অজানা ফুলের গন্ধ
আন্তর্জাতিক ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটে (ইরি) এসেছিলাম ছয় মাসের একটা ট্রেনিংয়ে অংশ নিতে। থাকার ব্যবস্থা হলো ইরি ক্যাম্পাসের হারার হলে। হলের সঙ্গে লাগোয়া বড়সড় মাঠ। তার পরেই একেবারে কাছে দক্ষিণে ম্যাকিলিং পর্বত। পূর্ব দিকে অনেকগুলো নাম না জানা পর্বতের ঢেউখেলানো সারি। পূর্বের পর্বতগুলো আসলে একটা থেকে অন্যটা অনেক দূরে দূরে। তবে এখান থেকে মনে হয় একটার পেছনে অন্যটা। তার পেছনে আরও একটা গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে। তবে একটু নজর দিয়ে দেখলে বোঝা যায়, কাছের পর্বতগুলো গাঢ় সবুজ। তার পেছনেরগুলো ফিকে সবুজ। তার পেছনেরগুলো ছাই রঙা। তারও দূরেরগুলো কালচে। কয়টা পর্বত দেখা যাবে তা ঠিক হয় মেঘের দয়ায়। মেঘ এসে ঢেকে দেয় কখনো সবচেয়ে দূরের পর্বতটি। কখনো আরও একটি। আবার কখনো সবগুলো। মাঠের পাশে কাঞ্চনগাছের নিচে বসার শেড আছে। সেখানে বসলে উত্তরের লাগুনা বে থেকে হু হু করে ভেসে আসা বাতাসে উড়ে যাওয়ার অনুভব হয়। ক্যাম্পাসের বাইরে থাকা সাশ্রয়ী। তবে এই স্বর্গ ছেড়ে বাইরের ফ্ল্যাটে থাকব, এত বেরসিক আমি নই।
হারার হলে বিশাল একটি রুমে আমি একাই থাকি। তবে মাঝের এক মাস আমার রুমমেট হিসেবে এসেছিল আমার সহধর্মিণী ঊর্মি। রুমসংলগ্ন ব্যালকনিতে অবসরে বাইনোকুলার নিয়ে বসে থাকি। ম্যাকিলিং পর্বতের মাঝামাঝি উচ্চতায় ন্যাশনাল আর্ট সেন্টারের খয়েরি রঙা ছাউনিটা ভালোমতো দেখার চেষ্টা করি। পর্বতের গায়ের গাছগুলোয় লালচে ছোপ দেখলে উৎসুক হয়ে বাইনোকুলারে খুঁজি ওটি ফুল, নাকি ফল, নাকি লালচে পাতা! নিচের মাঠে বিকেলে চড়ুই পাখির খুব খেলাধুলা শুরু হয়। এখানের চড়ুইগুলো আমাদের চড়ুইয়ের চেয়ে আকারে বড়। লম্বা লেজ আর একটু বাঁকানো ঠোঁটের হয়। মাঠের আধা গজ ওপর দিয়ে এরা মাঠের এ মাথা থেকে ও মাথা উড়ে যায়। মাঠের সীমানা শেষ হলে একটু ওপরে উঠে ইউ টার্ন নেয়। তারপর আবার একই স্টাইলে মাঠের একটু ওপর দিয়ে উড়ে যায়। আমেরিকায় ফসলের জমিতে পেস্টিসাইড দেওয়ার জন্য ড্রোনকে ঠিক এভাবে উড়তে দেখেছি। তবে এই পাখিরা মনে হয় এভাবে মাঠের একটু ওপর দিয়ে উড়ে উড়ে খাওয়ার জন্য পোকা খোঁজে।
হলের নিচে ক্যাফেটেরিয়ায় খাই। রুচি বদলাতে চাইলে কেউ অল্পস্বল্প রান্নাও করতে পারবে। কমন কিচেনটিতে রান্না কম, আড্ডা চলে বেশি। সবচেয়ে বেশি আড্ডা ছিল বিড়ালের। সেখানে একটা বুড়ো বিড়ালি থানা গেড়ে বসে থাকত। তাকে ঘিরে থাকত তার বাচ্চারা, নাতি-পুতিরা। তারা অসংখ্য ও অদম্য। আমরা কেউ কিচেনে ঢুকলে, অনভিজ্ঞ নাতি-পুতিরা শুরুতেই ভয়ে দেয় ভোঁ–দৌড়। বাচ্চা-কাচ্চারা আশপাশে একটু সরে গিয়ে আবার ফিরে আসার পাঁয়তারা করতে থাকে। তবে ধাড়িটা একেবারে অনড় থাকে। কাউকে কোনো কেয়ারই করে না। এর-তার পায়ে গা ঘেঁষে, খাবারের জন্য ম্যাও ম্যাও করে। এদের নিয়ে সবচেয়ে বেশি বিরক্ত ইরানি ছেলে মাহদি। সে তার পিএইচডি গবেষণার কাজ ইরিতে করছে এবং সেই সুবাদেই হারার হলে আছে। কিচেনে গেলেই দেখতাম মাহদির ফরসা সুদর্শন মুখটা রাগে-বিরক্তিতে লাল হয়ে আছে। মারমুখী হয়ে সে বিড়াল খেদাচ্ছে আর গজ গজ করছে—তোদের এত খাবার দিই, তাও পায়ে গা ঘেঁষিস ক্যান, যা ভাগ! তবে মাহদির জন্য অনেক স্বস্তি নিয়ে কিছুদিন হলো কিচেনে দরজা বানিয়ে বিড়ালের আগমন ঠেকানো হয়েছে।
দক্ষিণ ভারতের ছেলে সুধাকর আর নেপালের কমল, ওরা এই হারার হলের সবচেয়ে সুখী রুমমেট। হরিহর আত্মার মতো একসঙ্গে তারা কিচেনে আসে। রান্না করে, খায় ও বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে বেড়ায়। কমলের কাছে শুনলাম, আমরা যাকে লাউ বলি, ওরা তাকে বলে লাউকা। আমাদের মসুর ডালকে ওরাও একই নামে ডাকে। দক্ষিণ ভারতের নরেশ আবার রাজনীতিতে খুব উৎসাহী। উত্তর ভারতীয় নেতারা যে দক্ষিণ ভারতবাসীদের নিয়ে একটুও ভাবেন না, সেটা আমাকে ঘণ্টা ধরে বোঝায়। ভোটের সময় তার পছন্দের প্রার্থী জিতবে কিনা সেটার চিন্তায় ছটফট করে। হলে বাংলাদেশি পিএইচডির স্টুডেন্ট আছে আবু বকর, মৌ আর এমরান। অসুখে–বিসুখে নানান প্রয়োজনে এদের উৎপাত করি। এরাও ছোট ভাইবোনের মতো ছোটাছুটি করে এসে ওষুধটা-খাবারটা দিয়ে যায়। আর সব জায়গার মতো এখানেও অসংখ্য চীনা ছাত্র আছে। এদের নাম আমার কিছুতেই মনে থাকে না। অবশ্য তাতে তাদের সঙ্গে আমার কিচিরমিচির করতে একটুও বাধা হয় না।
ক্যাম্পাসে আমার প্রিয় জায়গা হচ্ছে হলের নিচের বিন হাব। এই কফির দোকান আর সব দোকানের চেয়ে আলাদা। এসি রুমে কফি খাবার ব্যবস্থা আছে। আবার বাইরের পুলে সাঁতরানো রঙিন মাছের পাশে নিয়েও কফি খাওয়া যাবে। এ দেশি ছোট্ট বাবুই পাখিগুলো দোকানের পাশের ছোট্ট যে গাছগুলোয় বাসা বানাচ্ছে সেখানেও মগ নিয়ে বসার ব্যবস্থা আছে। যারা আড়াল চান, তাঁদের জন্য বাগানের অনেকটা ভেতরে আছে আরেকটি শেড রাখা। এই বিন হাবে প্রতিদিন মস্ত বড় মগভরা কাপাচিনো আমার চাই। এ ছাড়া বিভিন্ন উপলক্ষে বিশেষ বিবেচনায় আমার সেখানে যাওয়া হয়। যেমন, ল্যাবের কোনো জটিল সমস্যার কিনারা করতে পারছি না, চলে আসি বিন হাবে। মাথাব্যথা হচ্ছে, বিন হাবই তো সেটার নিশ্চিত দাওয়াই। দেশে ছোট ভাইয়ের চাকরি হয়েছে, চল যাই বিন হাবে। পরিবারের জন্য মনটা উদাস, লেট মি চিয়ার আপ, বিন হাব বিন হাব...ইত্যাদি। এখানে আমার নিয়মিত আনাগোনার কারণে আমাকে আর কষ্ট করে অর্ডার দেওয়া লাগে না। কাউন্টারে গিয়ে শুধু দাঁড়ালেই হয়। কাউন্টারের মেয়েটির নাম রিসেল। সে আমাকে দেখলেই হাসিমুখে নিয়মমাফিক আবৃত্তি করে, লার্জ কাপ কাপাচিনো, ভেরি হট। হাসি ফিরিয়ে দিয়ে আমি বলি, ইউ নো এভরিথিং ম্যাম!
ইরি ক্যাম্পাসে এসে একটা বেশ রোমাঞ্চকর ঘটনা ঘটল। আমার হাঁচিতে পাওয়া ফুলের গন্ধ রহস্যের আধাআধি সমাধান হলো। সমস্যাটা শুরু হয়েছে কয়েক মাস আগে। হাঁচি দিলেই আমি খুব অল্প সময়ের জন্য একটা ফুলের গন্ধে আচ্ছন্ন হয়ে যাচ্ছি। গন্ধটি আমার পরিচিত। কিন্তু কিছুতেই মনে করতে পারছি না ঠিক কোন ফুলের গন্ধ এটা। ঊর্মিকে ঘটনা বলতেই সে বলল, নিশ্চয়ই তোমার হরমোনে ইমব্যালেন্স হচ্ছে। হেসে তাকে বললাম, ‘এন্ডোক্রাইনোলোজি তোমার প্রিয় বিষয়, তাই সব সমস্যাই তুমি হরমোনে নিয়ে ঠেকাও।’ ঠাট্টা যতই করি, তার কথা যে ঠিক হতেই পারে সেটি আমার মাথায় থেকে গেল।
আমি বিষয়টা গুগল ভাইয়ার কাছে পাড়লাম। দেখলাম এ জাতীয় অভিজ্ঞতার ঘটনা একেবারে বিরল নয়। অনেকেই জানিয়েছেন যে তারা হাঁচিতে বিভিন্ন রকম গন্ধ পান। কেন এমনটি হয় তাতেও আছে বহুমত। তবে একজনের অভিজ্ঞতাটি বেশ মজার। তিনি বলছেন, তিনি একজন ইতালীয়কে জানেন, যিনি নাকে খড় দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে সারা দিন হাঁচেন। হাঁচলে নাকি শরীর অপিয়াম তৈরি করে। তিনি নাক খুঁচিয়ে অপিয়ামের আবেশে বুঁদ হয়ে থাকেন। তাঁর অকাট্য যুক্তি হচ্ছে বিনে পয়সায় পাওয়া সুখ আর সুখ কে ছাড়ে! যা হোক আমার অনুসন্ধান এই তথ্য পাওয়া পর্যন্তই থেমে ছিল।
বিষয়টা বীর বিক্রমে আবার জেগে উঠল ইরি ক্যাম্পাসে এসে। এক সন্ধ্যায় জগিং করতে করতে চলে গিয়েছি ইরি ক্যাম্পাসের ভেতর ওপেন ইউনিভার্সিটির কাছে। ফুটপাত দিয়ে যাওয়ার সময় হঠাৎই যেন একটা সুগন্ধি রাজ্যে চলে এসেছি। চার পাশ থেকে মম করে সুগন্ধ আসছে তো আসছেই। সেই হাঁচিতে পাওয়া এক পলকের গন্ধটি এবার এত দিন পর ধরা দিল বিরাট বিপুল রূপে। নিশ্চয়ই পাশের গাছগুলোর ফুলের গন্ধ। অন্ধকারে দেখতে পারছি না ফুলগুলো। কিন্তু বুঝে গেলাম, হাঁচিতে আমি যে গন্ধ পাই, এই ধূলির ধরণিতে তার বাস্তব উৎস আছে।
দু-তিন দিন পর ছুটির দিনে দুপুরবেলায় গেলাম সেই গাছগুলোর কাছে। হুম আসলেই ফুলে ফুলে ছেয়ে গেছে গাছগুলো। এই কদিনে ফলও এসে গেছে কিছু কিছু। আগেকার কিছু পাকা ফলও আছে গাছে। ফলগুলো পুঁতির মতো ছোট আর গোল, শুরুতে সবুজ থাকে, পরে ধীরে ধীরে লাল হয়, শেষে পাকলে কালচে হয়ে যায়। গাছের ছবি তুলে এনে দেখালাম আমাদের ল্যাবের সেকেন্ড বস জ্যাকুলিন ডিওনোরাকে। ছবিগুলো দেখিয়ে গাছটির পরিচয় জানতে চাইলাম। তিনি খুব উচ্ছ্বসিত হয়ে জানালেন, এটি বিগনি ফলের গাছ। এই ফলের এক শ একটা গুণ আছে। এটি দিয়ে তৈরি মদ দুনিয়া জয় করার সক্ষমতা রাখে। কিন্তু রহস্যময় কোনো কারণে এটা তেমন বিকোচ্ছে না। ফিলিপাইনও এটা থেকে তেমন আয় করতে পারছে না। তিনি তড়িঘড়ি করে আমাকে লিখে দিলেন ইউনিভার্সিটি অব লস বানোসের কোনো ল্যাবে গেলে এই মদের প্রস্তুত-প্রণালি দেখতে পাব, সংগ্রহও করতে পারব। আমি আর কথা বাড়ালাম না। জ্যাকুলিন আছেন তাঁর তালে। অবশ্য যে যার তালে থাকবে সেটাই স্বাভাবিক।
যা হোক হাঁচির গন্ধটি পরিচিত মনে হওয়াটা আমার মনের ভুল নয়। বাস্তব দুনিয়াতে এই গন্ধটি আছে, এই তথ্যটি আমার জন্য অনেকটা স্বস্তির। তবে মনে একটা খচখচানি রয়েই গেল। হাঁচির এই গন্ধটি অনেক আগে থেকেই আমার চেনা মনে হয়। কাজেই আমার মগজে জমা হয়ে থাকা গন্ধটি নিশ্চয়ই আমাদের দেশি কোনো ফুলেরই হবে। জানি না আমার জীবনের কোন অধ্যায়ে সে ফুলের কাছে নিবিড় হয়েছিলাম। ট্রেনিং শেষ হতে মাত্র আর কয়েকটি দিন বাকি। দেশে ফিরেই সেই চেনা গন্ধের অজানা ফুলটিকে এবার খুঁজব। কিন্তু খুঁজে পাব তো!
....
হিশাম আল রাব্বী: আন্তর্জাতিক ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট, ফিলিপাইনে অন জব ট্রেইনি হিসেবে কর্মরত।
ই–মেইল: <[email protected]>