অগ্নিযুগের অগ্নিপুরুষ

বরুণ রায়

সত্তরের নির্বাচনের কিছুদিন আগে সিলেট শহরে গোয়াই পাড়ার কোন এক বাসায় বরুণ রায়ের সঙ্গে আমার সাক্ষাৎ-পরিচয়। নির্দিষ্ট দিন সকালে খবরটি জানতে পারি। যার সঙ্গে কখনো দেখা হয়নি অথচ তাঁর প্রতি গভীর শ্রদ্ধা, যাঁর নীতি-আদর্শ, চিন্তা-চেতনায় অনুপ্রাণিত হয়েছি। অনুপ্রেরণার উৎস সে মহান মানুষটি দেখতে কেমন, কেমন কথা বলেন, কী নির্দেশ থাকবে আমাদের প্রতি—এমন হাজারো আগ্রহের কৌতূহল ছিল সেদিন সাক্ষাতের আগ মুহূর্ত পর্যন্ত। সেদিন বিকেল পাঁচটার সে মুহূর্ত আজও মনকে আলোড়িত করে।

বরুণ রায়ের জন্ম এক ঐতিহ্যবাহী ও আলোকিত জমিদার পরিবারে ১৯২২ সালের ১০ নভেম্বর। কিন্তু তাঁর জন্মস্থান তাঁর পিতৃভূমি সুনামগঞ্জের বেহেলী থেকে অনেক দূরে ভারতের বিহার রাজ্যের পাটনায়। তাঁর পিতামহ রায় বাহাদুর কৈলাস চন্দ্র রায় বিহার রাজ্যের শিক্ষা বিভাগের আন্ডার সেক্রেটারি ছিলেন। সেই সুবাদে বরুণ রায়ের বাবা–মা তাঁর পিতামহের কর্মস্থলে বসবাসকালে সেখানেই তাঁর জন্ম হয়। স্বাভাবিকভাবে তিনি বেড়ে ওঠেন এক সমৃদ্ধ উত্তরাধিকার নিয়ে। তাঁর বাবা করুণা সিন্ধু রায় ছিলেন বিরাট জমিদারির উত্তরাধিকার অন্যদিকে কৃষক দরদি। প্রথম জীবনে জমিদারি না করে শিক্ষকতায় নিবেদিত ছিলেন। পরে রাজনীতিতে নিজেকে নিবেদিত রাখেন। কলেজজীবনের বন্ধু ও সহপাঠী ছিলেন নেতাজি সুভাস চন্দ্র বসু। তাঁর সাহচর্যে তিনি স্বাধীনতা আন্দোলনে আগ্রহী হয়ে ১৯২১ সালে কংগ্রেসে যোগ দেন। তখন থেকে কৃষকদের দাবি নিয়ে সোচ্চার ছিলেন।

আসাম প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য হিসেবে করুণা সিন্ধু কৃষকদের প্রাণের দাবি প্রজাস্বত্বের অধিকার প্রতিষ্ঠা করেন। নিজে জমিদার হয়েও জমিতে প্রজাস্বত্বের দাবি আদায়ে কৃষকদের সংগঠিত করেন। সুনামগঞ্জসহ সিলেটের বিভিন্ন এলাকা থেকে কৃষকদের সংগঠিত করে প্রায় ৮৬ মাইল পথ পায়ে হেঁটে শিলং গণপরিষদে উপস্থিত হন। তখন তিনি আসাম গণপরিষদের সদস্য। তিনি প্রস্তাব আনেন গণপরিষদের ভেতরে আর কৃষকেরা দাবি তোলেন পরিষদের বাইরে। চাপের মুখে গণপরিষদ প্রস্তাব পাস করতে বাধ্য হয়। দাবি আদায় করে তবেই কৃষকদের নিয়ে দেশে ফেরেন। তখন থেকে প্রজাস্বত্বের নেতা হিসেবে করুণা সিন্ধু কৃষকদের মাঝে অমর হয়ে আছেন।

পরে সংগ্রাম আর আন্দোলনের অভিজ্ঞতায় তিনি কমিউনিস্ট মতাদর্শ গ্রহণ করেন। ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান হওয়ার পর কৃষক দরদি ত্যাগী এই নেতার বিরুদ্ধে পাকিস্তান সরকার গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করে। তখন তিনি আত্মগোপনে চলে যান। স্বাধীন পাকিস্তানে জীবনের বাকি দিনগুলো তাঁকে আত্মগোপনে কাটাতে হয়। আত্মগোপন অবস্থায়ই ১৯৪৯ সালে তাঁর মৃত্যু হয়। তাঁর সুযোগ্য সন্তান কমরেড বরুণ রায় তখন পাকিস্তানের কারাগারে। বাবাকে শেষ দেখার সুযোগও পাননি।

রায়বাহাদুর কৈলাস চন্দ্র রায়ের সুযোগ্য সন্তান করুণাসিন্ধু রায় আর করুণাসিন্ধু রায়ের সুযোগ্য ছেলে বরুণ রায়। বরুণ সিলেট ছাতকের মিডল ইংলিশ স্কুল থেকে প্রাথমিক শেষ করে বর্তমান ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার কসবা থানাধীন মোগরা হাইস্কুলে ভর্তি হন। সেখান থেকে ১৯৪২ সালে মেট্রিক (প্রবেশিকা) পাস করেন। তাঁর প্রাথমিক রাজনীতির হাতেখড়ি গণনাট্যের মাধ্যমে। বাল্য ও কৈশোরে স্বনামধন্য কমিউনিস্ট ও কৃষক নেতৃবৃন্দ, গণনাট্য সংঘের শিল্পীদের সঙ্গে পরিচয় ও মেলামেশার সুযোগ পান। বাবার সূত্রে এসব নেতা তাঁদের বেহেলীর বাড়িতে যাতায়াত করতেন। তিনি গণনাট্য সংঘের শিল্পীদের সংস্পর্শে থেকে গান শিখেছেন, গান গেয়েছেন। এরূপ পারিবারিক ঐতিহ্য ও সমৃদ্ধ উত্তরাধিকারের চেতনায় স্নাত হয়ে বরুণ রায় ব্রিটিশ ভারতে রাজনীতি শুরু করেছিলেন।

১৯৪৩ সালে সুনামগঞ্জ কলেজে আইএ ক্লাসে ভর্তি হন। এ সময় সিলেটসহ সারা দেশে মহাদুর্ভিক্ষ দেখা দেয়। একমাত্র হবিগঞ্জের বানিয়াচংয়েই ১০ হাজার মানুষ মৃত্যু হয়। দুর্গত এলাকায় সাহায্য ও সেবাকার্য পরিচালনার জন্য সিলেট জেলা কমিউনিস্ট পার্টি একটি স্কোয়াড গঠন করে। বরুণ রায় স্কোয়াডের সঙ্গে বানিয়াচংয়ে চলে যান। সেখানে তিনি স্কোয়াডে গণনাট্য সংঘের বিশিষ্ট লোকগীতি শিল্পী নির্মলেন্দু চৌধুরী, খালেদ চৌধুরীর সঙ্গে ত্রাণে ও গানে অংশ নেন।

ত্রাণ তৎপরতার একপর্যায়ে তিনি ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত হয়ে দীর্ঘদিন শয্যাশায়ী ছিলেন। অবশেষে ১৯৪৭ সালে আইএ পাস করে সিলেট এমসি কলেজে ভর্তি হন। কিন্তু ১৯৪৮ সালে বিএ টেস্ট পরীক্ষার আগে ভাষা আন্দোলন শুরু হলে আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েন। তমদ্দুন মজলিশের উদ্যোগে পীর হবিবুর রহমান, মজসুদ আহমেদ, বরুণ রায় গোবিন্দ পার্কে বাংলার সমর্থনে সভা ডাকেন। সভায় জেলা মুসলিম লীগ নেতা আজমল আলী চৌধুরীর গুন্ডাবাহিনী তাদের ওপর হামলা চালায়। মকসুদ আহমদকে অমানুষিক নির্যাতন করা হয়। বরুণ রায় কোন রকম সটকে পড়লেও জেলগেটের রাস্তায় হামলার শিকার হন। ঠিক একই সময়ে কুখ্যাত নানকার শোষণের বিরুদ্ধে সিলেট শহরে অনশন পালিত হয়। অনশনের সমর্থনে বরুণ রায় শহরে মিছিল ও গোবিন্দ পার্কে সভা করেন। সভা থেকে তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়। এই গ্রেপ্তারের ফলে বরুণ রায়ের লেখাপড়ায় স্থায়ী ছেদ পড়ে।

একটানা ’৫৩ সাল পর্যন্ত জেলে ছিলেন। সিলেট জেলে তিন বছর থাকার পর তাঁকে রাজশাহী জেলে নেওয়া হয়। সেখানে প্রখ্যাত বুদ্ধিজীবী ও রাজনীতিক সর্দার ফজলুল করিম, অজয় ভট্টাচার্য, সুরৎ পাল চৌধুরী প্রমুখের সঙ্গে পরিচয় ও ঘনিষ্ঠ হওয়ার সুযোগ পান। পাঁচ বছর পর সেখান থেকে মুক্তি পেলেও গ্রামের বাড়িতে তাঁকে অন্তরীণ রাখা হয়।

বরুণ রায় ২০ বছর বয়সে ১৯৪২ সালে কমিউনিস্ট পার্টির সদস্যপদ লাভ করেন। পাকিস্তান সৃষ্টির পর ১৯৪৮ সালে সিলেট জেলা ছাত্র ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। ১৯৫০ সালে সিলেট জেলা কমিউনিস্ট পার্টির প্রতিনিধি নির্বাচিত হন। ওই বছরই জেলা কমিটির সদস্য, ১৯৬৬ সালে জেলা সম্পাদক মণ্ডলীর সদস্য এবং ১৯৬৮ সালে কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য নির্বাচিত হন। এরপর থেকে প্রতিবারই এ পদে বহাল ছিলেন। এ ছাড়া কৃষক সমিতির জেলা ও কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ও সহসভাপতির দায়িত্বে ছিলেন।

বরুণ রায় ১৯৫৪ সালে প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচনে নজরবন্দী অবস্থায় কমিউনিস্ট পার্টির প্রার্থী হিসেবে বিপুল ভোটে জয়ী হন। এ সময় পৃথক নির্বাচন প্রথা চালু থাকলেও যুক্তফ্রন্টের সঙ্গে কমিউনিস্ট পার্টির সমঝোতা ছিল। নির্বাচনে তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী কংগ্রেসের যতীন ভদ্রসহ সবার জামানাত বাজেয়াপ্ত হয়। যুক্তফ্রন্টের নির্বাচনে কমিউনিস্ট পার্টি ১০টি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে ৪টিতে জয়ী হয়। নির্বাচিতদের মধ্যে বরুণ রায় ছাড়া অন্য তিনজন হলেন—চট্টগ্রাম থেকে পূর্ণেন্দু সেন ও সুধাংশু বিমল দত্ত এবং রংপুর থেকে অভয় বর্মণ। এ নির্বাচনে মুসলিম লীগের চরম ভরাডুবি হয়।

যুক্তফ্রন্টের নির্বাচনের পর ৯২ (ক) ধারা জারি হলে ব্যাপক ধরপাকড় শুরু হয়। সুনামগঞ্জ থেকে বরুণ রায় আবার গ্রেপ্তার হন। প্রতিক্রিয়াশীল শাসক গোষ্ঠী নির্বাচনের রায় বানচালের উদ্দেশ্যে ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইনের ৯২ (ক) ধারা অনুযায়ী নির্বাচিত পরিষদ ও মন্ত্রিসভা ভেঙে দেয়। গ্রেপ্তার হন শেখ মুজিবুর রহমান, মোহাম্মদ তোহা, দেওয়ান মাহবুব আলী, খাজা আহমদ, ইয়ার মোহাম্মদ, ইকবাল আহমদ, সিলেটের আবদুল হামিদসহ অনেকে। বরুণ রায়কে পাঠিয়ে দেওয়া হয় ঢাকা সেন্ট্রাল জেলে। সেখানে শেখ মুজিবসহ অন্যান্য নেতৃবৃন্দের সঙ্গে একত্রে ছিলেন এবং শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হওয়ার এবং কাছে থেকে জানার সুযোগ পান।

এই ঘটনার ২০ বছর পর ১৯৭৫ সালে গণভবনে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে বরুণ রায়ের সাক্ষাৎ হয়। তিনি বঙ্গবন্ধুকে তার বিয়ের দাওয়াত দিতে গিয়েছিলেন। তখন বঙ্গবন্ধু রাষ্ট্রপতি। বঙ্গবন্ধু তাঁকে দেখামাত্র চেনেন এবং তাঁর নাম ধরে সম্বোধন করে নিজের আসন থেকে উঠে আলিঙ্গন করেন।

পরে আবু হোসেন সরকারের সময় অন্যান্য বন্দীর সঙ্গে বরুণ রায়ও মুক্তি পান। কিন্তু মুক্তি পাওয়ার ৪/৫ দিন পর ধর্মঘটকে কেন্দ্র করে সিলেট বন্দরবাজার থেকে আবার তাঁকে গ্রেপ্তার করে নিরাপত্তার কারণ দেখিয়ে ঢাকা সেন্ট্রাল জেলে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। পরের বছর ১৯৫৬ সালে মুখ্যমন্ত্রী আতাউর রহমান খান ও মন্ত্রী শেখ মুজিব ঢাকা সেন্ট্রাল জেলে যান। সেখানে রাজবন্দীর মুক্তির প্রতীক হিসেবে বরিশালের রাজবন্দী বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ স্বদেশ বোসের হাত ধরে বাইরে নিয়ে এসে তাঁকে মুক্তি দেওয়া হয়। একই সঙ্গে বরুণ রায়ও ছিলেন। বরুণ রায়কে শেখ মুজিব সোজা সদরঘাট আওয়ামী লীগ অফিসে নিয়ে সংবর্ধনা দেন।

এই ঘটনার এক বছর পর ১৯৫৮ সালে ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খান ক্ষমতায় এলে আবার দেশব্যাপী গ্রেপ্তার শুরু হয়। বরুণ রায় নিজ বাড়ি থেকে গ্রেপ্তার হয়ে কুমিল্লা ও রাজশাহী জেলে পাঁচ বছর আটক থাকেন। শেষ দিকে তাকে নিয়ে যাওয়া হয় ঢাকা জেলে। সেখানে রণেশ দাশগুপ্ত, সিলেটের কৃষক নেতা তারা মিয়া, পাবনার রণেশ মৈত্রসহ আরও অনেকের সঙ্গে ছিলেন তিনি। ১৯৬৩ সালে ছাত্র আন্দোলন ও বন্দী মুক্তি আন্দোলনের চাপে ৫ বছর কারাভোগের পর মুক্তি পান।

সামরিক শাসন জারির ৬ বছর পর আইয়ুব খান ক্ষমতাসীন অবস্থায় দেশে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। বিরোধী দলগুলো মিস ফাতেমা জিন্নাহকে প্রার্থী করে নির্বাচনে অংশ নেয়। বি ডি মেম্বারদের ভোটে পরোক্ষ নির্বাচন হয়। নির্বাচনে অভূতপূর্ব গণজাগরণ সৃষ্টি হয়েছিল। কিন্তু প্রহসনের নির্বাচনে মিস জিন্নাহ পরাজিত হলে দেশব্যাপী আবার রাজনীতিবিদদের গ্রেপ্তার শুরু হয়। বরুণ রায় তখন আত্মগোপনে চলে যান। তখন থেকে আত্মগোপন অবস্থায় হবিগঞ্জ, মৌলভীবাজার, সুনামগঞ্জ ঘুরে ঘুরে ছাত্র-কৃষকদের সংগঠিত করেন।

১৯৬৮-৬৯ এর দিনগুলোতে মাত্র তিন দিন প্রকাশ্যে চলাফেরা করেন। মুক্তিযুদ্ধ শুরুর প্রথম দিনগুলোতে তিনি এবং প্রয়াত জননেতা পীর হবিবুর রহমান দক্ষিণ সুরমার কদমতলী, গোলাপগঞ্জের রফিপুর, রণকেলী প্রভৃতি স্থানে ঘুরে ঘুরে বৈঠক করে কর্মীদের প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দেন। একপর্যায়ে ভারতে পাড়ি দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের কাজে আত্মনিয়োগ করেন। তিনি ভারতের কলকাতা, আগরতলা, কৈলাশহর, শিলচর, করিমগঞ্জ, শিলং, বালাটসহ বিভিন্ন স্থানে কাজ করেন। সেখানে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জনমত গড়ে তোলেন। ন্যাপ, কমিউনিস্ট পার্টি ও আওয়ামী লীগের মধ্যে সমন্বয় ও ঐক্য রক্ষায় তার জোরালো ভূমিকা ছিল। তারপর ১৬ ডিসেম্বর বীরের বেশে সিলেট শহরে প্রবেশ করেন।

১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার মধ্য দিয়ে দেশে প্রতিক্রিয়াশীল মুক্তিযুদ্ধবিরোধী শক্তির পুনরুত্থান ঘটে। এ সময় থেকে দেশে প্রগতির ধারা অব্যাহত রাখা, মুক্তিযুদ্ধের সুফল ও অর্জন রক্ষা করা, সর্বোপরি মুক্তিযুদ্ধবিরোধী শক্তিকে প্রতিহত করার লক্ষ্যে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি ও প্রগতিশীলদের ঐক্য প্রতিষ্ঠায় নিরলস কাজ করেন।

১৯৮০ সালে জিয়াউর রহমানের আমলে চতুর্থ শ্রেণি কর্মচারীদের ধর্মঘটের অজুহাতে সিলেট শহর থেকে বরুণ রায়কে গ্রেপ্তার করা হয়। আড়াই মাস পর মুক্তি পান। এ সময় বিপজ্জনক ব্যক্তি হিসেবে তাকে ফাঁসির আসামির সেলে কড়া প্রহরায় রাখা হয়। সর্বশেষ ১৯৮৬ সালে সাংসদ নির্বাচিত হন। এরশাদ আমলে ’৮৭ সালে আবার গ্রেপ্তার হন।

বরুণ রায় সব সময় রাজনীতি করেছেন। শেষ জীবনে রাজনীতি থেকে অবসর নিলেও রাজনীতি তাঁকে অবসর দেয়নি। রাজনৈতিক নেতা বা সাংসদ হিসেবে পরিচিতির বাইরে বরুণ রায়ের আরও একটি পরিচয় আছে, সেটি হলো তিনি শিল্পীও ছিলেন।

উপমহাদেশের প্রখ্যাত গণসংগীত শিল্পী হেমাঙ্গ বিশ্বাসের গণনাট্য সংঘের সঙ্গে বরুণ রায়ের প্রথম জীবনের শুরু। সংঘের শিল্পী প্রখ্যাত লোকগীতি শিল্পী নির্মলেন্দু চৌধুরী, খালেদ চৌধুরী, মায়া দাস, হেনা দাস, শান্তা সেন, গোপেশ নন্দী, সন্ধ্যা লাহিড়ী প্রমুখের সঙ্গে গান গেয়েছেন, গান শিখেছেন। বিভিন্ন জনসভায় দাবি উঠত সলীল চৌধুরীর ‘বিচারপতি তোমার বিচার করবে যারা, আজ জেগেছে এই জনতা’, বাঁধ ভেঙে দাও বাঁধ ভেঙে দাও’, নজরুলের ‘আকাশে হেলান দিয়ে পাহাড় ঘুমায় ওই’ ইত্যাদি গান গাওয়ার দাবি উঠত।

বরুণ রায় পাকিস্তানি অন্ধকার যুগের এক নন্দিত জননেতা। মাতৃভূমি ও জনগণের কল্যাণে জীবন উজাড় করে আজীবন সৎ ত্যাগী ও নির্লোভ রাজনীতি করেছেন। জীবনের সুন্দরতম দিনগুলো জেল আর আত্মগোপনে কাটিয়েছেন। সমাজ ও পারিপার্শ্বিকতায় তিনি তারুণ্যের মতো করেই দেখেছেন। বার্ধক্যের দিনগুলোতেও তারুণ্যের উদ্যমে সচল ও গতিশীল থাকতেন। এ জন্য যুবক-তরুণেরা তাকে শ্রদ্ধায় ভালোবাসায় সিক্ত করেছে।

বরুণ রায় ছিলেন ভারতবর্ষ, ব্রিটিশ, পাকিস্তান, বাংলাদেশ তিনকালের একজন সজীব সাক্ষী। প্রতিটি কালকে প্রত্যক্ষ করেছেন প্রাজ্ঞ রাজনীতিকের সচেতন দৃষ্টিতে। এ জন্য তিনি অত্যন্ত সৌভাগ্যবান। আমরা যারা তাঁর রাজনৈতিক জ্ঞানে আলোকিত হয়েছি, আমরাও ভাগ্যবান ও গর্বিত।