নির্ঘুম সফরনামা

ছবি: লেখকের পাঠানো

সময়কাল: ১৪ জুন থেকে ২২ জুন '২৫।

সফরটা হওয়ার কথা ছিল গত বছর। কিন্তু ভাগ্য যেন বারবার পিছু টানছিল। দেশে পরপর দু'বার যাওয়া হওয়ায় সে যাত্রা ভেস্তে গেল। এবারও যখন প্রস্তুতির সময় এল, বন্ধুরা কোমর বেঁধে তৈরি হলেও আমি একটু গড়িমসি করছিলাম। মজার ব্যাপার, ওদের যত না আগ্রহ সফরের, তার চেয়েও বেশি যেন আমাকে সঙ্গি করার! ভালোবাসাটা একটু বেশিই পেয়েছি, বলতেই হয়।

আমাদের গ্রুপ কলের আড্ডাগুলো জমে উঠত ইমাম, লিমন, মাজহার জনি আর সৌরভকে নিয়ে। আর আমি ছিলাম খুনসুটির প্রধান টার্গেট! “তুই যাবি না, এবারও ক্যানসেল,” বলে বলে খুব অপদস্ত করার চেষ্টা করতো। এমনকি বলত, “যে বার্সেলোনার অলি গলি চেনে না, সে আবার মার্কিন মুল্লুক যাবে?”। অথচ আমার মনে অন্যরকম অনুভূতি ছিল, শরীরে ডোপামিন, অ্যাড্রেনালিন হরমোনের রেস চলেছিল।

বার্সেলোনায় স্ত্রী, মেয়ে-ছেলে, দেশে মামনি বেশ উৎকণ্ঠায় ছিলেন। অবশেষে সব দুশ্চিন্তা দূরে ঠেলে, ডেল্টার ফ্লাইটে চড়ে পৌঁছাই নিউইয়র্কের জেএফকে বিমানবন্দরে। কিন্তু কপাল খারাপ, একসাথে একগাদা ফ্লাইট, কম ইমিগ্রেশন অফিসারের (মার্কিনি!!!) কারণে আমাকে এয়ারপোর্ট ছাড়তে লেগে গেল চার ঘণ্টা! সেই ফাঁকে বাহিরে অপেক্ষমাণ মাজহার জনির কপাল আরও খারাপ, অতিক্ষুধায় ফুড পয়জনিংয়ে গোটা ট্রিপটাই কষ্টে কেটেছে।

সৌরভ আগেভাগেই কানাডা থেকে পৌঁছায় নিউইয়র্কে। রাতভর আমরা তিনজন মিলে ঘুরে বেড়ালাম এই ব্যস্ত নগরী। ভোরবেলা শুরু হল মিশিগানের উদ্দেশে যাত্রা সাথে মাজহার জনি।

ডেট্রয়েট বিমানবন্দরে পৌঁছাতেই লিমন, ইমাম, আর মুহিম মামু আমাদের হাসিমুখে বরণ করে নিল। এখান থেকেই শুরু আমাদের নির্ঘুম ভ্রমণ, মনে হয়না পুরো সফরে ২৪ ঘণ্টার উপর ঘুমিয়েছি। আত্মার মতো কাছের মানুষদের শহর, মিশিগান।

মিশিগানে বড়সি ফেলা, পিকনিক, কারাওকে সন্ধ্যা, পারিবারিক আড্ডাগুলো ছিল জ্যান্ত স্বপ্ন। সাথে ছিল সাউথ ব্যাস দ্বীপ ভ্রমণ, ওয়ারেন সিটি থেকে ২০০কি.মি. দূরত্বে ওহাইয়ো অঙ্গরাজ্যের লেক এরি হ্রদের মধ্যে এ দ্বীপে প্রায় পুরো একদিন কাটাই। দ্বীপের পুটইনবে শহরে ঢুকতে ফেরিতে ২০মিনিট ছিলাম, এরপর গল্ফ কার্ট ভাড়া করে আমরা ঘুরে দেখলাম সিনেমার মত দ্বীপটি।

চারদিন ছিলাম মিশিগানে। এরপর শুরু হলো আসল যাত্রা, রোড ট্রিপ! অ্যামেরিকা, কানাডা আবার অ্যামেরিকা। সফরসঙ্গি ইমাম, লিমন, মাজহার জনি, সৌরভ আর বিশ্বস্ত গ্র্যান্ড হাইল্যান্ডার। ১৪০০ কি.মি. যাত্রা আমরা বানালাম ২৭৫০ কি.মি, প্রতিটি শহরে ছিল প্রিয় কোনো মানুষ, কোনো না কোনো টান। ঘুরে এলাম ডেট্রয়েট, উইন্ডসর, লন্ডন, কিচেনার, মিসিসাগা, টরন্টো, হ্যামিল্টন, নায়াগ্রা ফলস, বাফেলো, রোচেস্টার, সিরাকিউজ, অ্যালবানি আর শেষমেশ ফিরে নিউ ইয়র্ক সিটি।

লিমনের ককপিট স্টাইলে ঘোষণা আমাদের ট্রিপে যোগ করল ভিন্ন মাত্রা। “আপনাদের সবাইকে স্বাগতম আমাদের এ যাত্রায়, সাথে থাকছি আমি নাফিজ… বাহিরে তাপমাত্রা … গাড়িতে তাপমাত্রা… যারজারি চার্জার যার জারিই ব্যবহার করুন, ধন্যবাদ।” এই ‘যারজারির চার্জার’ কথাটি যারাই শুনেছে সবাই হাসিতে লুটোপুটি খেয়েছে।

মিশিগানে মুহিম মামু, সাইফুল, হিমু, পামেল, পলাশ, সুহেল মামা, কানাডায় সন্দ্বীপ, সুহেল ভাই, দেলোয়ার ভাই, রিপন, বাফেলোতে কাওসার, সুমন ভাই, রুমকি আপা, নিউ ইয়র্কে রনি, মাসুম, আলতাফ ভাই, কয়সর ভাই, শিপু, মান্নান, লিসান, মাজহার, জাবেদ খসরু ভাই, ফাহাদ, বুলবুল আপনাদের ভালোবাসা, আতিথেয়তা আমাদের সফরের সবথেকে দামী স্মৃতি।