প্রবাসের রোজায় স্বদেশের ‘ঘ্রাণ’ পাই না

পুরান ঢাকার চকবাজারের ইফতারিফাইল ছবি

রান্নাঘরে উঁকি দিলে ভেসে আসে ফুটন্ত তেলে পেঁয়াজু-বেগুনি ভাজার শব্দ। বাতাসে উড়ে বেড়ায় হলুদ-মরিচ-ধনেপাতা-ডাল-বেসনমিশ্রিত একধরনের পোড়া পোড়া মুখরোচক ঘ্রাণ। পেঁয়াজু, বেগুনির সঙ্গে একেকদিন যোগ হয় আলুনি, কপিনি (ফুলকপি বেসন মেখে ভাজা) কিংবা মুরগির কিমা দিয়ে তৈরি আলুর চপ। বড় সাদা কাচের বাটিতে পেঁয়াজ, কাঁচা মরিচ, ধনেপাতা, শর্ষের তেল সহযোগে মাখা হচ্ছে মুড়ি। বুট ইতিমধ্যে চুলা থেকে নেমেছে। তৈরি হয়ে আছে জগভর্তি লেবু কিংবা তেঁতুলের শরবত, তাতে ভাসছে বরফের স্বচ্ছ টুকরা।
এখন বাবার জন্য অপেক্ষা। হয়তো অফিস থেকে ফেরার পথে আনবেন জিলাপি, হালিম কিংবা সুতি কাবাব। আমার যত দূর মনে পড়ে বাবাকে কখনো সুতি কাবাব ছাড়া অন্য কোনো কাবাব রমজান মাসে আনতে দেখিনি। রোজার মাস ছাড়া সুতি কাবাব আমাদের খাওয়া হতো না। পুরান ঢাকার ঐতিহ্যবাহী এই কাবাব কখনো খেয়ে না থাকলে অবশ্যই খেয়ে দেখবেন। পরোটার সঙ্গে খেতে দারুণ সুস্বাদু।

খাওয়াদাওয়া দিয়ে শুরু করলাম। কারণ, রমজান মাসে আমাদের খাবারে একটা ভিন্নতা আসে। রোজা রাখার আনন্দটা বৃদ্ধি পায় ইফতারে কী খাব তা ভেবে। ছোটবেলায় ইফতারের বিশেষ খাবারগুলো বছরের বাকি সময় বলতে গেলে খাওয়া হতো না।
দেড় দশকের প্রবাসী এই আমি এখন অবশ্য বছরের অন্যান্য সময় পেঁয়াজু বানাই, বিশেষত যখন নস্টালজিয়া জেঁকে বসে। বাড়ির পেছনের বাগানে গ্রীষ্মে যখন সবজি চাষ করি, তখন নিজের লালিত গাছে ফলিত বেগুন দিয়ে কোনো বিকেলে তৈরি করি বেগুনি। মুড়িও মাখানো হয় মাঝেমধ্যে। এমনও দিন আসে যখন হাতের কাছে যা আছে তার সবকিছুতেই অরুচি। বারবার মনে হয়, যদি একপ্লেট চটপটি বা ফুচকা কিংবা নান-কাবাব কেউ জাদুবলে এনে দিত। অমন দিনগুলোতে ঘরে ঝাঁকানো ঝালমুড়িতেই আমি ওই প্রিয় খাদ্যগুলোর সাধ মিটাই।
যা বলছিলাম, এই প্রবাসজীবনে ছোটবেলার বা ঢাকার সেই রমজান মাসের আমেজ পাই না। বাতাসে ভেসে আসে না পেঁয়াজু-বেগুনি ভাজার ঘ্রাণ, টেবিলে ‘ইফতারির প্লেট’ সাজিয়ে কেউ বলে না, ‘তাড়াতাড়ি! আর মাত্র ১০ মিনিট বাকি!’

অনেক পরিবারে সবাই মিলে একত্রে বসে ইফতার করেন
ফাইল ছবি

প্রবাসে বাবারা হাতে করে নিয়ে আসে না সুতি কাবাব কিংবা মচমচে জিলাপি। দ্বিতীয় প্রজন্মের অনেকেই জানে না যৌথ পরিবারের সবাইকে নিয়ে মাগরিবের আজানের জন্য অপেক্ষা করা কাকে বলে।
ঢাকায় রমজানের ভোরে ঘুম ভাঙত মসজিদের মাইকে করা সাহ্‌রি খাওয়ার আহ্বানে অথবা মা-বাবার ডাকে। এখানে ডেকে তোলে মুঠোফোনের অ্যালার্ম। ফজরের আজান শুনতে চাইলে চালিয়ে দিতে পারেন মুঠোফোনে আজানের অ্যাপ। একটি রেকর্ডকৃত কণ্ঠ আপনাকে শুনিয়ে দেবে আজান। কিন্তু তাতে সরাসরি শোনার আমেজ নেই।
রোমে অবস্থান করলে রোমানের মতো আচরণ করো—এই কথার মতো রমজান মাস নিজেদের জন্য সহজ করার চেষ্টায় এই সুদূর আমেরিকাতে আমরা বেগুনি-পেঁয়াজু শুধু ছুটির দিনে বানানোর চেষ্টা করি। এক সপ্তাহের বুট একবারে তৈরি করে রেফ্রিজারেটরে রেখে দিই। প্রতিদিন টাটকা তৈরি করার সময় বা শক্তি কোথায়? নানা রকম ফল, সেদ্ধ সবজি, ডিম, হিমায়িত ফালাফেল, কিব্বেহ, মোমো অথবা অন্য কোনো হিমায়িত নাশতা, ঘরে তৈরি স্যান্ডউইচ ইত্যাদি দিয়ে সেরে নেওয়া হয় ইফতার। হালিম খেতে চাইলে রাঁধুনির হালিম মিক্সই আমাদের ভরসা। জিলাপি? সেও বাক্সবন্দী পাওয়া যায়। কিন্তু স্বাদ যে টাটকা জিলাপির মতো নয়, সেটা বলে দিতে হয় না।

গৃহাকুলতা কী তা এই পবিত্র রমজান মাসে এবং তার সমাপ্তির পর আনন্দময় ঈদুল ফিতরে এই হৃদয়ের প্রতিটি কোণে অনুভূত হয়। দেশ ছেড়ে শুধু দেশই ছাড়ে না মানুষ, অগুনতি ভালোবাসার মানুষ, মুহূর্ত, উৎসব ও আরও কত কী–ই না ছেড়ে আসে তারা। লেপের নিচে মার্চ মাসের হালকা ঠান্ডায় তারা রোমন্থন করে ফেলে আসা জীবনের সুখস্মৃতি—শৈশব, কৈশোর, যৌবনের শ্রেষ্ঠ মুহূর্তগুলো।
প্রবাসে না এলে হয়তো হৃদয়ঙ্গম করতে দেরি হতো, এই জীবনের আপাতদৃষ্টিতে ছোট বিষয়গুলো আসলে বড় বিষয়, গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। যত সময় কাটছে, ততই বেশি বেশি উপলব্ধি করছি। তাই পরিবার-পরিজন পরিবৃত একটি স্মরণীয় রমজান মাস কাটুক সবার, এই কামনা করি।