জাতীয় ঐক্যর অনুশীলন ও প্রবাসীদের অন্তর্ভুক্তি

অলংকরণ: মাসুক হেলাল

আগস্টের গণভ্যুত্থান আমরা প্রবাসীরা দূর থেকে দেখেছি। ভৌগোলিক হিসাবে দূরে থাকলেও হৃদয়ে বাংলাদেশ ধারণ করি বিধায়, ইন্টারনেট এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দেশবাসীর চেয়ে কম কিন্তু দেখিনি। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রবাসীরা যে যাঁর অবস্থান থেকে সদা সক্রিয় ছিলেন। আমার শহর টোকিওসহ পৃথিবীর অনেক শহরের রাস্তায়-চত্বরে বিক্ষোভ সমাবেশ হয়েছে। একপর্যায়ে প্রবাসীরা আন্দোলনের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করতে, পরিবারের চেয়ে দেশকে প্রাধান্য দিয়ে রেমিট্যান্স প্রেরণ সাময়িকভাবে বন্ধ করে দিয়েছিলেন। প্রত্যাশা ছিল, আগামীর বাংলাদেশ বিনির্মাণে তাঁদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা হবে।

অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের প্রায় দেড় মাস পরে দায়িত্বপ্রাপ্ত উপদেষ্টা আসিফ নজরুল প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় থেকে প্রথম সংবাদ সম্মেলন করেন। সব কিছু গুছিয়ে নিয়ে কথা বলার জন্য সময় লেগেছে বলে শুরু করলেও তিনি যা বলেন, তাতে কোনো নতুনত্ব আমার কাছে ধরা পড়েনি। বক্তব্যের সারাংশ ছিল, প্রবাসীদের জন্য সেবা ও সুবিধা বৃদ্ধি করে রেমিট্যান্স প্রবাহ ধরে রাখা এবং আন্তর্জাতিক শ্রমবাজার সম্প্রসারণ করা। এ গত বাধা বয়ান অতীতেও আমরা বহুবার শুনেছি।

অতীতের মতো প্রবাসীদের আন্তর্জাতিক শ্রমবাজারে রপ্তানিযোগ্য পণ্য হিসাবে গণ্য না করে দেশর জন্য নিবেদিতপ্রাণ মানুষ হিসেবে তাঁদের মৌলিক অধিকার কীভাবে নিশ্চিত করা হবে, উপদেষ্টা মহোদয়ের বক্তব্যে সে বিষয়ে কোনো দিক্‌নির্দেশনা ছিল না। বরং শ্রুতিমধুর করার জন্য ‘রেমিট্যান্স যোদ্ধা’ নামক একটি বিশেষণ যোগ করা হয়, যা প্রবাসীদের মূল প্রত্যাশাকে প্রতিফলিত করে না।

এর একটা কারণ হতে পারে, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারে প্রবাসীদের কোনো প্রতিনিধি নেই বিধায় তাঁদের কথাগুলো বলার কেউ নেই। বিগত বছরগুলোতে অনেক প্রবাসী অ্যাক্টিভিস্ট দেশে স্বৈরাচারী একনায়কতন্ত্র হঠিয়ে জনগণের সরকার প্রতিষ্ঠার জন্য সক্রিয় ছিলেন, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারে তাঁদের কাউকে রাখা যেত।

অনেক দেশে নিবেদিতপ্রাণ প্রবাসী সমাজ সংগঠকেরা বছরের পর বছর কমিউনিটির কার্যক্রমের সঙ্গে তৃণমূল পর্যায়ে সম্পৃক্ত, তাঁদের কাউকে রাখা যেত। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারে প্রবাসীদের কেউ না থাকায় সোয়া কোটি প্রবাসীর মৌলিক অধিকার প্রাপ্তির যে প্রত্যাশা, যার অন্যতম হচ্ছে প্রবাস থেকে জাতীয় নির্বাচনে ভোট প্রদানের কিংবা জাতীয় সংসদে প্রতিনিধিত্ব করার অধিকার, এসব উপেক্ষিত রয়ে গেছে। সংস্কারের রোড ম্যাপে এ সম্পর্কিত কোনো পরিকল্পনাও অন্তর্ভুক্ত হয়নি।

অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের পর প্রধান উপদেষ্টা প্রথমেই বলেছিলেন, আমাদের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে জাতীয় ঐক্য। অতঃপর ছয়টি সংস্কার কমিশন গঠন করা হলেও জাতীয় ঐক্যের কোনো রূপরেখা এখনো দেওয়া হয়নি, বিষয়টি হয়তো খুব সহজ নয়। দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ মুসলিম এবং বাঙালি। জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে আমাদের প্রধান সমস্যা, এই দ্বৈত আত্মপরিচয়ের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের সংকট। বরং এই দুই আত্মপরিচয়কে বিভাজনের মাধ্যমে সাংঘর্ষিক অবস্থানে দাঁড় করিয়ে, একে অপরের শত্রু বানানোর অপচেষ্টা চলেছে। আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, সেনাবাহীনির শীতকালীন বহিরঙ্গন অনুশীলনকে দল-মত-ধর্ম-বর্ণনির্বিশেষে, ছাত্র-জনতা-প্রবাসীদের সংযুক্ত করে জাতীয় অনুশীলনে পরিণত করতে পারলে সেই প্রক্রিয়ায় বৃহত্তর সমঝোতা ও জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠিত হবে।

অলংকরণ: মাসুক হেলাল

একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের পরের কিছু ঘটনাবলির পরিপ্রেক্ষিতে, সামরিক বাহিনীকে শাসক হয়ে উঠতে দেওয়া যাবে না বলে তাঁদের জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন রাখা হয়। অথচ একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে তারাই ছিল জনগণের প্রশিক্ষক ও সহযোদ্ধা এবং সেই ধারাবাহিকতায় এখনো তারাই জনগণের অন্যতম ভরসার জায়গা। গত আগস্টের ছাত্র–জনতার অভ্যুত্থানের পরবর্তী সময়েও ভূমিকাও আমরা দেখেছি। এ বছর শীতকাল থেকে শুরু করে প্রতিবছর শীতকালীন ও বর্ষাকালীন, দুটি জাতীয় অনুশীলন করা গেলে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের আমলেই তিন বা ততোধিক অনুশীলন সম্পন্ন হবে। এভাবে সেনা-গণ সমঝোতার মাধ্যমে জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠিত হলে আমাদের আত্মবিশ্বাস ফিরে আসবে এবং ভীত, নতজানু মানসিকতা কেটে যাবে।

জাতীয় ঐক্যের এই অনুশীলনে প্রবাসীদের অন্তর্ভুক্তির ব্যাপারে, জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ৭৯তম অধিবেশনে প্রধান উপদেষ্টা প্রদত্ত ভাষণে ইঙ্গিত রয়েছে। সমকালীন বিশ্ব স্মার্ট প্রযুক্তি দ্বারা পরিচালিত। ডিজিটাল প্রযুক্তির মোবাইল ফোনের সঙ্গে ইন্টারনেটের মাধ্যমে এ-আই বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা যুক্ত করে সেটাকে জেনেরেটিভ বা স্বয়ংক্রিয়ভাবে আরও বুদ্ধিমান করা হচ্ছে। এর ফলে যুদ্ধ হয়ে উঠেছে দুই রণাঙ্গনভিত্তিক। একটি ভৌগোলিক যুদ্ধক্ষেত্র অন্যটি সাইবার রণক্ষেত্র। ক্রমাগত মেধা পাচার ও অবকাঠামোগত দুর্বলতার কারণে আমাদের সাইবার ক্ষেত্রটি অত্যন্ত দুর্বল। তাই জাতীয় অনুশীলনের সাইবার ক্ষেত্রে প্রবাসীদের যুক্ত করা হলে ঐক্যের রূপরেখটি পূর্ণাঙ্গতা পাবে। তথাকথিত রেমিট্যান্স যোদ্ধা নয়, দেশ রক্ষার জন্য প্রবাসীদের প্রকৃত যোদ্ধার ভূমিকায় অবতীর্ণ হওয়ার সুযোগ করে দিতে হবে। আমাদের এই সামগ্রিক অনুশীলন অন্য কোনো দেশকে আক্রমণ করার জন্য নয়, বরং আক্রান্ত হলে সর্বাত্মক আত্মরক্ষার জন্য। ‘পারবো না’ বলা বাদ দিয়ে আমাদের ‘হারব না’ বলার সাহস ও সামর্থ্য অর্জন করতে হবে।

লেখক: শেখ আলীমুজ্জামান, জাপানপ্রবাসী সমাজ সংগঠক