কথা ফয়েজের কানে আসতে লাগল। ভাগিনার দোষ তেমন বড় কিছু না। একটু বেপরোয়া ধরনের। মেয়েদের প্রতি ওর মনে সহজাত সম্মানটুকু তৈরি হয়নি। সবার চোখ ফাঁকি দিয়ে গোপনে বিয়ে করে। আবার কখন যে এ বিয়ে ভেঙে যায় কেউ টের পায় না। ভালো রেজাল্টে খুশি হয়ে ফয়েজ ভাগিনাকে লেটেস্ট মডেলের একটা আইফোন দিয়েছিল। ফোনটা হাতে সারাক্ষণ মেসেজ চালাচালি আর চ্যাটিং চলতেই থাকে। মাঝেমধ্যে বাড়িতে এলে দেখা যায়, এলাকার অশিক্ষিত বখাটে যত গাঞ্জট্টি, যারা ফয়েজদের বাড়ির কাজের লোকটাকে দেখলেও এক শ হাত দূরে সরে পড়ে, ওই সব পোলাপানের সঙ্গে ওর গলায়-গলায় ভাব। এসব শুনে ফয়েজ একদিন বাড়িতে মাকে ফোন দিতেই মা কান্নাজড়ানো কণ্ঠে বললেন, বাবারে, এই নাতিরে নিয়া কত আশা। ওই দিন রউফ মিয়া আমার কাছে অনুরোধ করে গেছে চাচি আপনের এই নাতিরে সামলান। কলেজের সামনে দশ-বারোটা ছেলে ওকে ঘেরাও দিয়া মারধর শুরু করছে। আমার তো তখন দিশেহারা হওয়ার মতো অবস্থা। ছেলেগুলার হাতে-পায়ে ধরে অন্তুরে বাঁচায়ে আনছি। চাচি ফয়েজ ভাইকে বলেন, ভাগিনার যেকোনো দিন বিপদ ঘটতে পারে।
যা হোক, ফয়েজ তারপর অনেক চেষ্টা করে ভাগিনাকে স্টুডেন্ট ভিসায় নিজের কাছে নিয়ে আসে।
অন্তু এই প্রবাসে আজ দুই বছর। দেশে থাকতেই বিয়ে হয়েছিল তিনটা। এখানে একটা বউ নিয়ে এসেছিল, ওটা এখন আর নাই। বউসহ ভাগিনাকে ছয় মাস নিজের কাছে রেখেছিল ফয়েজ। তারপর একদিন সে কাউকে কিছু না বলেই চলে যায়। অন্তু অবশ্য তার এই মামাকে যমের মতো ভয় করে। এ বাসায় থাকতে তেমন কিছু চোখে পড়েনি, তাই ফয়েজ মনে মনে খুশি হয়ে ভাবছিল এবার আমার ভাগিনার মনে হয় সংসারে মন বসছে। একদিন যখন কাউকে কিছু না বলে চলে গেল, তখন বিষয়টা সহজভাবে নিতে না পেরে সে শিরিনকে ডেকে বলল, বদের বাচ্চা ওর বাপের মতো হইছে। আমার বোনের বাতাসটাও ওর মধ্যে নেই।
শিরিন একটা হালকা নিশ্বাস ছেড়ে বলল, ভিসা, প্লেন ভাড়া, টিউশন ফি-সব মিলিয়ে প্রায় বিশ হাজার ডলার খরচ। একটু ভাবেও না। তাও যদি শান্তিতে থাকত।
তবে আজ ফয়েজের কষ্টটা এখানে নয়। অন্তু তখন এইচএসসি পরীক্ষা দিয়ে ভার্সিটিতে ভর্তির প্রস্তুতি নিচ্ছিল। আচার-আচরণ উচ্ছৃঙ্খল। যা ইচ্ছা তা-ই করে বেড়ায়। তার চেয়েও সবচেয়ে কষ্টদায়ক বিষয় হলো, এই অন্তু ছোট বাচ্চাদের একেবারেই সহ্য করতে পারত না। অথচ ফয়েজ বাচ্চাদের মনভরে আদর করত। দেশে আসা যেন তার এ বাচ্চাদের টানেই। তাকে ঘিরে সারা দিন বাড়িতে বাচ্চাদের ভিড় লেগেই থাকত। ওই দিন সকালে ফয়েজ বারান্দায় বসে আছে। এ সময় প্রায় তিন বছর বয়সী পাশের বাড়ির একটা ফুটফুটে মেয়ে কাকা কাকা বলে তার দিকে আসছে, হাত দুটি বাড়িয়ে শিশুটিকে ফয়েজ কোলে নেবে, ঠিক তখনই কোত্থেকে অন্তু এসে মেয়েটিকে ঠাস করে এক থাপ্পড় মেরে সিঁড়িতে ফেলে দেয়। অন্য কেউ এ কাজ করলে ফয়েজ হয়তো তাকে ধরে আছাড় মারত। এত বছর পর দেশে এসে প্রিয় ভাগিনাকে তখনো সে বলতে পারছিল না কিছুই। প্রচণ্ড রাগ নিয়ন্ত্রণ করে ফয়েজ তখন মেয়েটিকে কোলে নিয়ে আদর করতে লাগল। মাথায় আঘাত পাওয়া শিশুটির কান্না আর কিছুতেই থামছে না দেখে সে অন্তুকে শুধু এইটুকুই বলেছিল, তোর অন্তরে মায়াদয়া নাই রে। তোর জীবনে শান্তি হবে না।
আজ ফয়েজের এ কথাটাই বারবার মনে পড়ছে। নিজেকেই ধিক্কার দিচ্ছে সে। আমার মা-মরা ভাগিনাটা। সে হয়তো বোঝেনি। ছোট্ট ওই মেয়েটিকে থাপ্পড় মেরে সিঁড়ির ওপর ফেলে দিয়েছে। তাই বলে কী ওকে এত বড় অভিশাপ দিয়ে আমিই-বা কোন ভালোটা করেছি?
(লেখক অস্ট্রেলিয়ার সিডনিপ্রবাসী)
ই-মেইল: ishaque 21 @hotmail. com