মহেন্দ্র

অলংকরণ: মাসুক হেলাল

 ১.

 মৃত মানুষ হুট করে জীবন্ত হয়ে উঠলে মানুষের মনে দুই ধরনের ছাপ পড়ে। প্রথমটি হলো ভয়ের। আর দ্বিতীয়টি হলো বিস্ময়ের। যোগেনকে দেখে আমার মনের মধ্যে দ্বিতীয় ছাপটি পড়ল। অবাক বিস্ময়ে যোগেনের দিকে তাকিয়ে থাকলাম। যোগেন কোনো মৃত মানুষ না, যে আবার জীবন্ত হয়ে উঠেছে। যোগেন আর দশজন জীবন্ত মানুষের মতোই। তবু তাকে দেখে আমি সেরকমই বিস্মিত হলাম। শুনেছি মানুষ ধপাস করে মাটিতে পড়ে যায়। আমার কাছে মনে হলো আমি যেন ধপাস করে দাঁড়িয়ে পড়লাম। বিস্ময়ের মূল কারণ যোগেন নয়, কারণ হলো ‘মহেন্দ্র’। যোগেনের মুখে নামটা শোনার পর থেকে অনবরত কানের মধ্যে কেমন যেন ঘণ্টার মতো বাজতে থাকল, মহেন্দ্র...মহেন্দ্র...মহেন্দ্র...

 হঠাৎ বৃষ্টির আগে মেঘমালা যেমন আলোকিত পুরো পৃথিবীকে অন্ধকারে আচ্ছন্ন করে ফেলে, তেমনি জীবনেও এরূপ মেঘমালার আগমন ঘটল। আমার পুরো জগৎ অন্ধকারে ছেয়ে গেল। ঘটনা ঘটল আমার গর্ভধারিণী মায়ের মৃত্যুতে। মায়ের মৃত্যুতে আমি ভীষণ রকম ভেঙে পড়লাম। আমার ছোট কোমল হৃদয় এ রকম স্পর্শকাতর বিয়োগান্ত পরিণতি সহজভাবে নিতে পারল না। সারা দিন পাগলের মতো বাড়ির চারপাশে, পুকুরপাড়ে, বাড়ির পেছনের জঙ্গলে ঘোরাঘুরি করতে লাগলাম। মাকে খুঁজছি। আমার অবুঝ মন বারবার বলছে মা বেঁচে আছেন। হয়তো কোথাও গেছেন। খুঁজলেই পেয়ে যাব।

 বড়দের অস্বাভাবিক আচরণ যতটা গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করা হয়, ছোটদের ক্ষেত্রে তা হয় না। আমার অস্বাভাবিকতাও তেমনি কারও নজরে পড়ল না। তবে বিষয়টা বাবার চোখ এড়াল না। মায়ের মৃত্যুতে বাবা যতটা না কষ্ট পাচ্ছিলেন, তার চেয়ে বেশি কষ্ট পাচ্ছিলেন আমার অনিয়ন্ত্রিত মনের পরিণতি দেখে। একটা সময় বাবা আমাকে নানাবাড়ি রেখে আসার সিদ্ধান্ত নিলেন। বাবা বললেন, এখানে আর কিছুদিন থাকলে আমি পুরোপুরি অসুস্থ হয়ে যাব। তা ছাড়া এখানে আমার দেখাশোনা করারও তেমন কেউ নেই। সারা দিন একা একা থাকি। নানাবাড়ি গেলে আমি ভালো থাকব। মামাতো ভাইয়েরা আছে, তাদের সঙ্গে খেলাধুলা করে ভালোই সময় কাটবে।

 এরপর একদিন বাবা আমাকে নানাবাড়ি রেখে এলেন। নানাবাড়িতে আমার পরিচর্যার কোনো কমতি হলো না। নানা-নানি থেকে শুরু করে মামা-মামি সবাই আমার ভালোভাবে দেখাশোনা করতে লাগলেন। তবে এখানেও ওই একটা জিনিসের অভাববোধ অনুভব করতে লাগলাম। মায়ের অভাব! মায়ের স্মৃতি যেন কিছুতেই মন থেকে দূর করতে পারছিলাম না। পুকুরপাড়ে পুরো দিন মন খারাপ করে বসে থাকি। মায়ের সঙ্গে কাটানো মুহূর্তগুলো মনে করার চেষ্টা করি। মামাতো ভাইদের সঙ্গে যে একটু মিশব, খেলাধুলা করব, তা-ও সম্ভব হলো না। তারা তেমন আগ্রহ প্রকাশ করল না।

 বড় মামা একসময় স্কুলে ভর্তি করে দিলেন। মামা বললেন, মন দিয়ে পড়াশোনা কর, দেখবি সব ঠিক হয়ে যাবে। বড় মামার কথামতো পড়াশোনায় মন দেওয়ার চেষ্টা করলাম। বইয়ের গল্পে স্কুলগুলো বাড়ি থেকে কয়েক ক্রোশ দূরে থাকত। তবে আমার স্কুল নানাবাড়ি থেকে দেখা যেত। বাড়ি থেকে ঝোপঝাড়ের মধ্য দিয়ে একটা পথ এঁকেবেঁকে সাপের মতো চলে গেছে স্কুলের দিকে। আমি আঁকাবাঁকা পথে স্কুলে যেতাম না। ধানখেতের মধ্য দিয়ে সরু একটা পথের মতো ছিল, গ্রামে আল বলে। আমি আল ধরে স্কুলে যাই। আমার সঙ্গে অনেকেই এ পথে স্কুলে যায়।

এখনকার মতো তখন স্কুলব্যাগের প্রচলন তেমন ছিল না। সবাই বইপত্র বগলদাবা করে স্কুলে যেত। তবে আমার মতো কিছু ছাত্র-ছাত্রী ছিল। যাদের বিলাসিতার কোনো অভাব ছিল না। শরীরের পরিধেয় বস্ত্র থাকত পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন, পায়ে থাকত জুতা, মাথার চুল থাকত সিঁথি করা। তারাই ব্যাগ নামের অদ্ভুত বস্তুটি ব্যবহার করত। পথে-ঘাটে মানুষের মতো দেখতে হলেও পাগলের প্রতি মানুষ যে কৌতূহল নিয়ে তাকায়, আমাদের দশাও ছিল তেমন-ই। স্কুলে ঢোকার সময় ছাত্র-ছাত্রীই কৌতূহলে আমাদের দিকে তাকিয়ে থাকত। কৌতূহলের পুরোটা ছিল পিঠের অদ্ভুত বস্তুটির দিকে।

 মামার কথামতো পড়াশোনায় মন দিলাম। কয়দিন যেতে না যেতেই যার ফল পেতে লাগলাম। ক্লাসের শিক্ষকেরা আমার উন্নতির বিস্তর প্রশংসা করতে লাগলেন। এত কিছুর পরও মায়ের স্মৃতি মনের মধ্যে আঠার মতো রয়ে গেল। জীব যেমন একের পর এক প্রাণের সঞ্চার করে, মায়ের স্মৃতিও তেমনি আমার মস্তিষ্কে বেদনার সঞ্চার করতে লাগল। একসময় স্কুলজীবনও অস্বাভাবিক হতে লাগল। কেমন যেন প্রাণহীন অনুভূতি!

হঠাৎ বৃষ্টির আগে ঠিকই আকাশে গাঢ় মেঘ এসে আলোকিত পৃথিবীকে অন্ধকারে ছেয়ে ফেলে। তবে হঠাৎ বৃষ্টির পর কিন্তু পুব আকাশে রংধনু দেখা যায়। আমার জীবনেও তেমনি রংধনুর সাত রং নিয়ে মহেন্দ্রর আগমন। প্রতিদিনের মতো সেদিনও ক্লাসে কোনার বেঞ্চে বসেছি। প্রথম ক্লাস শেষে দ্বিতীয়টার ঘণ্টা পড়েছে। কিছুক্ষণের মধ্যই অতুল স্যার ঢুকবেন। স্যার বাংলা পড়ান। অসাধারণ সুন্দর করে গল্প বলেন। শুনতে ভালো লাগে। সবাই স্যারের অপেক্ষা করছি। হঠাৎ দেখি দরজায় হাফপ্যান্ট আর স্যান্ডগেঞ্জি পরা ছেলেটা দাঁড়িয়ে আছে। বগলে স্লেট আর আদর্শলিপির বই। পায়ে জুতার বালাই নেই। পা ধুলাবালুতে মাখামাখি। আগে কখনো ক্লাসে দেখিনি। প্রথম দেখলাম। ডিটেকটিভ গল্প-উপন্যাসে গোয়েন্দারা যেভাবে তার চারপাশ পর্যবেক্ষণ করে, সেও তেমনি মাথা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে ক্লাসের চারপাশ দেখছে। দরজা থেকে সোজা আমার দিকে এগিয়ে এল। আমি কিছু বলার আগেই গম্ভীর গলায় বলল, ‘ওই রতন, সইরা বস, আমি এইহানে বসমু।’

 আমি প্রথমে ধাক্কার মতো খেলাম। যাকে আমি চিনি না, কখনো দেখিনি, সে কিনা আমার নাম জানে। সেটা নাহয় ঠিক আছে, কিন্তু আমার সঙ্গে কেউ কখনো ‘তুই-তুকারি’ করে কথা বলে না। আর এ কিনা প্রথম দেখাতেই তুই করে বলল। আমি অন্যমনস্কের মতো বেঞ্চে একটু সরে বসলাম। ছেলেটি আমার পাশে বসল। স্লেট আর বইটা সামনে রাখতে রাখতে মুচকি হেসে ফিসফিসিয়ে বলল, ‘আমার নাম মহেন্দ্র, আমি তরে চিনি।’

অলংকরণ: আরাফাত করিম

 সেই থেকে মহেন্দ্র কৈশোর জীবনে মিশে গেল। মস্তিষ্ক থেকে আগের বেদনার সব স্মৃতি একে একে বিদায় নিতে শুরু করল। সেখানে নদীর পলিমাটির মতো স্থান করে নিল মহেন্দ্র। দিনের শুরু থেকে শেষ অবধি মহেন্দ্রই নিত্যদিনের সঙ্গী।

 মহেন্দ্রর উচ্চতা আমার চেয়ে এক ফুটের বেশি। সেটা সমস্যা ছিল না। মহেন্দ্রর মধ্যে রহস্যময় একটা ব্যাপার ছিল। মাঝেমধ্যে সে কোথায় যেন উধাও হয়ে যেত। দু-এক দিন কোনো খোঁজ নেই। হুট করে মহেন্দ্রর হারিয়ে যাওয়াতে আমার খারাপ লাগত। সারা দিন গ্রামসুদ্ধ মহেন্দ্রকে খোঁজাখুঁজি করি। কোথাও নেই। এভাবে দুই দিন কেটে যাওয়ার পর হঠাৎ দেখি মহেন্দ্র বাড়ির সামনে ঘুরঘুর করছে। দৌড়ে মহেন্দ্রর সামনে যাই। মহেন্দ্রর মুখে রহস্যময় হাসি। কথার মধ্যে কিছুটা গাম্ভীর্য এনে বলে, ‘একটু কামে আছিলাম রে, তাই আইবার পারি নাই।’

 এ বয়সে মহেন্দ্রর মতো একটা ছেলের কিসের কাজ থাকে, তা বুঝতে পারি না। গভীর কৌতূহলে মহেন্দ্রকে জিজ্ঞাসা করি, ‘কিসের কাজে ছিলি?’

 মহেন্দ্র কিছুই বলে না। শুধু রহস্য করে হাসতে থাকে। কথা ঘুরিয়ে অন্য কথা বলে, ‘চড়ুইপাখির বাসা লইবি? চল। বাদুড়জঙ্গলা বাড়িটার তালগাছটায় এইবার ম্যালা চড়ুই বাসা বানাইছে। গাছতলায় বাসা পইড়া থাকে। ঝড়-তুফানে বাসাগুলান ছিঁড়া পড়ে। বাসাগুলাতে মাঝেমধ্যে বাচ্চাও থাকে। চল যাই।’

 পরক্ষণেই কৌতূহল দমে যায়। মহেন্দ্রর এত কাজের কারণ আর জানা হয়ে ওঠে না। আমরা জঙ্গলের দিকে চলে যাই চড়ুইপাখির বাসার খোঁজে।

 বর্ষায় আমাদের বিলে প্রচুর শাপলা ফোটে। দূর থেকে ফুলের সৌন্দর্য দেখে মোহিত হই। প্রত্যেক বিকেলে আমি আর মহেন্দ্র বিলের ধারে বসে থাকি। বর্ষায় প্রচুর মাছ পাওয়া যেত। অনেকেই সারা দিন মাছ ধরত। মাছ ধরার দৃশ্যও দেখার মতো। একেক জনের কত ধরনের মাছ ধরার সরঞ্জাম। চটকা জাল, মুঠা জাল, ভোড়ং, বড়শি আরও কত কী, যেগুলোর নামই আমি জানি না। মহেন্দ্র মাঝেমধ্যে কোথা থেকে দুটো বড়শি জোগাড় করে নিয়ে আসত। তখন দুজন মিলে বড়শিতে কেঁচো গেঁথে মাছ ধরতাম। মহেন্দ্র বলত ‘চ্যাঁরা’। আমি চ্যাঁরা গাঁথতে পারতাম না। ভয় ভয় লাগত। বড়শিতে চ্যাঁরা গেঁথে দেওয়ার কাজটা মহেন্দ্রই করত।

 বড়শি দিয়ে মাছ ধরা ধৈর্যের কাজ। বড়শি ফেলে অনেকক্ষণ বসে থাকতে হয়। আমার তেমন ধৈর্য নেই। কিছুক্ষণ বসে থাকার পর বিরক্ত হয়ে পড়ি। মহেন্দ্র বুঝতে পারে আমার অবস্থা। একসময় পানি থেকে বড়শি উঠিয়ে বলতে থাকে, ‘ধ্যাৎ, আইজ বড়শিতে মাছ উঠবে না রে রতন। সব মাছ মনে হয় দাওয়াত খাইবার গেছে।’

 মহেন্দ্রর কথা শুনে হাসি পায়। আমি হাসতে হাসতে বলি, ‘মাছ আবার কোথায় দাওয়াত খেতে যাবে?’

 মহেন্দ্র এবার শিক্ষকের মতো গম্ভীর গলায় কথা বলে। আমাকে বোঝানোর চেষ্টা করে। মহেন্দ্র বলে, ‘মাইনসের মতন মাছেরও বিয়া হয়, বুঝলি! বিয়ার বেপার, একা একাতো করবার পারে না। এল্লাইগাই মাছরা অন্য সব মাছগো দাওয়াত-ফাওয়াত দেয়। দেহস না, পুঁটি মাছের গায়ে লাল রং থাহে। লাল হইল সিন্দুরের রং। হেইসব মাছের বিয়ে হইছে বইলাই শইলে সিন্দুর দিয়া রাহে।’ কথা শেষে মহেন্দ্র জোর দিয়ে বলে, ‘এইবার বুঝছস?’

 আমি মহেন্দ্রর কথার জবাব না দিয়ে অবাক হয়ে উল্টো প্রশ্ন করি, ‘তাহলে পুঁটি মাছ কি হিন্দু নাকি রে?’

 মহেন্দ্র কিছুটা রেগে গিয়ে বলে, ‘পুঁটি মাছ হিন্দু হইতে যাইব কেন?’

 ‘ওই যে, তুই বললি সিঁদুর দেয়। সিঁদুরতো হিন্দুরা দেয়?’

 ‘আরে গাধা, মাছের কোনো হিন্দু-মুসলমান নাই। মাছ মাছই।’

 মহেন্দ্র সব প্রশ্নেরই সুন্দর একটা জবাব দিত। শুনতে ভালো লাগত। আমি এবার একটু রসিকতা করে বললাম, ‘তুই এত কিছু জানলি কীভাবে? মাছ কী বিয়েতে তোকে কখনো দাওয়াত করেছিল?’

 আমার কথা শুনে মহেন্দ্র একটু হাসল, কোনো কথা বলল না।

 কিছুক্ষণ দুজনেই চুপ থাকার পর মহেন্দ্রই প্রথমে কথা বলতে শুরু করল। মহেন্দ্র বলল, ‘রতন আইজ রাইতে শাপলা তুলবার যাইবি?’

 মহেন্দ্রর কথা শুনে খুব উৎসাহ অনুভব করলাম। তবে রাতের কথা শুনে কিছুটা দমে গেলাম। রাতে বাসা থেকে বেড় হতে কোনো সমস্যা নেই। মামাতো ভাইদের সঙ্গে ঘুমাই। রাতে চুপ করে বের হলে কেউ টের পাবে না। এর আগেও বেশ কয়েকবার মামাতো ভাইদের সঙ্গে আম কুড়াতে বের হয়েছিলাম। তবু অজানা আতঙ্কে মন সায় দিচ্ছিল না। এদিকে বিলে শাপলা তোলার শখও দমিয়ে রাখতে পারছি না। মহেন্দ্রকে ধীরে ধীরে বললাম, ‘রাতে কেন? দিনের বেলা যাই। রাতে আমার ভয় করে।’

মহেন্দ্র রেগে গিয়ে বলল, ‘গাধা কোনহানগার। সঙ্গে আমি থাকমু না! আর শাপলা বিলের মাঝহানে। সেইহানে যাইতে হইলে নৌকা লাগব। দিনের বেলা ফাঁকা নৌকা কোনহানে পাবি?’

 বর্ষাকালে গ্রামগুলোর চারদিকে পানি থই থই করে। পথঘাট ডুবে একাকার হয়ে যায়। ফলে যাতায়াতের একমাত্র মাধ্যম নৌকা। দিনভর নৌকার মাঝিরা ভাড়া খাটেন। রাত হলে নৌকা বিলের ধারে বেঁধে রেখে যায়। আমি বললাম, ‘কার নৌকা নিয়ে যাবি? তোর কী কোনো পরিচিত মাঝি আছেন নাকি?’

 মহেন্দ্র বলল, ‘পরিচিত লাগব কেন? রাইতেতো সবাই নৌকাই পাড়ে বান্ধা থাহে। চুপ কইরা একটা নিয়ে গেলে কেউ টের পাইব না। আমি প্রত্যেক দিনই যাই।’

 মহেন্দ্রর কথায় কিছুটা অবাক হলাম। মন খারাপ করে বললাম, ‘তুই রোজই শাপলা তুলতে যাস। কই আমাকেতো কখনো বলিসনি।’

 মহেন্দ্র কিছুটা রহস্য করে হাসল। মহেন্দ্র মাঝেমধ্যে এ রকম রহস্য করে হাসে। কখনোই এ রহস্যের কারণ আমি বুঝি না। কিছুক্ষণ চুপ থাকার পর মহেন্দ্র বলল,

 ‘রাইতে আমি তরে ডাকতে আসমু। তুই জাইগা থাকিস। তিনবার ডাক দেওনের পর বাইর হইয়া আইবি। মনে রাখবি, তিনবারের কম ডাক দিলে বাইর হইবি না।’

 আমি বললাম, ‘তিনবার ডাকতে হবে কেন?’

 মহেন্দ্র এবারো রেগে গিয়ে বলল, ‘তুই দেহি কিছুই জানস না। শোন, ভূতেরা দুইবারের বেশি ডাহে না। তাই কইলাম তিনবার ডাক না শুনলে বাইর হইবি না। তিনবারের বেশি ডাকলে সমস্যা নাই। কিন্তু তিনবারের কম না। যা অহন বাইত যা।’

 আমি বললাম, ‘তুই বাসায় যাবি না?’

 মহেন্দ্র বলল, ‘আমার কাম আছে, আমি পরে যামু।’

 কী কাজ আছে, সে বিষয়ে আর কোনো প্রশ্ন করলাম না। প্রশ্ন করলেও মহেন্দ্র কিছু বলত না। শুধু রহস্য করে হাসত। আমি বাড়ি চলে গেলাম।

২.  

পূর্ণিমার রাত। জ্যোৎস্নার আলোয় বিলের চারপাশ ছেয়ে গেছে। এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্ত স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। চাঁদের আলো বিলের মধ্যে এসে পড়েছে। বিলটা এখন একটা আকাশ মনে হচ্ছে। ফুটন্ত শাপলাগুলোকে মনে হচ্ছে আকাশের তারা। বিলের ধার ঘেঁষে গজিয়ে ওঠা শিশু গাছগুলোকে ছোট ছোট পাহাড়ের মতো দেখাচ্ছে। সেখান থেকে মাঝেমধ্যে দু-একটা বাদুড়ের মতো অজানা পাখি ডানা ঝাপটা দিয়ে বেরিয়ে আসছে। অদূরের একটা নৌকা থেকে থেমে থেমে শিশুর কান্নার আওয়াজ ভেসে আসছে। নৌকাগুলোয় মিটিমিটি করে হারিকেন জ্বলছে। মহেন্দ্র বলেছিল, এগুলো জেলেদের নৌকা। বর্ষায় তাঁরা মাছ ধরতে এখানে আসেন। সঙ্গে পরিবার নিয়ে আসেন। রান্নাবান্না সবকিছু নৌকাতেই। বর্ষা শেষে বিলের পানি কমে গেলে ফিরে যান জেলেপল্লিতে। সব মিলিয়ে যেন অদ্ভুত রহস্যময় পরিবেশ। রহস্যের পরিমাণ আরও বেশি বাড়িয়ে তুলেছে জ্যোৎস্নার রাত। আমি মন্ত্রমুগ্ধের মতো এই অপূর্ব দৃশ্য উপভোগ করছি। হঠাৎ মহেন্দ্রর কথায় সংবিৎ ফিরে পেলাম।

 ‘কিরে, তহনতো নৌকায় উঠতে ভয় পাইতাছিলি। অহন কি ভয় লাগতাছে?’

 মহেন্দ্রর কথায় একটু লজ্জা পেলাম। কোনো কথা বলতে পারলাম না। সত্যিই প্রথমে নৌকায় উঠতে ভীষণ ভয় পাচ্ছিলাম। বাসা থেকে কোনো সমস্যা ছাড়াই বের হয়েছিলাম। ভয় লাগেনি। তবে নৌকায় ওঠার সময় কেমন যেন ভয় করতে লাগল। মহেন্দ্রকে নয়, ভূতকে ভয় লাগছে। শুনেছি এ রকম বিলে নাকি মেছো ভূত থাকে। রাতের বেলা কেউ মাছ ধরতে এলে বিলের মধ্যখানে নিয়ে গিয়ে পানিতে ডুবিয়ে মেরে ফেলে। ভয়ের ব্যাপারটা মহেন্দ্রকে বলতেও পারছি না।

 আমাকে নৌকায় উঠতে না দেখে মহেন্দ্র হাসতে হাসতে বলল, ‘কিরে, ভয় পাইতাছস?’

 আমি বললাম, ‘হুম, একটু ভয় লাগছে। আমিতো সাঁতার জানি না। নৌকা যদি ডুবে যায়?’ পাচ্ছিলাম ভূতের ভয় কিন্তু মুখ ফসকে বের হয়ে গেল সাঁতারের কথা। সাঁতার আমি জানি।

 মহেন্দ্র বলল, ‘গাধা কোনহানকার। আমি আছি না, ভয় কিসের? নৌকা ডুবে গেলে তরে ঘাড়ে কইরা পাড়ে তুলমু। জইলদি উইঠা আয়।’

 মহেন্দ্র কথায় কথায় রেগে গিয়ে গাধা বলে। এটা মুদ্রাদোষ। শুনতে ভালোই লাগে।

 বর্ষার পরই পূজা চলে এল। চারদিকে ঢাকঢোলের আওয়াজ। মহেন্দ্র একদিন আমাকে বলল, ‘পূজার মেলায় যাইবি?’

 আমি বললাম, ‘আমরাতো মুসলমান। তোদের পূজার মেলায় গিয়ে আমি কী করব?’

 মহেন্দ্র বলল, ‘তুইতো আর পূজা করবার যাইবি না। তুই যাইবি মেলা দেখবার। আইজকা প্রতিমা বিসর্জন। বিসর্জন কহনো দেখছস? দেখলেই বুঝবি, তর ভালা লাগবে।’

 মহেন্দ্র একাই কথা বলছে। আমি মনোযোগ দিয়ে শুনছি। মহেন্দ্রর উৎসাহ দেখে নিজেরও উৎসাহ বেড়ে গেল। আমি কখনো প্রতিমা বিসর্জন দেখিনি। মামাতো ভাইদের কাছে গল্প শুনেছিলাম। তারা বেশ কয়েকবার দেখেছে। আর কোনো কথা না বাড়িয়ে সেদিন মহেন্দ্রর কথায় রাজি হয়ে গিয়েছিলাম। মহেন্দ্রর কোনো কথাই আমি কখনো না করিনি।

 মহেন্দ্রর সঙ্গে আমার আর একবার দেখা হয়েছিল। সেটাই তার সঙ্গে আমার শেষ দেখা। রাতে খেয়ে সবাই শুয়ে পড়েছে। আমি শুয়ে শুয়ে এক-আধটু গল্পের বই পড়তাম। প্রতিদিনকার মতো সেই রাতেও হারিকেনের আলোয় গোপাল ভাঁড় পড়ছিলাম। পড়ার মধ্যেই শুনতে পেলাম জানালার ধারে কে যেন নাম ধরে ডাকল। বই বন্ধ করে হারিকেন নিয়ে বের হলাম। মহেন্দ্র দাঁড়িয়ে আছে। কপাল দিয়ে ঘাম গড়িয়ে পড়ছে। বললাম, ‘এত রাতে তুই কোথা থেকে এলি?’

অলংকরণ: আরাফাত করিম

মহেন্দ্র এ বিষয়ে কিছুই বলল না। কাপড়ে মোড়ানো একটা পুঁটলি আমার হাতে দিয়ে বলল, ‘রতন, এইডা তর কাছে ভালা কইরা রাইখা দে। আমি পরে আইসা লইয়া যামু।’

 পুঁটলিটা বেশ ভারী। কৌতূহলবশত জিজ্ঞাসা করলাম, ‘কী আছেরে এর ভেতর? এত ভারী কেন?’

 মহেন্দ্র বলল, ‘পড়ে একসময় খুইলা দেহিস। মনে রাহিস, কেউ যেন না দেহে। সাবধানে লুকাইয়া রাহিস। অহন এক গেলাস পানি খাওয়া। ম্যালা তেয়াস পাইছে। উহঃ’

 মহেন্দ্র ডান হাতের আঙুল দিয়ে কপালের ঘাম মুছল। আমি এক দৌড়ে ঘরে গিয়ে এক গ্লাস পানি নিয়ে এলাম।

 মহেন্দ্র নিমেষেই গ্লাস খালি করে আমার হাতে দিতে দিতে বলল, ‘খুব তেয়াস পাইছিল। অহন ভালা লাগতাছে।’

 আমি বললাম, ‘আর এক গ্লাস এনে দেব?’

 আর লাগব না। মহেন্দ্র বেশ উৎসাহ নিয়ে বলল, ‘এইবার তরে নাপাই চণ্ডীর মেলাত লইয়া যামু। দেখবি কত মজা হয়। অহন যা, ঘুমাইয়া পর। কাইল-পরশু আমুনে।’

 ‘ভালো থাহিস’ বলে মহেন্দ্র চলে গেল। এরপর মহেন্দ্রর সঙ্গে আমার আর কখনোই দেখা হয়নি। কত খুঁজেছি, কিন্তু কোথাও আর পাইনি। মহেন্দ্র কোথায় থাকে, তা আমি জানতাম না। একবার এক ভাঙা দালানবাড়িতে নিয়ে গিয়ে বলেছিল এখানে ও থাকে। বিশ্বাস করিনি। একদম ভুতুড়ে বাড়ি, দালানের দেয়ালে পরগাছা জন্মেছে, আশপাশে জনমানুষ শূন্য জঙ্গলের মধ্যখানে। অবশ্য মহেন্দ্র স্বীকার করেছিল, এটা তাদের বাড়ি না। অন্য কোনো একসময় আমাকে ওর বাড়িতে নিয়ে যাবে। আমিও আর কৌতূহল প্রকাশ করিনি। মহেন্দ্রর মতো একটা ভালো বন্ধু পেয়েছি, এটাই যেন সবকিছু। মহেন্দ্রর ঠিকানা দিয়ে কী হবে।

 একে একে দিন গেল, মাস গেল, অবশেষে বছর শেষে বড় মামা আমাকে শহরের বোডিং স্কুলে ভর্তি করে দিলেন। মহেন্দ্রর পুঁটলিটাও কোথায় হারিয়ে গেছে, আর খুঁজে পাইনি। জীবন নদীর মতো। ক্রমাগত সেখানে নতুন করে পলি জমে নতুন চর জাগে। পুরোনো স্মৃতি একে একে ঢেকে যায়। আমিও নদীর মতো জীবনের একেকটা ধাপ পার করতে থাকলাম। আমার অতীত স্মৃতিগুলোর ওপর সংসার নামের ধূসর চর পড়তে লাগল। একসময় মহেন্দ্রর স্মৃতিও বিলীন হয়ে যেতে লাগল। মস্তিষ্কের কোথাও যখন মহেন্দ্রর কোনো স্মৃতি জমা নেই, ঠিক তখনই হাজির হলো যোগেন। একে একে অতীতের সব স্মৃতি মনে পড়তে লাগল। মনের অজান্তে ক্ষণিকের জন্য ফিরে গেলাম বিলের ধারে। সেদিনের রহস্যময় জ্যোৎস্না রাতে।

৩.  

যোগেন মহেন্দ্রর ছেলে। শরীরের গড়ন তেমন উন্নত নয়, হ্যাংলা-পাতলা। বাতাসে উড়ে যাওয়ার ভয় না থাকলেও শুকনায় পিছলে পড়ার ভয় থাকে, এ রকম দেহ। পরিচয় দেওয়া ছাড়া এ পর্যন্ত যোগেন কোনো কথা বলেনি। স্তম্ভের মতো সামনে দাঁড়িয়ে আছে। যোগেন একটা চিঠি নিয়ে এসেছে। সে নিয়ে এসেছে মহেন্দ্রর চিঠি। আমি এক বিস্ময় কাটিয়ে আরেক বিস্ময়ের অপেক্ষায় চিঠিখানা খুলে পড়া শুরু করলাম। উচ্চ স্বরে নয় মনে মনেই পড়তে লাগলাম,

 মহেন্দ্র লিখেছে,

 ‘বন্ধুভাজনেষু রতন,

 পত্রের শুরুতে তোমার এই অধম বন্ধুর আদাব এবং গগনাধিক পরিমাণ ভালোবাসা লইও। আমার প্রতি তোমার মনে কোনো রাগ রাখিও না বন্ধু। পত্রে বিস্তারিত কিছুই লিখিলাম না। বিস্তারিত কিছু জানতে ইচ্ছা করিলে যোগেনের নিকট হইতে জানিয়া লইও। সেই তোমার সকল প্রশ্নের জবাব দিবে। তোমার মনে আছে কি না, জানি না। তুমি মাঝেমধ্যে একটা ইচ্ছার কথা বলতে। শ্মশানে কেমনে মৃত দাহ করা হয়, তা তোমার দেখবার খুব শখ। দক্ষিণপাড়ার শ্মশানে অনেক কয়বার যেতেও চেয়েছিলে। আমি তোমাকে নিয়ে যাইনি। তুমি ভয় পাইবে বলে। তোমার এ ইচ্ছাখানা আমি পূরণ করতে পারি নাই বলিয়া আমার খুব কষ্ট হইত। সে রাতে বড় মামাকে কথা দিয়াছিলাম বলিয়া জীবিত অবস্থায় আর তোমার সামনে আসতে পারি নাই। তবে এখন সুযোগ হইয়াছে। তোমার ইচ্ছাও পূরণ হইবে, সঙ্গে আমার কষ্টও দূর হইবে। তুমি অতিসত্বর যোগেনের সহিত চলিয়া আসিবে। তুমি না আসিলে, আমার চিতায় অগ্নিসংযোগ হইবে না।’

এতটুকু শেষ করে চিঠি ভাঁজ করে ফেললাম। আর পড়তে পারলাম না। একসময় মহেন্দ্র...মহেন্দ্র...বলে হাউমাউ করে কেঁদে উঠলাম।

 **দূর পরবাসে লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। মেইল অ্যাড্রেস [email protected]