স্মৃতিহীন সেই দুটি বছর

অলংকরণ: মাসুক হেলাল

সম্ভবত ২০১১–এর এপ্রিল বা মে মাস। ইউনিভার্সিটির সেমিস্টার ফাইনাল পরীক্ষার মাঝামাঝি। সেদিন হিসাববিজ্ঞান আর মার্কেটিং দুটো পরীক্ষা একই দিনে। প্রতিটি পরীক্ষা দুই ঘণ্টার, মাঝখানে কিছুক্ষণ সময়ের বিরতি। আমরা দুই বান্ধবী, আমি আর জেনি যেদিকে যেতাম, দুজন সব সময় একসঙ্গে। তো, দুই পরীক্ষার মাঝখানে যে সময়টুকু, তাতে জেনি বলে, দোস্ত, চল, চা খেয়ে আসি। জেনি ইঞ্জিনিয়ারিং, আর আমার তখন বিবিএ চলে। সে আমার বিভাগ, বিষয়, কোনোটারই ছিল না এবং বয়সে ও জেনি আমার বছর দুয়েক বড় ছিল। কিন্তু যেখানে মানসিকতার মিল পাই, সেখানে আর বয়স আমার কাছে কোনো বিষয় না। পরবর্তী সময়ে জেনেছিলাম, আমাদের দুজনের আব্বুরাও বন্ধু ছিলেন। যাক সে কথা।

আমাদের দুজনেরই প্রিয় একটা রেস্তোরাঁ ছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছে। সেখানে দারুণ দুধ–চা করত। আমরা চা-নাশতা শেষ করে রিকশায় উঠে পাঁচ মিনিটের পথ গেছি (ভার্সিটি যেতে ১০ মিনিট লাগে), ঠিক এমন সময়ে বিপরীত দিক থেকে ধেয়ে এল এক ‘সাধারণ পরিবহন ৩ টন’ ট্রাক। ভাগ্য ভালো তিন টনের ছিল, বিরাট বড় ৫ টনের নয়। ট্রাকটি বোঝাই ছিল ইট। নির্মাণাধীন কোনো ভবনে যাচ্ছিল সেটি। আচমকা ধাঁই করে ধাক্কা মারে সেই ৩ টন, আমি ছিটকে পড়লাম রাস্তার ফুটপাতে পাথরের স্ল্যাবের ওপর। অন্য পাশ থেকে জেনি ও পড়ে গেল। আচমকা আঘাতে ঝিম ঝিম করে উঠল সারা শরীর। এরপর ভাইরে, আমার আর কিচ্ছু মনে নেই! মানে, নেই তো নেই! (পরে পরিবার থেকে শুনেছি, জেনি আমার ফোন থেকে আমার বান্ধবীদের কল করে, ঘটনাক্রমে আমার ড্রাইভারও কাছেই ছিল। সবাই একসঙ্গে অর্ধ-অচেতন এই আমাকে বাড়ি ফিরিয়ে এনেছিল। জেনি মেয়েটা নিজে যথেষ্ট জখম হয়েও আমাকে সেদিন ফেলে চলে যায়নি, এটুকু কোনো দিন ও ভুলব না)।

‘দূর পরবাস’-এ জীবনের গল্প, নানা আয়োজনের খবর, ভিডিও, ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]

পরদিন সকাল বেলা ঘুম থেকে উঠে দেখি মাথার পেছনে চাপ ধরা যন্ত্রণা। পরিবারের সবাইকে চিনতে পারছি সত্যি, তবে আগের দিন কি পরীক্ষা দিলাম, কী কী করলাম কিছুই আমার মনে নেই। কেবল আগের দিন কেন, গত সাত-আট মাসের কোনো স্মৃতি ছিল না আমার, মানে কিছুই না! মনে করতে গেলে মাথায় যন্ত্রণা শুরু! চিকিৎসক জানালেন, সাময়িক স্মৃতিহীনতায় আক্রান্ত হয়েছি আমি, মাথায় কোনো কিছুর তীব্র আঘাত থেকে। আমার সব চেয়ে প্রিয় যে বিষয়, পড়াশোনা, সেটি থেকে বেশ দীর্ঘ বিরতি চাই, অন্তত একটা বছর। পড়াতে পারব, কারণ নিজের আগের পড়া থেকে শেখানো আমার মস্তিষ্কে কোনো প্রভাব ফেলবে না, তবে নিজে শিখতে গেলে গোলযোগ বাঁধতে পারে। হায়রে এর পর টানা দুটো বছরের যুদ্ধ!

আমার দিন শুরু হয় ইনজেকশনে, সময় চলে হাজার রংবেরঙের ওষুধ আর সেই ওষুধের পার্শপ্রতিক্রিয়া সামলে। অবাক হয়ে লক্ষ করলাম, দেয়ালে টাঙানো নিজের আঁকা ছবি দেখে ভয়ে আঁতকে উঠছি আমি! যে মানুষটা কলম ছাড়া, বই ছাড়া বাঁচতে পারি না, সেই আমি কলম ধরলে হাত কাঁপে প্রচণ্ড! অক্ষরের গঠন ভুলে গেছি, নিজের হাতের লেখা, যা অতটা সুন্দর না হলে ও স্পষ্ট আলহামদুলিল্লাহ, সেই লেখা কাকের ঠ্যাং না চড়ুইয়ের ঠ্যাং কী যে হয়েছে জানি না! চিকিৎসক জানালেন, হঠাৎ দুর্ঘটনার ট্রমা এবং ওষুধ—দুয়ে একসঙ্গে হয়ে এ হেন জগাখিচুড়ি হয়ে গেছি আমি। কলম, তুলি, বই—আমার এসব না-মানুষ বন্ধুগুলোকে অনেকটা হারিয়ে, ডুবে গেছি তীব্র বিষণ্নতায়। তবে এখন? চিকিৎসক ভদ্রলোক জানালেন, তিনি আমায় পথ দেখবেন ঠিকই, তবে সেই পথে তিনি আমাকে নিয়ে চলতে পারবেন না, যদি আমি নিজেই নিজের ভেতর থেকে এটি ঠিক না করি। ছোট্টবেলার অভ্যাস, ফুলের মালা গাঁথা। একদিন হয়েছে কি, নিজেরই ভেঙে যাওয়া কোনো এক পুঁতির মালার প্রায় সব কটি দানা খুঁজে পেয়েছেন বাড়ির সাহায্যকারী নারীটি। কী হলো জানি না, খানিকটা সেলাইয়ের নরম সুতো হাতে প্যাঁচিয়ে নিয়ে সুচ ছাড়াই একখান মালা গেঁথে নিলাম এবং একটা ব্রেসলেটও এবং সেগুলো সব পরে চলে গেলাম ডাক্তারের কাছে। সপ্তাহে অন্তত দুবার ওনার চেম্বারে যেতাম। বিষণ্ন ওই সময়গুলোতে চুলে চিরুনি দিতেও ভালো লাগত না। তাই স্বাভাবিকভাবেই আমার গয়না দেখে ডাক্তার প্রশ্ন করলেন, কোথায় পেয়েছি? মন্দ লাগছে না কিন্তু মেয়ে তোমায়! ওই ব্রেসলেট একটা আমার জন্য আনবে? আমার মেয়েকে পরাব। যা চলে! এবার এই বয়স্ক ভদ্রলোকে কথা ফেলব কী করে? চলো, বানাই। দোকান থেকে সবকিছু কিনে কেটে বানিয়ে ফেললাম প্রায় একই রকম গয়না সেট। চিকিৎসককে দেওয়ার পরের ভিজিটে তিনি যখন ওই গয়না পরা মেয়ের ছবি দেখালেন, অজানা খুশিতে ভোরে উঠল মন। কেন যেন মনে হলো, একটুখানি শিখে দেখি তো। বাড়ির পাশেই কোনো এক বর্ষীয়ান প্রতিবেশী নাসরিন নাসির হরেক রকম প্রশিক্ষণ দিতেন। চলে গেলাম তাঁর কাছে, কেবল পুঁতির গয়না নয়, আরও বেশ কিছু ছোট ছোট প্রশিক্ষণ নিয়েছিলাম আমি। পুঁতির কারণেই মূলত, ধীরে ধীরে ওই হাতের কাঁপুনি নিয়ন্ত্রণে এল এবং গয়না বা ঝুড়ি বুনতে বুনতে মাথায় যে দোয়াই খেলত, সেটাই খানিকক্ষণ পড়ে নিতাম। এর কিছুদিন পর থেকেই পড়াতে শুরু করি। স্পোকেন ইংলিশ আর আইইএলটিএসের ফাঁকে একজন বিদেশিনী আদুরে ছাত্রী ছিল। অন্য কারও শেখার দায়িত্ব আমায় আস্তে আস্তে আত্মবিশ্বাসী করে তোলে, আলহামদুলিল্লাহ। দুটি বছরজুড়ে অনেক কষ্ট করেছি সত্যি, তবে এটাকে আমি আল্লাহর পক্ষ থেকে পরীক্ষা মনে করি। আর আল্লাহর দরবারে শুকরিয়া যে সেদিন ওই ট্রাকের কেবল ধাক্কার ধকলটুকু গেছে, আজ যদি ওই ট্রাক আমায় চাকা দিয়ে পিষে দিত, কী হতো তবে? সবকিছুর জন্য আলহামদুলিল্লাহ।

বি.দ্র.: বন্ধুতালিকায় আইইউবির বন্ধুরা যারা আছ, ওই দুর্ঘটনার পরে তোমাদের সঙ্গে তোলা আমার ছবি, অথবা তোমাদের দেওয়া উপহার থেকেই তোমাদের মনে পড়েছিল। যদি মনে হয় তুমি আমার কাছের কেউ ওই ২০১১-১২ সময় কার এবং তোমার সঙ্গে যোগাযোগ করা হয় না, তার মানে তুমি আমার স্মৃতি থেকে মুছে গেছ। হাজার চেয়েও মনে করতে পারি না প্রায় আট মাসের মুছে যাওয়া স্মৃতি। আমাকে তোমরা ক্ষমা করো।