এক মহানুভব মানুষের চির প্রস্থান

ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী
ফাইল ছবি

ফেসবুক খুলতেই ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীর মৃত্যুর সংবাদ চোখে পড়ল সেদিন । মনটা ভীষণ ভারাক্রান্ত হয়ে গেল। তারপর নিচের দিকে স্ক্রল করতেই আমার ফেসবুক বন্ধুদের তাঁকে নিয়ে লেখা পড়লাম এবং সেই সঙ্গে বেশ কিছু সংযুক্ত ভিডিও দেখলাম। আমি ব্যক্তিগতভাবে সব সময় কোনো বিশেষ লেখার মন্তব্যগুলো পড়তে পছন্দ করি, যেটা ওই বিষয়টা সম্পর্কে আমার কাছে আরও বেশি স্বচ্ছতা বা স্পষ্টতা এনে দেয়।

এখানেও আমি সব মন্তব্য পড়লাম, যা ছিল দলমত–নির্বিশেষে সব ধরনের মানুষের কণ্ঠে তাঁর প্রতি নির্বিঘ্নে সুগম্ভীর জয়গান, বিনম্র শ্রদ্ধা এবং এক আশা জাগানিয়ার অবিশ্বাসযোগ্য সত্য কাহিনির আলোচনা ও পর্যালোচনা। সেখানে সাবলীলতার উপস্থিতি ছিল স্পষ্ট এবং আমরা সেন্সর করা বলতে যা বুঝি তার লেশমাত্র উপস্থিতি আমি দেখিনি।

গণস্বাস্থ৵ এবং ডা.জাফরুল্লাহ চৌধুরীর সঙ্গে পরিচয় আমার বেশ আগে।, ১৯৯৮ সালে গণস্বাস্থ্য নগর হাসপাতাল। রাঙামাটি থেকে ঢাকায় এসেছিলাম ভালো কোনো হাসপাতালে সন্তান ভূমিষ্ঠের জন্য। আত্মীয়-স্বজনের পরামর্শে তখন গণস্বাস্থ্য নগর হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলাম। জন্মের পর আমার মেয়েটার শারীরিক অসুস্থতার জন্য আমাকে একটানা ১৭ দিন ওই হাসপাতালেই থাকতে হয়েছিল।

আর আমার মেয়েটার জন্মের সময় জাফরুল্লাহ চৌধুরীকে খুব কাছ থেকে দেখার সৌভাগ্য হয়েছিল। বাবরি চুলের বেশ লম্বা-চওড়া মানুষটার দৃপ্ত চালচলন আর বলিষ্ঠ বাচনভঙ্গির কারণে আমার চোখে পড়া তিনি এক অনন্য বৈশিষ্ট্যর ব্যক্তিত্ব। আমার মনে পড়ে সকাল নয়টার দিকে তিনি হাসপাতালে এসে রোগী, অভিভাবক, নার্স, চিকিৎসক, টেকনিশিয়ান সবার মধে৵ প্রাণের জোয়ার বইয়ে দিতেন।

তাঁর উপস্থিতিতে হাসপাতালের সব কর্মকর্তা-কর্মচারী তাঁদের নিজেদের দায়িত্ব খুব সক্রিয়ভাবে পালনে মনোযোগী থাকতেন। তিনি রোগীদের দেখার জন্য পুরো হাসপাতালে একটি চক্কর দিতেন এবং কোন রোগীর কী সুবিধা-অসুবিধা সব খোঁজ নিতেন।

আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার আলোকে, চিকিৎসাক্ষেত্রে মানুষের কল্যাণে তাঁর অবদান অতুলনীয় এবং তাঁর তুলনা শুধু তিনি নিজেই। আমার দেখা ওই সময় তাঁর হাসপাতালে সব রোগীর জন্য সমান এবং বিবিধ সুযোগ–সুবিধার ব্যবস্থা ছিল। আর হাসপাতালের সব চিকিৎসক ও নার্সের ব্যবহার ছিল অমায়িক, যা আমি জীবনেও ভুলব না।

ওখানে অনেকটা পাশ্চাত্যের হাসপাতালের মতো প্রসূতি মায়ের প্রতি সম্মান এবং খাতির-যত্নের সুব্যবস্থা যা আমার মনোজগতের কৃতজ্ঞতায় স্থান করে নিয়েছে। যেমন দাঁত ব্রাশ করানো; চুল আঁচড়ানো; নবজাতকের বাবা হওয়ার পেছনে একজন মায়ের কষ্ট অনুধাবনের জন্য সন্তান প্রসবের সময় ওই হাসপাতালে স্বামী ছাড়া আর অন্য কাউকে থাকতে না দেওয়া; বাবাকে নবজাতকের যত্ন নেওয়ার জন্য সারা রাত ছোট্ট টুলের ওপর জাগিয়ে রেখে মাকে ঘুমাতে সাহায্য করা; নবজাতকের সুবিধার জন্য মায়ের ইচ্ছা বা চাওয়াকে গুরুত্ব দেওয়া ইত্যাদি।

ডেলিভারি চার্জের কথাটা না বলেই নয়, সেই সময় কসমেটিক সিজারিয়ান করাতে তাঁর গণস্বাস্থ্য নগর হাসপাতালে প্রতিটি প্যাকেজ—চিকিৎসক, ওষুধ, অ্যানেসথেসিয়া, প্যাথলজিক্যাল পরীক্ষায় সব মিলিয়ে আট হাজার টাকা লাগত। পাশাপাশি যেখানে ঢাকার অন্যান্য প্রাইভেট হাসপাতালে লাগত প্রায় ২৫ হাজার টাকা। তবে আমার মেয়েটার জন্য ওই ১৭ দিনে আরও  বাড়তি চিকিৎসক, ওষুধ ও প্যাথলজিক্যাল পরীক্ষা লেগেছিল, যার সবই এই আট হাজার টাকার মধ্যে ছিল।

মেয়েটা জন্মের রাতেই বিভিন্ন ধরনের এক্স–রে, প্লাস্টার, চিকিৎসকদের বোর্ড মিটিং এবং সেই রাতেই জানা গেল আমার মেয়েটার ‘Brittle Bone Disease OR Osteogenesis Imperfecta Disease’–এর কথা। এ ‘Brittle Bone Disease’ বা হাড়ভাঙা রোগের নাম অনেকের মতো আমিও জানতাম না, যতক্ষণ পর্যন্ত আমার মেয়েটি এ রোগ নিয়ে জন্ম নেয়।

যাহোক, তারপর শুরু হলো মেয়েটার সুচিকিৎসার সংগ্রাম। আমরা প্রতি তিন মাস পরপর নিজেদের টাকা দিয়ে ভারতের চেন্নাই থেকে আমার মেয়ের জন্য প্যামিড্রোনেট ইন্ট্রাভেনাস ইনজেকশন আনতাম। শিশুরোগ–বিশেষজ্ঞ মেজবাহ উদ্দিনের তত্ত্বাবধানে এ ছোট্ট ইঞ্জেকশনটা স্যালাইনের মাধ্যমে দিতে তিন দিন লাগত। এই তিন দিনের মধে৵ প্রতিদিন চার ঘণ্টা করে একটা একক রুমে আমাদের থাকার ব্যবস্থা থাকত।

কানাডা আসার আগে ছয় বছর ধরে এভাবে এই কাজ গণস্বাস্থ্য নগর হাসপাতাল আমার মেয়েটির জন্য করেছিল। আর সেই সঙ্গে বিভিন্ন সময়ে বহুবার আমার মেয়ের হাতে-পায়ে প্লাস্টার ওই হাসপাতাল থেকেই করাতাম। কখনো অ্যানেসথেসিয়া দিয়েও প্লাস্টার করানো হতো। আমার মেয়ের এসব বিভিন্ন ধরনের চিকিৎসার সহায়তায় এ ছয় বছরে সেখানে আমাদের এক টাকাও কোনো দিন বাড়তি খরচ লাগেনি। যা আমার মেয়ের ভূমিষ্ঠ হওয়ার সময় ওই সেই প্যাকেজ আট হাজার টাকার মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল।

কয়েক দিন ধরেই তাঁর অসুস্থতার সংবাদ ফেসবুকে দেখছিলাম। তাঁর চির বিদায়ের সংবাদে মনটা খুব ব্যথিত হয়ে গেল। মানুষ পৃথিবীতে আসে এবং চলে যায় চিরদিনের জন্য। তবে অল্প কিছু মানুষ তাদের জীবদ্দশায় এমন কিছু করে রেখে যান, তা সারা জীবনের জন্য এক উদাহরণ হয়ে থাকে ব্যক্তি,সমাজ ও রাষ্ট্রের কাছে।

ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী ঠিক এমন একজন মানুষ, যিনি সব ধরনের মানবিক গুণাবলিতে ভূষিত এক শাশ্বত অগ্রদূত। আমাদের দেশ অসাধারণ ত্যাগী, দরদি, সত্যনিষ্ঠ এক মহান দেশপ্রেমী ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীকে হারাল। যিনি  কিংবদন্তি হয়ে থাকবেন। আল্লাহ তাআলা তাঁকে জান্নাতুল ফেরদৌস দান করুন।