অদ্ভুত ভালোবাসা
সাবওয়ে (মেট্রোরেল) উঠেছি। উদ্দেশ্য, কলেজ যাব। আমার একটি অদ্ভুত মিষ্টি সমস্যা আছে, আমি ট্রেনে উঠলেই ঘুমিয়ে পড়ি। প্রথম দিকে প্রায়ই দেখা যেত, ঘুমের কারণে আমি আমার স্টেশনে নামতে পারতাম না। ঘুম ভাঙলে দেখতাম, ট্রেন আমাকে নিয়ে চলে গেছে গন্তব্য ছেড়ে অনেক দূরে। পরে আবার ট্রেন বদলিয়ে গন্তব্যে আসতে হতো। তবে এখন আর এই সমস্যা হয় না। এখন কেমন করে জানি আমার মস্তিষ্ক স্বয়ংক্রিয়ভাবে আমাকে ঠিকই গন্তব্যের আগে উঠিয়ে দেয়।
আমি যথারীতি ট্রেনে বসে ঘুমাচ্ছি। এ সময় ফোন এল। বিরক্তি নিয়ে চোখ খুলে ফোনের স্ক্রিনে তাকালাম। দেখলাম খালা ফোন করেছেন। ফোন না ধরে আবার চোখ বন্ধ করলাম। কিন্তু খালাও নাছোড়বান্দা। তিনি অনবরত ফোন করেই যাচ্ছেন। বাধ্য হয়ে ফোন ধরলাম।
—কিরে নবাবজাদা, তুই ফোন ধরিস না কেন?
—খালা, তুমি কি ঠিক আছ?
—মানে কী?
—না, সব সময় তো আমাকে হারামজাদা বলেই ডাকো। কিন্তু এ মাত্র তুমি আমাকে নবাবজাদা বললা। আমার কান বিষয়টি নিতে পারছে না। তাই বললাম তুমি ঠিক আছ কি না?
—শোন, তুই ভুল শুনেছিস। আমি তোকে নবাবজাদা না, হারামজাদাই বলেছি।
—তা–ই বলো। আসলে আমি ট্রেনে ঘুমাচ্ছিলাম। সম্ভবত ঘুমের তালে তোমার কথা বুঝতে পারিনি। না হলে তুমি আমাকে সম্মান দিয়ে কথা বলবা, এটা তো কোনোভাবেই সম্ভব নয়, তাই না?
—তুই ট্রেনে কই যাস?
—কেন, কলেজে।
—কলেজে যেতে হবে না। তুই বাসায় আয়।
—এটা কী বললা? আমি কলেজ বাদ দিয়ে তোমার বাসায় যাব কেন? কোনো সমস্যা?
—হ, সমস্যা। আমি ঠিক করেছি এই লোকের সংসারে আর থাকব না। ব্যাগট্যাগ গুছিয়ে ফেলেছি। তুই আয়। তুই এলেই এই সংসারে লাথি মেরে, সংসার ছেড়ে তোর সঙ্গে চলে যাব।
—ছি খালা ছি, এটা একটা কথা বললা? তুমি তোমার বয়সটা দেখছ? আমার মতো একটা পিচ্চি পোলার হাত ধরে তুমি সংসার ছেড়ে নিরুদ্দেশ হবা, মানুষ কী বলবে? আচ্ছা, বয়স নাহয় বাদই দিলাম। কিন্তু সম্পর্কও তো একটা ব্যাপার আছে, তাই না? শত হলেও তুমি আমার আপন খালা। এটা তো সমাজ, ধর্ম কেউই মেনে নেবে না। খালা, তুমি অন্য কাউকে খুঁজে নাও। আমারে মাফ করো। আমি তোমাকে নিয়ে পালাতে পারব না।
—এই হারামজাদা, তুই এসব কী বলিস?
—কেন, তুমিই না বললা, আমার হাত ধরে সংসার ছেড়ে চলে আসবা।
—হারামজাদা, এই কথার মানে কি আমি তোর সঙ্গে পালাব? থাবড়াইয়া তোর দাঁত সব ফেলাই দেব। ফাজিলের ঘরের ফাজিল।
—তাহলে আমারে আসতে বলতেছ কেন?
—কারণ, তুই এলে আমি তোর সঙ্গে তোদের বাসায় যাব। ওখানে কয়েক দিন থাকব। তারপর দেশে চলে যাব।
—ও, এই কথা। আমি তো ভয় পেয়ে গেছিলাম।
—শোন, তুই এখন ট্রেন থেকে নাম। নেমে ট্যাক্সি নিয়ে চলে আয়। চিন্তা করিস না, আমি তোর যাওয়া-আসার ভাড়া দিয়ে দেব। সঙ্গে আরও ১০০ ডলার বকশিশ পাবি।
—খালা প্লিজ, আমাকে তুমি টাকার লোভ দেখাইয়ো না। আমি লোভী না। শোনো, টাকাপয়সা কোনো কিছুই মানুষের সঙ্গে যাবে না। প্লিজ, তুমি আমাকে নীতিভ্রষ্ট কইরো না।
—ওরে আমার নীতিমান। তোর ঢং দেখলে গা জ্বলে।
—খালা, টাকা কি সত্যি দিবা?
—দিবো ভাবছিলাম। কিন্তু তুই তো নীতি বিসর্জন দিবি না, সে জন্য এখন আর দিব না।
—খালা, এটা কিন্তু ঠিক নয়। কথা দিয়ে কথার বরখেলাপ করা উচিত নয়।
—ওই, তুই না বললি তুই লোভী না।
—আরে, লোভ তো করছি না। এটা তো টাকা না, এটা তোমার আশীর্বাদ। এখন বলো, সত্যি ১০০ ডলার দিবা?
—আচ্ছা দেব, তুই আগে আয়।
ট্রেন থেকে নেমে ট্যাক্সি নিয়ে খালার বাসার উদ্দেশে রওনা দিলাম। আমরা নিউইয়র্কে থাকলেও খালা থাকে পাশের স্টেট নিউ জার্সিতে। আমাদের বাসা থেকে খালার বাসায় যেতে সময় লাগে দুই ঘণ্টার মতো। খালুর নিউ জার্সিতে কয়েকটি বাড়ি আছে। ওগুলোর ভাড়া দিয়েই ওনারা রাজার মতোই থাকেন।
আমি প্রায় দুপুর ১২টার দিকে খালার বাসায় পৌঁছলাম। বাসায় খালা-খালু আর ওনাদের কলেজপড়ুয়া মেয়ে থাকেন। খালা-খালু দুজনের খুবই সুখের সংসার। দুজন দুজনকে প্রচণ্ড ভালোবাসেন। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে সব সময় তাঁরা ঝগড়ার মধ্যেই থাকেন। কলিং বেল বাজাতেই খালাতো বোন রিনা দরজা খুলে দিল।
—কিরে, কেমন আছিস?
—ভালো না। বাসায় কাল রাতে মা–বাবার চরম ঝগড়া হইছে।
—এ আর নতুন কী? এটা তো প্রতিদিনই হয়।
—না এবার সিরিয়াস। মা বলেছে, সে বাবাকে ডিভোর্স দেবে। ভাইয়া শোনো, তুমি কিন্তু মাকে আজ তোমার সঙ্গে করে নিয়ে যাবা না। পারলে মাকে বুঝায়ে রেখে যাবা।
—আরে না। তাহলে আমার লস হয়ে যাবে। খালা বলছে তাকে নিয়ে গেলে আমাকে যাওয়া-আসার ট্যাক্সিভাড়া প্লাস ১০০ ডলার বকশিশ দেবে।
রিনা আমার হাত ধরে বলল,
—তোমার বকশিশের টাকা আমি দেব। তবু তুমি আজ মাকে নিয়ে যাবা না। যেভাবে হোক মাকে রেখে যাবা। আর শোনো, বাবা কিন্তু তোমার ওপর অনেক রেগে আছে। বাবার সঙ্গে সাবধানে কথা বলবা।
—কেন, আমি আবার কী করলাম?
রিনা উত্তর দিতে যাবে, ঠিক সে সময় খালু উপস্থিত হলেন। উনি আমাকে ইশারা দিয়ে ড্রয়িংরুমে বসতে বললেন। আমি সোফাতে বসলাম। রিনা ভেতরের রুমে চলে গেল। আমি নরম স্বরে বললাম,
—খালু, কেমন আছেন?
—বেয়াদবি করবা না। আগে সালাম দাও, তারপর প্রশ্ন করো।
—আসসালামু আলাইকুম।
—ওয়ালাইকুম আসসালাম। এখন জিজ্ঞেস করো কেমন আছি।
—খালু, আপনি কেমন আছেন?
—ভালো নাই। তোমার জন্য গত কয়েক দিন আর তোমার খালার জন্য গত রাত থেকে আমি সমস্যার মধ্যে আছি। আগে তোমারটা বলি। তুমি কি জানো আমাদের আত্মীয়স্বজন সবাই তোমারে ফালতু ছেলে মনে করে?
—জি, জানি। তবে খালু, আমি কিন্তু ফালতু ছেলে নই। আসলে সবাই আমাকে অবমূল্যায়ন করছে।
—কেউ তোমাকে অবমূল্যায়ন করছে না। তুমি শতভাগ ফালতু ও খবিশ ক্যাটাগরির ছেলে। না হলে তুমি সবাইরে সারাক্ষণ কুবুদ্ধি দিতা না।
আমি কিছু না বলে চুপ করে রইলাম।
—আমরা ঠিক করেছি রিনাকে এবার দেশে নিয়ে গিয়ে বিয়ে দেব। মাঝখান থেকে তুমি ওর মাথায় কুবুদ্ধি ঢুকায় দিলা। তুমি নাকি তাকে পরামর্শ দিয়েছ বিদেশি ছেলে বিয়ে করতে?
—জি, খালু।
—আমি কি জানতে পারি, এর কারণ কী?
—অবশ্যই জানতে পারেন। খালু শোনেন, রিনা তো রাগী একটা মেয়ে। অল্পতেই রেগে যায়। রেগে গেলে ও আবার যা–তা গালাগালি করে। আমরা আপনজনেরা রিনার এই বিষয়টা সহজে মেনে নিই। কিন্তু রিনার স্বামী তো পরের সন্তান। সে এসব মানবে কেন? দেখা যাবে রিনার গালি শুনে ওর জামাইও ওকে গালাগাল শুরু করে দিছে। এর ফলে কী হবে? ঝগড়াটা আরও চরম আকার ধারণ করবে। কিন্তু জামাই যদি বিদেশি হয়, তাহলে তো আর এই সমস্যা হবে না। কারণ, ওই ছেলে তো বাংলা বুঝবে না।
—কিন্তু বিয়ের পর আমার মেয়েকে স্বামীর সঙ্গে ঝগড়া করতে হবে কেন?
—এটা কী বললেন, খালু? বিয়ের পর ঝগড়া না করলে বিয়ের মজাই তো শেষ। বিয়ে করবে অথচ ঝগড়া করবে না, এটা কেমন কথা!
—তার মানে তুমি বলতে চাও, মানুষ শুধু ঝগড়া করার জন্য বিয়ে করে?
—জি না, খালু। মানুষ তিনটি কারণে বিয়ে করে। প্রথমত, শরীরে চাহিদা মেটানো, দ্বিতীয়ত সন্তান উৎপাদনের জন্য, আর তৃতীয়ত ঝগড়া করার জন্য।
—তুমি তো আস্ত একটা বেয়াদব। আমার সামনে শরীরের চাহিদা আর সন্তান উৎপাদন কথাটা বলতে তোমার লজ্জা করল না।
—সত্যি বলতে কি খালু, একটু করেছে। তবে কথা তো সত্য, তাই না খালু?
—তা তুমিও কি ঝগড়া জেতার জন্য বিদেশি মেয়ে বিয়ে করবে?
—আমারে কি পাগলে কামড়াইছে যে আমি বিদেশি মেয়ে বিয়ে করব? আমি শতভাগ দেশি মেয়েকেই বিয়ে করব।
—তার কারণ কী?
—খালু, ঝগড়ার সময় দেশি মেয়েরা গালি দেবে, তবে আপনারে পেটাবে না। কিন্তু বউ বিদেশি হলে পেটানোর সমূহ আশঙ্কা আছে।
খালু আমার দিকে কিছুক্ষণ ভুরু কুঁচকে তাকিয়ে রইলেন। তারপর বললেন,
—তুমি কি জানো, তোমার মাথায় সমস্যা আছে?
—আলহামদুলিল্লাহ। জি, আমি তা জানি।
—শোনো, যেহেতু তুমি নিজেও জানো যে তোমার মাথায় সমস্যা আছে, তাহলে তুমি মানুষকে উল্টাপাল্টা বুদ্ধি দাও কেন? শোনো, এখন থেকে আর কাউরে বুদ্ধি দিবা না।
—জি খালু, দিব না। কিন্তু খালু, আমি আগ বাড়িয়ে কাউরে পরামর্শ বা বুদ্ধি দিই না। কেউ যখন বুদ্ধি চায়, শুধু তখনই দিই।
—এখন থেকে চাইলেও দিবা না। বিশেষ করে আমার বাসার কাউকে দিবা না।
—জি, দিব না।
—বুদ্ধি তো দিবাই না, এমনকি এ বাসার কেউ কোনো সাহায্য চাইলেও করবা না।
—জি করব না। কিন্তু খালু, আমি তো এখন এখানে আসছি খালাকে সাহায্য করতে। তা এখন কি সাহায্য করব, না চলে যাব।
—তোমার খালা তোমাকে আসতে বলেছে? কেন?
—উনি বলেছেন, উনি আর আপনার সংসার করবেন না। উনি আপনার বাসা ছেড়ে আমার সঙ্গে আমাদের বাসায় চলে যাবেন। তাই আমি উনাকে নিতে এসেছি।
—শোনো, সে রাগের মাথায় এসব বলেছে। তুমি এক কাজ করো, তোমাকে দেখার আগেই তুমি এখান থেকে চলে যাও।
—না খালু, সেটা সম্ভব নয়। খালা বলেছেন, উনাকে নিয়ে গেলে আমাকে গাড়িভাড়া ছাড়াও ১০০ ডলার বকশিশ দেবেন। এখন উনাকে না নিয়ে গেলে আমার লস হয়ে যাবে। আমি আমার লস করতে পারব না। তবে আপনি যদি আমাকে গাড়িভাড়া এবং সেই সঙ্গে ২০০ ডলার বকশিশ দেন, আমি খালাকে না নিয়ে চলে যাব।
—মাই গড, তুমি তো দেখি অনেক বড় ব্যবসায়ী হয়ে গেছ।
—জি খালু, দোয়া করবেন। আচ্ছা খালু, খালা চেতছে ক্যান?
—ওই মাথামোটা মহিলার কথা আর বোলো না। একটা মানুষ কতটা ভণ্ড হতে পেরে তুমি কল্পনাও করতে পারবা না।
—বলেন কী, আমার খালা ভণ্ড!
—অবশ্যই ভণ্ড। শোনো, সে সব সময় দেশের প্রশংসা করবে। দেশের জন্য কাঁদবে। তুমি যদি তার ফেসবুক স্ট্যাটাস দেখো, তাহলে অবাক হয়ে যাবা। তোমার মনে হবে, তার মতো দেশপ্রেমিক মানুষ বাংলাদেশে একজনও নাই।
—খালু, এটা তো ভালো জিনিস। তাহলে তাকে আপনি ভণ্ড বলছেন কেন?
—কারণ, তার সব ভালোবাসা ফেসবুককেন্দ্রিক। লোকদেখানো।
—কীভাবে বুঝলেন?
—শোনো কী হয়েছে। তুমি তো জানো এই মহিলা সারা দিন খায় আর ঘুমায়। একটা মানুষ এতক্ষণ কীভাবে ঘুমায় আমি বুঝতে পারি না। ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে শরীরের ওজন বাড়ায়ে ফেলছে। এই ঘুমের কারণে বাসার বাইরেও সে কম যায়। আমরা সবাই দেশে যাব। সে জন্য শপিং করছি। কিন্তু ঘুমের কারণে সে শপিংয়ে যাচ্ছে না। যার কারণে আমাকেই সব করতে হচ্ছে। গতকাল আত্মীয়স্বজনের জন্য কিছু পোশাক কিনলাম। সব পোশাক দামি এবং ব্র্যান্ডের। বাসায় আসার পর পোশাক দেখে সে আমার সঙ্গে ঝগড়া লাগায়ে দিল।
—কেন?
—কারণ, ওই পোশাকগুলোর বেশির ভাগই মেড ইন বাংলাদেশ। পোশাকের গায়ে ‘মেড ইন বাংলাদেশ’ লেখা দেখে তার মেজাজ গরম হয়ে গেছে। এ নিয়ে তার সঙ্গে আমার তুমুল ঝগড়া হয়েছে। সে বলেছে, এসব পোশাক নিয়ে সে বাংলাদেশে যাবে না। সব এখন আমাকে ফেরত দিতে হবে।
—কিন্তু দেশের তৈরি পোশাকে সমস্যাটা কোথায়?
—তার ধারণা, এসব জিনিস বাংলাদেশে নিয়ে গেলে কেউ খুশি হবে না। তারা নাকি ভাববে আমরা কমদামি সস্তা পোশাক তাদের দিয়েছি।
—কিন্তু বাংলাদেশের তৈরি পোশাক মানেই কম দামি পোশাক, এটা ওনাকে কে বলল?
—এটা ওই মহিলাকে গিয়ে জিজ্ঞেস করো। সে বলে, এসব জিনিস কাউকে দিলে তারা ভাববে আমরা বঙ্গবাজার বা ঢাকা কলেজের সামনে থেকে কিনে তারপর গিফট করেছি। আচ্ছা বলো, আমরা নিজেরাই যদি দেশের তৈরি পোশাক না কিনি, তাহলে আমাদের দেশের এই শিল্প দিন দিন আরও বড় হবে কীভাবে? তুমি দেশের কথা বলে আবেগে কাইন্দা দিবা, অথচ দেশের বানানো পোশাক কিনবা না, পরবা না। দেশের জিনিস ব্যবহার করবা না। দেশের তৈরি চাল-ডাল-মসল্লা খাবা না। এটা কেমন দেশপ্রেম?
—খালু, আমি আপনার সঙ্গে একমত। আচ্ছা, খালা এখন কোথায়?
—কোথায় আবার? সে এখন ঘুমাচ্ছে। বললাম না, সারাক্ষণ ঘুমায়।
—খালু, আপনাকে একটা ভালো পরামর্শ দিই। আপনি বরং খালাকে ডিভোর্স দিয়া দেন। এ ভেজাল ঘরে রাখা ঠিক নয়।
—খবরদার, ফালতু কথা বলবা না।
—বুঝলাম না, এ হাতির মতো স্ত্রীর সঙ্গে আপনি থাকবেন কেন? আপনি বরং একটা স্লিম ফিগারের মেয়ে বিয়ে করেন।
খালু রাগে কাঁপতে লাগলেন। তিনি চিৎকার করে বলে উঠলেন,
—ওই ফাজিলের ঘরের ফাজিল। তোরে না বলছি, তুই কাউরে পরামর্শ দিবি না। তোর এত বড় সাহস, তুই আমারে ডিভোর্সের পরামর্শ দেস। আমারে আবার বিয়া করার পরামর্শ দেস।
—খালু, রাগেন ক্যান? আমি তো আপনারে ভালো পরামর্শ দিছি। এখন আমার পরামর্শমতো আপনি নতুন একটা বিয়ে করবেন, নাকি হাতির সঙ্গে থাকবেন, সেটা আপনার ব্যাপার।
—তুই আমার বউরে আবার হাতি কইলি?
খালুর চিৎকারে খালা পুরো বাড়ি কাঁপায়ে দৌড়ে দৌড়ে ড্রয়িংরুমে এলেন। রিনাও দৌড়ে এল। আমি খালা আসতেই বললাম,
—খালা আস্তে হাঁটো, দৌড়াইও না। এটা তো ফ্রেমের বাড়ি। তোমার যে ওজন, ভেঙে যেতে পারে। সাবধান।
—তুই আবারও আমার স্ত্রীর শরীর নিয়া কথা বললি? তোরে আমি আজ মাইরাই ফেলব। রিনা, আমার পিস্তল নিয়া আয়।
হঠাৎ ঘুম ভেঙে দৌড়ে আসার কারণে খালা হাঁপাতে হাঁপাতে আমাকে প্রশ্ন করলেন,
—রানা, হইছে কী? তোর খালু চেতছে ক্যান?
—শোনো খালা, তোমার স্বামীর মাথায় সমস্যা আছে। আমি তারে সুন্দর একটা পরামর্শ দিছি। কিন্তু সে সেটা না বুঝেই আমারে গালাগালি শুরু করছে।
—কী, পরামর্শ দিছিস তুই?
—আমি বলেছি, খালু, আপনি আপনার স্ত্রীকে ডিভোর্স দিয়া দেন। এ মহিলার হাতির মতো দেহ, হাতির মতো তারা মাথা মোটা। আপনি ঘরে বউ রাখবেন। আপনার ঘরে হাতি রাখার কী দরকার? এ কথা বলামাত্র এই বুইড়ার বুইড়া আমারে মারতে উঠছে।
এবার খালা চিৎকার করে উঠলেন,
—হারামজাদা, তুই আমারে হাতি কইছোস ঠিক আছে, তুই আমার স্বামীরে বুইড়া বললি ক্যান? তোর এত বড় সাহস। তুই আমার বাসায় দাঁড়ায়ে, আমার সামনে আমার স্বামীকে অপমান করোস। বেয়াদব, তুই বাইর হ আমার বাসা থেকে।
—বলো কী? তুমি না বললা তুমি আমার সঙ্গে বাসা থেকে বের হয়ে যাবা।
—আমি তোর সঙ্গে কোথাও যাব না। তুই বের হ বাসা থেকে। তুই আর কখনো আমার বাসায় আসবি না।
—আচ্ছা যাবা কি যাবা না, সেটা তোমার ব্যাপার। আমাকে আসা-যাওয়ার ট্যাক্সিভাড়া আর ১০০ ডলার বকশিশ দিয়া দাও, আমি চলে যাচ্ছি।
—তোরে আমি একটা টাকাও দিব না। তুই বাইর হ আমার বাসা থেকে।
—ওকে, তোমার যেমন ইচ্ছা।
এ কথা বলে আমি আড়চোখে একবার রিনার দিকে তাকিয়ে চোখ টিপ মারলাম। তারপর বাসা থেকে বের হয়ে গেলাম।
বাসার বাইরে এসে দাঁড়ালাম। তারপর নিজে নিজেই হাসতে লাগলাম। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে রিনা বাসা থেকে বের হয়ে এল। এসো বলল,
—ভাইয়া, ধন্যবাদ। তুমি একটা জিনিয়াস। কী সুন্দর কৌশলে, তুমি দুজনের মধ্যে প্রেম জাগিয়ে দিলে। তুমি জানো, মা এখন বাবাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদছে।
এরপর রিনা হাত বাড়িয়ে আমাকে কিছু ডলার দিয়ে বলল,
—নাও। তোমার তো না হলে লস হয়ে যাবে।
আমি হাত বাড়িয়ে ডলারগুলো নিলাম। গুনে দেখলাম, ২০০ ডলার।
—ধন্যবাদ।
—আমি ভাবছিলাম তুমি আমার কাছ থেকে টাকাগুলো নিবা না। শত হলেও আমি তোমার ছোট।
—শোন, ছোট-বড় কোনো ব্যাপার না। কেউ টাকাপয়সা দিলে অবহেলা করতে হয় না। রিনা শোন, তোকে একটা বুদ্ধি দিই। তুই দেশি ছেলেকেই বিয়ে কর।
—মানে কী! তুমিই তো করতে মানা করেছিলে। তুমি না বললে, জামাই দেশি হলে প্রাণখুলে গালাগালি করতে পারব না।
—পারবি। তোকে একটা কৌশল শেখায়ে দিই। তুই গুগল থেকে চীনা, জাপানি, স্প্যানিশ, উগান্ডাসহ বিভিন্ন ভাষার গালি মুখস্থ করা শুরু করে দে। বিয়ের পর স্বামীর সঙ্গে ঝগড়া লাগলে তুই ওই সব গালি দিবি। ওই ব্যাটা তো আর ওই সব গালি বুঝবে না। তুই এদিকে মনের সুখ মিটায়ে গালাগালি করে যাবি।
—এটা অবশ্য ঠিক বলছ।
—আরেকটা কথা, শোন, বাংলাদেশের ছেলেরা কিন্তু বউকে অনেক ভালোবাসে। এমন ভালোবাসা তুই আর কোনো দেশের ছেলের বুকে পাবি না। এরা নিজে না খেয়ে তোকে খাওয়াবে। তোকে খুশি করতে এরা কিডনি বিক্রি করতেও পিছপা হবে না।
—তাই?
—হু। তবে একটা সমস্যা আছে।
—আবার কী সমস্যা?
—এরা একটু বউপাগলা হয়। সারাক্ষণ এরা বউয়ের কাছাকাছি থাকতে চায়। এরা এত বেশি গা ঘেঁষে থাকবে যে মাঝেমধ্যে তুই বিরক্ত হয়ে যাবি। দেখবি তুই বাথরুমে গিয়েও বেশিক্ষণ থাকতে পারবি না। হয়তো দরজায় টোকা দিয়ে বলবে, এই, কী করো?
—অনেক কিউট তো। ভাইয়া, তুমিও কি এমন করবা?
—অবশ্যই। আমি তো আমার বউকে একা বাথরুমেও যেতে দেব না। হা হা হা…।
দেখলাম, রিনা কেমন গভীর চোখে আমার দিকে তাকিয়ে আছে।
—শোন, বাসায় যা। বাসায় গিয়ে তোর বাবাকে বল, তোর জন্য নরম মনের একটা ছেলে খুঁজতে।
—ভাইয়া, তুমি তো অনেক নরম মানুষ, তাই না?
—অবশ্যই। শোন, আমার কোনো রাগটাগ নাই। জানিস মা কী বলে? মা বলে, আমি নাকি ভেদা মাছ। হা হা হা…
—তাহলে এক কাজ করি, বাবাকে গিয়ে বলি, আমি তোমাকে বিয়ে করব।
—থাবড়ায়ে তোর দাঁত ফেলে দেব। ফাজিল মেয়ে। আমি নরম তোরে কে বলছে? আমার প্রচণ্ড মেজাজ। আমি তো ঠিক করছি বউরে মাইরের ওপর রাখব।
—ঠিক আছে তুমি মাইরো। আমার সমস্যা নাই। তবু আমি তোমাকে বিয়ে করব। আচ্ছা বলো তো, আমার মতো সুন্দর মেয়ে জীবনে তুমি কয়টা দেখেছ?
—ওই, তুই তোর ২০০ ডলার নিয়া যা। আমি তোর টাকা নিব না। ফাজিল মেয়ে কোথাকার। ঘরে যা। মা–বাবার পছন্দের ছেলেকে বিয়ে করে সুখী হ।
—না, আমি তোমাকেই বিয়ে করব। ভাইয়া, তোমাকে হয়তো সরাসরি কখনো বলিনি, কিন্তু তুমি কি বোঝো না, আমি তোমাকে ভালোবাসি?
—না বুঝি না। শোন, আমার মাথায় সমস্যা আছে। আমি ভালোবাসা বোঝার অবস্থায় নাই। আর তা ছাড়া তুই একটা পিচ্চি মেয়ে, তোর সঙ্গে আবার কিসের ভালোবাসা?
বলেই সামনের দিকে পা বাড়ালাম। কিন্তু ভেতর ভেতর মনটা খারাপ হয়ে গেল। রিনাকে এভাবে কড়া কথা না বললেও পারতাম। কিন্তু এই অল্প বয়সের মেয়েগুলারে লাই দেওয়া ঠিক নয়। এরা জীবনটাকে সিনেমার মতো ভাবে। আরে ফাজিল মেয়ে, সারা জীবন তুই আমারে ভাইয়া ভাইয়া ডাকলি, আর এখন তুই আমারে বিয়া করবি, এটা কোনো কথা?
কিছু দূর যাওয়ার পর রিনার একটা টেক্সট মেসেজ পেলাম। সেখানে সে একটি জনপ্রিয় গানের দুটো লাইন লিখে পাঠিয়েছে,
‘ঘুড়ি তুমি কার আকাশে ওড়ো,
তার আকাশ কি আমার চেয়ে বড়?
তার আকাশ কি আমার চেয়ে বড়?’
আমি উত্তরে লিখলাম,
‘শোন, আমার অত সময় নাই। পারলে তুই মাইপা দেখ, কার আকাশ বড়।’
সঙ্গে সঙ্গেই রিপ্লাই এল,
‘যতই বাহানা করো, বিয়ে আমি তোমাকেই করব।’
লেখক: ইমদাদ বাবু, নিউইয়র্ক, যুক্তরাষ্ট্র
**দূর পরবাসে লেখা পাঠাতে পারবেন আপনিও। ঠিকানা [email protected]