আয়ারল্যান্ডের কিলকেনিতে পৌষপার্বণ
তুমুল রসিক আইরিশরা বলে, বছরে দুই ঋতু এ দেশে—শীত আর খুব শীত। এর মানে, শীত এখানে বারো মাস। ফলে শীতকাল বলে আলাদা ঋতু যেমন নেই, বাংলার পৌষ মাঘের মতো বিশেষ কোনো মাস বলেও কিছু হয় না। শীতের পিঠাপুলি তো মায়ার খেলা। আদতে এর দেখা মেলে না। তবু বছরের এই সময় বাঙালির প্রাণ হাহাকার করে ওঠে। পিঠাপুলি, আর শীতের সকালের রোদে বসে আড্ডার জন্য এই কান্না না কি আমাদের পূর্ব–পুরুষের জিনের কারবার!
ক্রিসমাসের ঠিক পরের দিন। কনকনে শীতে রোদের দেখা নেই। তবে জিনের খেলা বলে কথা। যতই বিরূপ হোক আবহাওয়া, পিঠাপুলি হবে, আড্ডা হবে—এই নিমন্ত্রণে আমরা এসেছি রাজধানী ডাবলিন থেকে কিলকেনি শহরে। পৌষপার্বণ উৎসব। আয়োজক এ শহরের রিমু-সাইদুর পরিবার। ডিসেম্বর বাঙালির বিজয়ের মাস। আর ইউরোপে বড়দিনের আনন্দ, অফিস স্কুল ছুটি—সব মিলিয়ে উৎসবের জন্য আদর্শ।
‘কিন্তু ঠিক এ সময়েই কেন পৌষপার্বণের কথা ভাবলেন? ক্রিসমাসের মৌসুম, পার্টিও তো করতে পারতেন? শেকড়ের টান ভাই। এসব না করলে দেশের কথা ভুলে যাবে যে নতুন প্রজন্ম। আর আমরাই বা কি করে বাঁচব এই অচিন দেশে?’— বললেন সাইদুর। বৃহত্তর মৈমনসিংহের টাঙ্গাইল পিঠার দেশ। আমার জন্ম ওই জেলায় বলেই জানি। ওই টাঙ্গাইলের রিমু-সাইদুর পরিবার নিজ উদ্যোগে দুর্দান্ত এই উৎসবের আয়োজন করেছেন।
কোনো চাঁদা নেই, স্টল নেই, বেচা কেনা নেই! কি করে জোগাড় হলো এতো সব? ‘টাকাপয়সা দিয়ে উৎসব হয় না। আনন্দের মূল ব্যাপার হলো দেশের মতো করে কিছু করা’—বললেন সদাহাস্য সাইদুর। শহরের লরেটো মাধ্যমিক স্কুলের বড় হলরুমে মহা আয়োজন। ঢুকতেই সারি সারি খিচুড়ি–বিরিয়ানী দিয়ে আপ্যায়ন। সবার জন্য আয়োজন আছে। কয়েক শ অতিথি! নানা বয়স, নানা ধর্ম, নানা এলাকার সব অতিথি। তবে সবার জন্য আছে মানানসই খাবার। বিনা পয়সায়। এর পর চা। এই ছুটিতে, শীতের দুপুরে আহা কি দুর্দান্ত হাতে বানানো চা! বাঙালি সুখের উস্কানি দিতে পাশেই পানসুপারির ডালা। তাম্বুল না হলে বাঙালির মুখে রসের ফোয়ারা ছুটবে কি করে! এতো কিছুর পরও যেন অপেক্ষায় আছে সবাই। ফিসফিসানি চলছে, পিঠা কোথায়! পিঠা কোথায়? জানা গেল, ওটাই শেষ চমক! মজার নানা খেলা চলল কিছুক্ষণ। এই শীতের মধ্যেও বাঙালির সাজে সেজেছে বেশিরভাগ আগত অতিথি। তবে মেয়েরা বাঙালির সাজে বরাবর এগিয়ে।
রাজনীতি-উৎসাহীরা কিন্তু থেমে নেই! বাংলাদেশের সাম্প্রতিক রাজনৈতিক পালাবদল নিয়ে তুমুল আলাপে মেতেছেন তাঁরা। কেউ শঙ্কা, কেউ আশা দেখছেন। টেবিল চাপড়ে চলছে বিতর্ক। গোল হয়ে বসে ‘আমার ইচ্ছা করে তোদের মতো মনের কথা কই’ চলছে এদিকে ওদিকে।
বিকেল গড়ালে আওয়াজ এল, পিঠা আসছে এবার! সবাই ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা আড্ডা থেকে চকচকে চোখে এদিক ওদিক তাকাতে লাগল। পিঠা আসছে! কুলা, বাঁশ বেতের সুদৃশ্য বারকোশ ভরে সারি সারি পিঠা, পায়েস হাজির হতে থাকলো একে একে! ভাপাপুলি, তিলপুলি, ক্ষীরপুলি, দুধপুলি, নকশি, মুগপাকোন, পাটিসাপ্টা, পাকান, চিতই—এ হলো কয়েকটা নাম! এর সঙ্গে আছে নানা পদের দই, চমচম, রসগোল্লা, জিলিপি, সিঙ্গারার সমাহার। এ যেন জাদুর দেশে এলাম! বাংলাদেশের প্রায় সব এলাকার মিষ্টি খাবার এক টেবিলে এসে হাজির! এক শরও বেশি পদ হবে! আয়ারল্যান্ডের নানা শহর থেকে যত্ন করে, নানাবাড়ির পিঠাপুলি নিয়ে হাজির হয়েছেন বিভিন্ন পরিবার। একটা আশায়—সবাই দেশি স্বাদের আনন্দ পাবেন। মাঝে মধ্যে মনে হচ্ছিল, অসম্ভব ঘটনা। এত রকমের পিঠা একসঙ্গে দেশে থাকতেও দেখিনি—বললেন কেউ কেউ! সত্যিই তো! দেশে হয় পিঠাপুলির উৎসব? হলেও বিনা পয়সায় খেতে পাওয়া যায় সেসব?
গোটা আয়োজনে নারীর নেতৃত্ব কারোর নজর এড়ায়নি। বাঙালি নারীর শক্তিমত্তা আর আয়োজনের দক্ষতা অসাধারণ হয়ে ধরা দিলো। মাটির সঙ্গে, ফসলের সঙ্গে, উৎপাদনের সঙ্গে নারীর নেতৃত্বের সম্পর্ক বোঝতে এসব উৎসব গুরুত্বপূর্ণ ইঙ্গিত দেয়। ‘নারীরা আয়োজন করলে সঙ্গে আরেকটা কাজের কাজ হয়—বললেন উদ্যোক্তা জুটি, ‘কোনো নেতিবাচক চর্চা, সংকীর্ণ রাজনীতির চাল এই উৎসবের প্রাঙ্গণ দখল করতে পারে না। উৎসবটা উৎসবই থাকে।’ হয়েছেও তা–ই। সমিতি, কমিটি, এলাকাবাজি, দলবাজি—এসবের কোনো আলামত ছিল না পুরো আয়োজনে। কাজটা মেয়েরাই ভালো পারে, জেনে গেলো সবাই।
নোর নদীর দুই তীর ধরে গড়ে ওঠা মধ্যযুগীয় শহর কিলকেনি। ইংরেজ-নরমানদের দখলে আসবার বহু আগে ষষ্ঠ শতকে এই শহরের পত্তন। বেশিরভাগ লোকের ভাষা ইংরেজি। এর পর কথা হয় আইরিশ ভাষা গেইলিগে। ইংরেজ শাসকদের হাতে প্রায় হারাতে বসা আইরিশদের মাতৃভাষা গেইলিগ। নানা দেশ থেকে আশা মানুষ, তাদের ভাষা, উৎসব এদেশে সাম্প্রতিক ঘটনা। মূলত শ্বেত ইউরোপীয় মানুষের দেশে গত ৫০–৬০ বছরে মানুষের বৈচিত্র্য এসেছে । নানান ভাষা, রং, রূপ, ধর্মকর্ম এসেছে। মানুষের অভিবাসন সবচেয়ে বড় যে ধর্মান্তরী হাতিয়ার এনেছে, সেটা হলো নানান দেশের খাবারের সুগন্ধ । বাঙালি অভিবাসী গোটা দেশেই অনেক কম। এরই মধ্যে দেশের এক কোনায় এই কিলকেনি শহরে বেজে উঠল পৌষপার্বণের সুর, ছড়িয়ে গেলো বাঙালির খাদ্যবিলাসের সুগন্ধ।
এই কম মানুষের, অল্প অভিবাসীর দেশের পিঠাপুলির মিষ্টি গল্প জানান দিয়ে গেলো বাঙালির কথার মতো, সুরের মতো, রঙের মতো, খাবারও অনেক মিঠা। এর সঙ্গে পয়সাকড়ির কোনো বালাই নেই। ফসলের মাঠ, নবান্নর দেশ থেকে বহু দূরের কনকনে শীতের দেশেও পৌষপার্বণ না হলে বাঙালির পরান জুড়ায় না। বাঙালির প্রাণ, বাঙালির মন এক করে দেয় যে যে ওষুধ, পৌষপার্বণের পিঠাপুলি তার অন্যতম। এর সঙ্গে লেগে আছে মাটির গন্ধ, ফসলের ঘ্রাণ। সে যত দূরেই থাকি আমরা। আমাদের দেশ বাংলাদেশই।
বাংলায় পৌষপার্বণ হয় ফসল ওঠা নিয়ে। এই ‘এক ঋতুর’ দেশে বাঙালির ঘরে হয়তো ফসল ওঠে না। তাতে কি! মনের বাঙালিপনা কি মানবে সে কথা? উৎসব হবেই। ফসলের উৎসব। আইরিশরা এখনো কৃষিকাজকে বুকে ধরে রেখেছে। কৃষি এদেশের প্রধানতম কাজ। আজকাল কর্পোরেটের দখলে যাওয়া হ্যালোউইন এই দেশেরই কৃষকের ফসলের খেতের উৎসব। আমরা এই ভিনদেশে থাকা বাঙালিরা স্বপ্ন দেখি, একদিন দুই দেশের মানুষ এই উৎসবের সূত্র ধরেই পৃথিবীর এক জাত মানুষ-জাতের ফসলের গান, কৃষি ঘিরে লোকজ উৎসবের গল্প বলবে। গল্পবলা মানুষের জাত তাদের আদি পেশার গল্পের সুতায় জানতে পারবে, আমরা সব এক পৃথিবীর মানুষ। আমাদের সবার মা এক। নাম তার বসুন্ধরা।
লেখক : মাহবুব কবীর। উন্নয়ন সংস্থা সিবিএম গ্লোবাল ডিসেবিলিটি ইনক্লুশনের আয়ারল্যান্ড দপ্তরে কর্মরত।
*দূর পরবাস-এ গল্প, ভ্রমণকাহিনি, ভিডিও, ছবি, লেখা ও নানা আয়োজনের গল্প পাঠান [email protected]এ