এক ভোটার তিন ভোট

একটি কেন্দ্র ভোট দিয়েছেন একজনছবি: প্রথম আলো

নতুন বাংলাদেশ এখন সম্ভাবনাময়। এই ক্রান্তিকাল আমাদের অনেক কিছুই ভাবাচ্ছে, কেন এমন হলো এবং কীভাবে ভবিষ্যতে এমন হওয়া থেকে মুক্তি লাভ সম্ভব? সম্ভাবনাময় নতুন বাংলাদেশের জন্য এমন কিছু আইডিয়ার প্রয়োজন, যা আর তাকে পথভ্রষ্ট হতে দেবে না। সে রকমই একটি আইডিয়া হতে পারে বাংলাদেশের গণতন্ত্রে, নিদেনপক্ষে সংসদ নির্বাচনে ‘এক ব্যক্তি তিন ভোট’।

এ আন্দোলন শুরু হওয়ার অনেক আগে থেকেই প্রশ্ন একটি ছিলই, বিকল্প কী বা কে? বিকল্পের প্রশ্ন ওঠার তো কথা নয়। ১৮ কোটি মানুষের দেশে একজন নেতার কোনো বিকল্প থাকবে না, কিংবা কয়েক শ পার্টির একটি দেশে একটি–দুটি দুর্নীতিগ্রস্ত দলের বিকল্প থাকবে না, তা হতে পারে না। কিন্তু সেই বিকল্পকে বের করে আনার প্রসেস থাকতে হবে। আমাদের বর্তমান যে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা, তাতে রয়েছে এক ব্যক্তি এক ভোট এবং এই নিয়মের কারণেই বিকল্প তৈরিতে সমস্যা হয়। এ নিয়মটিই প্রথমে দলের মধ্যে একক নেতৃত্ব এবং পরবর্তী সময়ে একক দলীয় প্রাধান্য বিস্তারে সাহায্য করে।

প্রথমেই এক ব্যক্তি তিন ভোট জিনিসটা কী তা একটু বলি, পরে এর গুণবিচারি করব। একজন ব্যক্তি একই ব্যালটে তিনটি ভোট দেবেন। তিনটি ভোটিং অপশন থাকবে,
১. পছন্দের দলের প্রার্থী (এখানে সব মার্কা থাকবে)
২. ১ নম্বরে পছন্দ করা দলের প্রধানমন্ত্রী প্রার্থী (এখানে প্রতিটি দল থেকে বাধ্যতামূলকভাবে দুজন প্রার্থী থাকবে এবং একই পরিবারের দুজন হতে পারবেন না)
৩. পছন্দের প্রধান বিরোধী দল/দলের প্রার্থী (এখানে সব মার্কা থাকবে)
ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিনে এটা নেওয়া খুবই সহজ। কাগজে করাটা একটু কঠিন, তবে ভোটারদের ভোটকেন্দ্রে বোঝাতে পারলে অসম্ভব নয়।
প্রথমটি এখনকার মতোই, ভোটার ভোট দেবেন যে দলকে তাঁর পছন্দ তার প্রার্থীকে। এই ভোটে যে জয়ী হবে সে এমপি হবে এবং সারা দেশে সংখ্যাগরিষ্ঠ দল সরকার গঠন করবে। দ্বিতীয় সংখ্যাগরিষ্ঠ দল বিরোধী দল হবে।

দ্বিতীয়, ভোটটি দেবেন পছন্দনীয় দলের কাকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দেখতে চান তাঁকে। প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থী প্রতিটি দল থেকে যে দুজন প্রার্থী থাকবে, তারা সেসব দলের ভেতরের প্রাইমারি ইলেকশনের মাধ্যমে জয়ী হয়ে আসবেন। এতে দলের ভেতরে গণতন্ত্র চর্চা অব্যাহত থাকবে এবং প্রতিটি দলেই বিকল্প নেতা তৈরি হবে। ধরা যাক, একটি দল নির্বাচনে জয়ী হলো, তার এক নেতা প্রধানমন্ত্রী হওয়ার জন্য ৭০ শতাংশ ভোট পেল, আরেক নেতা ৩০ শতাংশ ভোট পেল। ৭০ শতাংশের জন প্রধানমন্ত্রী হলো ঠিকই, কিন্তু ৩০ শতাংশের জনও জানল যে একই সঙ্গে দলের ভেতর এবং জনগণের ভেতরে তাঁর গ্রহণযোগ্যতা আছে, এবং সে–ই হবে একজন বিকল্প নেতৃত্ব। এতে দলে পরিবারতন্ত্র বন্ধ হবে এবং ভবিষ্যৎ নেতা তৈরি হয়ে যাবে। দলের মধ্যেও একনায়কোচিত আচরণ চলবে না। বিশেষ করে এখন বাংলাদেশে যে প্রধানমন্ত্রী নির্বাচনের পদ্ধতি, এমপিদের ভোটে প্রধানমন্ত্রী হওয়া, এটা সম্পূর্ণই অর্থহীন একটি নির্বাচন, কারণ সবাই জানে কে হবে প্রধানমন্ত্রী, যিনি দলের একক নেতা তিনিই। এই পদ্ধতি ব্যবহার করলে প্রধানমন্ত্রীর শুধু দলীয় নয়, জনগণের কাছে নিজের গ্রহণযোগ্যতাও পরীক্ষা হয়ে যাবে।

তৃতীয়, ভোটটিকে আপনাদের কাছে অর্থহীন মনে হতে পারে, কিন্তু এটি খুবই জরুরি। এটা ঠিক এই ভোটে বিজয়ীরা সরকার গঠন করবে না, বিরোধী দল হওয়ার সম্ভাবনাও কম। তবে যা করবে তা হলো ভবিষ্যতে নেতৃত্ব দেওয়ার মতো বিকল্প দল তৈরি করবে। উদাহরণ হিসেবে ধরা যাক, আমাদের দেশে যারা আওয়ামী সমর্থক তারা বিএনপিকে পছন্দ করে না, তারা খুব সম্ভবত বিএনপিকে প্রধান বিরোধী দলের ভোটটাও দেবে না, তারা হয়তো বা বিরোধী দল হওয়ার ভোট দেবে জাসদ বা ওয়ার্কার্স পার্টিকে। প্রধান বিরোধী দল হতে ভোট পাওয়া জাসদ কিন্তু আর এখনকার জাসদের মতো আচরণ করবে না। তাদের তখন কোমরে জোর থাকবে। তারা জানবে যে জনগণের মধ্যে তাদের গ্রহণযোগ্যতা আছে। অর্থাৎ দুই দলের বাইরে বিকল্প তৈরি করার যে দীর্ঘদিনের জনআগ্রহ, তা–ও এই পদ্ধতির মধ্য দিয়ে তৈরি করা যাবে। আমাদের বর্তমান নির্বাচনী ব্যবস্থাই বারবার দলীয় ও রাষ্ট্রীয় একনায়ক তৈরি করে। এর বিকল্প খোঁজার সময় এখনই।

লেখক: সামস আফিফ নির্ঝর, পোস্টডক্টরাল গবেষক, স্কুল অব এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড সোসাইটি, টোকিও ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি, জাপান