আমার ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গেল
সদ্য দেশ থেকে ঘুরে এসেছি আমি। আসার পরপরই কাজে যোগ দিতে হয়েছে। আনন্দসাগর থেকে কঠিন বাস্তবে পা। এ কয়টা দিন কাজের ফাঁকে ফাঁকে টংদোকানের চা, রাস্তার পাশের ছোট্ট কড়াইতে ভেজে তোলা পিয়াজু আর বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা ভীষণভাবে মনে পড়েছে। টানা পাঁচ দিন কাজ করার পর আজকে একটা দিন ছুটি পেলাম। দেড় ঘণ্টা গাড়ি চালিয়ে লিটল ঢাকা রেস্তোরাঁয় চলে এলাম দুপুরের আগে আগে।
আমেরিকার মাঝে ছোট্ট করে তুলে আনা বাংলাদেশে। চায়ের সঙ্গে শিঙাড়া খাব, বিরিয়ানি সঙ্গে করে নিয়ে যাব আমার আর ছেলের জন্য।
শিঙাড়া আর চা নিয়ে বসেছি কোনার একটা টেবিলে। এমন সময় একটা মেয়ে এসে টেবিলের সামনে দাঁড়াল। বলল, আপনি ফারহানা আপু না? প্রথম আলোতে লেখেন? পেপার পড়ছিলাম, মুখ তুলে তাকিয়ে বললাম, তা লিখি মাঝেমধ্যে। ছবি দেখে বাস্তবের আমাকে চিনে ফেলেছেন? বাহ। মেয়েটা বলল, আপু, আমার নাম তোতন। আপনার সময় থাকলে এক কাপ চা খাব আপনার সঙ্গে আজকে। বললাম, চা নিয়ে বসে পড়ুন, তোতন।
তোতন চা নিয়ে এল, সঙ্গে পিঠা। খেতে খেতে বলল, নারী দিবসের ভাবনা কি আপনার? বললাম, আশপাশে কত কিছু যে নারীরা করেন সবার কল্যাণে, কেমন করে সেসব সাফল্যের কথা সবাইকে শুনিয়ে অনুপ্রাণিত করা যায়, সেটা শুধু এ বছর নয়, প্রত্যেক নারী দিবসেই চিন্তা করি। তোতন হাসল। তারপর বলল, তোমাকে ‘তুমি’ করে বলি, কেমন? এ ভাবনাগুলো উঁকি দেয় দেখেই তোমার কথা শুনে এত আপন আপন লাগছে। মনে হচ্ছে, একান্ত ব্যক্তিগত কিছু কথা তোমাকে বলি।
কী জানো, প্রায় ১০ বছর আগের কথা! সদ্য মাস্টার্স শেষ করে মা-বাবার পছন্দে বিয়ে করেছিলাম আমি। স্বামী আমেরিকার লস অ্যাঞ্জেলেস শহরে থাকত। বিয়ের পরপরই চলে এলাম এ দেশে। আমরা থাকতাম কোরিয়া টাউন বলে একটা জায়গায়। একই অ্যাপার্টমেন্টে আশপাশে আরও অনেক বাংলাদেশি পরিবার থাকত। দেশের জন্য মন খারাপ হলেও সবার সঙ্গে মোটামুটি মিলেমিশে সময়টা খারাপ কাটছিল না। সংসারের শুরুতে বাজার করা, রান্না করা—সবই ভালো লাগত। আমার নিজের সংসার। কিছুদিন পরই বুঝে গেলাম আমি মা হতে যাচ্ছি।
প্রচণ্ড ভয় লাগল! কেউ তো নেই সাহায্য করার জন্য আশপাশে। আমি খেতে পারি না, সব তরকারিতে অরুচি, তবু স্বামী গ্যাস স্টেশনে কাজ করে ক্লান্ত হয়ে ফিরলে খাবারটা তো দিতে হবে। তাঁর তখন নানান বিরক্তি, কেন খাবার ঠিকমতো রোজ রান্না করছি না, শরীর খারাপ করে ঘুমিয়ে থাকলেও বকা। কেন এত মুটিয়ে যাচ্ছি। কেন একটু সেজেগুজে থাকতে পারি না। কেন সারা ঘরে চুল পড়ে। শুনতে শুনতে নিজেকে মানুষ মনে হতো না।
চলল এভাবে নয় মাস। তারপর লিয়াম এল কোলজুড়ে। কী অপূর্ব দেবশিশু! আমার একান্ত নিজের পুতুল। কিন্তু ওর বাবা ওর সারাক্ষণ কান্নাকাটিতে বিরক্ত। ওর ঘুম হয় না। সময়মতো রান্না খাবার না পেলেই চিৎকার। প্রায়ই তখন বলত, কেন কাজ না করে বসে বসে খাচ্ছি। কিন্তু আমি ছাড়া আমার লিয়ামকে দেখার কেউ নেই। ওর বাবাকে কীভাবে বোঝাব?
তোতন চোখ মুছল, চায়ের কাপে কয়েকটা চুমুক দিল, তারপর বলে চলল, মাস তিনেক পরে লিয়ামের বাবা এসে বলল ছেলেসহ ঘর থেকে বেরিয়ে যেতে। আমি কাজ করি না, খেয়ে খেয়ে হাতি হয়েছি। হাতির খরচ জোগানো তার পক্ষে সম্ভব নয়। সকাল ১০টা বাজে তখন। ঝকঝকে রৌদ্রোজ্জ্বল একটা দিন। আমার সঙ্গে ছোট্ট একটা ব্যাগ, লিয়ামের কাপড়, ডায়াপার, নিজের অল্প কিছু কাপড় আর এত দিনে বাবার বাড়ির থেকে উপহার পাওয়া শেষ ৩০০ ডলার। আইনত এ দেশে থেকে যাওয়ার কোনো অবস্থা নেই। এতটুকু বলে তোতন পাকান পিঠটা খেল। আমি উৎকণ্ঠায় মারা যাচ্ছি কিন্তু ওকে তাড়া দিলাম না। এত ব্যক্তিগত কিছু অচেনা আমাকে সে বলছে, নিশ্চয় শেষটাও বলবে সে।
চোখের পানিটুকু তোতনের শুকিয়ে গেছে তখন। বলল সে, এক বছর চার মাসে এ দেশে বহুবার কেঁদেছি। এখন কী করব? একই ফ্ল্যাটে বাংলাদেশি কয়েকজন ছাত্রী থাকতেন। তাঁদের দরজায় গিয়ে কড়া নাড়লাম। ভাগ্যক্রমে একটা মেয়ে ছিলেন। ওনাকে বললাম আমার ঘটনা। বললাম, কোনোভাবে যদি দেশে চলে যেতে পারি, তাহলে মা–বাবা কি আর ফেলে দেবেন? উনি বললেন, তোতন, এ দেশে এসেই যখন পড়েছ, কিছু করার চেষ্টা করো। না পারলে আমি নিজে তোমাকে টিকিট কেটে দেব যখন পারব। তত দিন থাকো লিভিং রুমের ফ্লোরে। তাঁরা চারজন এলএসিসির (লস অ্যাঞ্জেলেস কমিউনিটি কলেজ) ছাত্রী। সবাই সানন্দে মেনে নিলেন আমাদের দুজনকে। ঠিক হলো মাস ছয়েক চেষ্টা করব বাঁচতে, জীবন গড়তে, না পারলে দেশে চলে যাব।
তাঁরা পরদিন বাসে করে এলএসিসি কলেজে নিয়ে গেলেন আমাকে। একজন কাউন্সেলর বুদ্ধি দিলেন টাইপিং আর কম্পিউটার প্রোগ্রামিং শিখতে। পাস করতে পারলে চাকরি আছে আর চাকরি পেলে এ দেশে থাকার ব্যবস্থা হবে আইনানুগভাবে। সেই কলেজে ভর্তির কাগজ দিয়ে লিয়ামকে ডে কেয়ারে রাখা যাবে, যাতে মা হিসেবে আমি পড়তে পারি। ভর্তির কাগজ নিয়ে গেলাম সোশ্যাল সিকিউরিটি অফিসে, লিয়ামের ডে কেয়ার, দুধ আর ডায়াপারের ব্যবস্থা হবে জানালেন তাঁরা। এখন একটা চাকরি শুধু দরকার।
দিন তিনেক পরে রাতে কাজ করতে হবে একটা গ্যাস স্টেশনে এবং ওরা লিগ্যালভাবে বসবাসের সনদ চাইবে না, জানলাম মেয়েগুলোর কাছ থেকেই। এরপর শুরু হলো বাসে করে লিয়ামকে নামানো, ক্লাস, পড়াশোনা, লিয়ামকে তোলা, গুছিয়ে মা আর ছোট্ট বাবার রাতে কাজ, দিনে তিন থেকে চার ঘণ্টা ঘুমানো। সপ্তাহে এক দিন ছুটি, বাজার আর রান্না করার চেষ্টা করতাম। কেমন ঘোরের মধ্যে সময় কাটত আমার। মেয়েগুলোর সঙ্গে আমার দারুণ বন্ধুত্ব হয়ে গেল। লিয়ামকে তাঁরাও ভীষণ ভালোবাসে। লিয়ামের বাবা কখনো খোঁজ রাখেনি, শুধু দেশে ডিভোর্স পেপার পৌঁছে গেছে শুনেছি। এভাবে ঝড়ের গতিতে দুই বছর কেটে গেল। ভালো ফল করে ডিপ্লোমা ডিগ্রি পেলাম, আপু। এরপর আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি।
দুই বছর পর এইচ ওয়ানে (চাকরি করার লিগ্যাল স্ট্যাটাসে) একটা কম্পিউটার প্রোগ্রামার হিসেবে কাজ পাই। সেই কাজ থেকেই আমার গ্রিন কার্ড আর আমরা সবাই আজকে প্রতিষ্ঠিত। দেশের যত বিপদে পড়া মেয়ে আসে লস অ্যাঞ্জেলেসে, আমরা সাহায্য করি নিজের পায়ে দাঁড়াতে। তুমি আমাদের কথা লিখবে তো? বলে তোতন ভিজিটিং কার্ড বাড়িয়ে দিল।
আমি ঝাপসা চোখে আঠারো শতকের একজন ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গেলকে (আঠারো শতকের নার্স, যিনি যুদ্ধে বহু মানুষকে সাহায্য করেছেন, নার্সদের আধুনিক সেবাদানের পদ্ধতি শেখানোর পথিকৃৎ, আলো হাতে পথ দেখিয়ে চলা যাঁর প্রতীক) দেখছি। বললাম, তোতন, নারী দিবসে তোমাদের কথা লিখব না তো কাদের কথা লিখব?