আমরা কবে মন খুলে হাসতে পারব
বাংলাদেশের সঙ্গে দক্ষিণ আফ্রিকার সময়ের ব্যবধান চার ঘণ্টা। এখানে সন্ধ্যা ৬টা হলে দেশে রাত ১০টা বেজে যায়। সপ্তাহের শুরুতে অফিসের কাজ বেশি থাকে বলে বের হতে সাতটা বা তারও পরে বের হতে হয়। দেশে রাত ১১টায় খুব কম সংখ্যক মানুষই জেগে থাকেন। এখানে পর্যটক ছাড়া বাকিরা ছয়টার মধ্যে বাড়ির পথ ধরে। সূর্যের সঙ্গে সঙ্গে তারাও ঘরে ঢুকে যায়। হলিডে বা সাপ্তাহিক ছুটি রোববারের কথা ভিন্ন।
আমরা যাঁরা পরিবারপরিজন রেখে প্রবাসে কর্ম করছি, তাঁরা খুব কম সময় পরিবারের সঙ্গে ভার্চ্যুয়ালি সময় ব্যয় করতে পারি। যাঁকে অনেক আশা করি, তাঁকে বিভিন্ন কারণে কাছে পাই না। আব্বার কথা জিজ্ঞাসা করলে অনেক সময় বাজারে বা মসজিদে থাকেন অথবা অন্য কোনো কাজে ব্যস্ত। বাচ্চারা ঘুমে বা খেলতেছে। কাজের ব্যস্ততা বা বিভিন্ন কারণে যাঁদের পরিবারপরিজনের সঙ্গে দূরত্ব তৈরি হয়, তাঁদের মানুষের সংখ্যা একেবারে ছোট হয়ে আসে। দক্ষিণ আফ্রিকার কেপটাউন যেমন বিশ্বের প্রত্যাশিত শহরগুলোর একটি, তেমনি এ শহরের বৈরী আবহাওয়ায় বিচিত্র গরমেও বৃষ্টি হয় না। এখন শীত মৌসুমে মাসব্যাপী বৃষ্টি হচ্ছে। তীব্র শীতে জনজীবন বিপর্যস্ত। মানুষজন একেবারে দরকার ছাড়া ঘর থেকে বের হচ্ছে না। ভারী বৃষ্টি, ঠান্ডা বাতাসে ঘর গরম রাখতে ঘরে ঘরে হিটার ব্যবহার চলছে। বাজারে, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে লোকজনের চলাচল হাতে গোনা। এমন মাসব্যাপী বৃষ্টি কার ভালো লাগে। মাঝেমধ্যে সূর্য দেখা দিলেও তা দীর্ঘ হচ্ছে না। কেপটাউনের চার পাশে কত সৈকত, সময় করে যে একটু ঘুরে বুকটা ভরে শ্বাস নেব, সে সুযোগ নেই। বৈরী আবহাওয়ার ফলে জীবনটা বাসা–অফিসের মধ্যে সীমাবদ্ধ হয়ে গেছে।
পরিবার সঙ্গে নেই। একজন প্রবাসী জানেন, এটা তাঁর জীবনে কত বড় শাস্তি। সবাই আছে কিন্তু তাদের ছুঁয়ে দেখতে পারছেন না। তাঁরা সহযোগিতা পাচ্ছেন না। স্ত্রী তাঁর দরকারে পাচ্ছেন না। সন্তান তার বাবাকে পাচ্ছে না। মা–বাবা তাঁদের সন্তানকে পাচ্ছেন না শেষ বয়সে এসে। এসবের মধ্যেও কত কিছু থাকে প্রবাসজীবনে। এত সব ভালো–মন্দ মানিয়ে সামনে এগিয়ে যাচ্ছেন সবাই।
কিন্তু দেশ কি এগিয়ে যাচ্ছে। আমরা বিশ্বের বিভিন্ন দেশে থাকি, কিন্তু নজর পড়ে থাকে বাংলাদেশে।
রাজনীতি, ক্রীড়া, অর্থনীতি, বিনোদন—এসব খবর যখন সামাজিক প্ল্যাটফর্মে ভেসে বেড়ায়, তা কি মানুষকে ছুঁয়ে যায় না। ভালো খবর মানুষকে মানসিক শান্তি দেয়, মন্দ খবর মানসিক যন্ত্রণা বাড়ায়।
এই যে কয় দিন পরপর একেকটা রাজনৈতিক ঘটনা ঘটছে দেশে। হানাহানি, মারামারি, গুলি চলছে।
এবার নতুন যোগ হলো হেলিকপ্টারে করে আকাশ থেকে বাড়ির ছাদে গুলি করা। কেউ কারও কথা শুনছে না। দেশের কথা ভাবছে না। যত ক্ষত হোক, মাড়িয়ে যেতেই হবে।
কোটা আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে উদ্ভূত পরিস্থিতে ইন্টারনেট বন্ধ হওয়ার কারণে হঠাৎ পৃথিবী থেকে দেশ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। ওই কয়েক দিন দেশে কী হয়েছে, কেউ জানতে পারেননি। ইন্টারনেট বন্ধ হওয়ায় দেশের গণমাধ্যমে আপডেট তথ্য নেই। বিদেশি গণমাধ্যমের দিকে ঘণ্টায় ঘণ্টায় নজর। বাংলাদেশের পরিস্থিতি বিশ্ব মিডিয়ার হেডলাইন। দিন যায় রাত যায় প্রবাসীদের পরিবারপরিজন নিয়ে উদ্বেগ বাড়ে।
পরিস্থিতি মোতাবেক পরামর্শ দিবেন তারও সুযোগ নেই। একি ভয়াবহ অবস্থা। হায় রে দেশ, হায় রে রাজনীতি। আমরা কবে মন খুলে হাসতে পারব।