প্রবাসে আনন্দ-বেদনার গল্প

প্রবাসে আনন্দ–বেদনাময় অনেক গল্প আছে, তবে যে কষ্টটা আমার হৃদয়টা চিড়ে দিয়েছে, তা হলো আমার বাবার মৃত্যুর সংবাদ।

বিয়ের পাঁচ বছর পর আমার কোল আলো করে আমার মেয়ে আসে। মেয়ের জন্মের ১০ মাস পর মেয়েকে সঙ্গে নিয়ে স্বামীর কাছে প্রবাসে পাড়ি জমাই। আমার স্বামী সূর্যোদয়ের দেশ জাপানের ব্যস্ততম নগরী টোকিওতে থাকে।

আমার ভিসা হয়েছে শুনে সবাই খুব খুশি। আমি তখন বাবার বাড়িতে কুমিল্লায় ছিলাম। ভিসা পেয়ে টিকিট কনফার্ম এবং কেনাকাটা শেষ করি। যেদিন বাবার বাড়ি থেকে বিদায় নিয়ে শ্বশুরবাড়িতে যাব, এর আগের দিন রাতে আমার সব আত্মীয়স্বজন আমাকে দেখতে আসে। আমরা সবাই বসে গল্প করছিলাম। হঠাৎ আমার বাবা বলেন, ‘আমার মেয়ে প্রবাসে চলে গেলে আমি কেমন করে থাকব?’ বাবার সেই কথাটা সত্যি প্রমাণিত হয়েছে। আমি প্রবাসে আসার কিছুদিন পর আমার বাবা না ফেরার দেশে চলে যান। আজও বাবার সেদিনের কথাটা মনে পড়লে আমার বুকটা ফেটে চৌচির হয়ে যায়। বাবার মৃত্যুর দুই দিন পর আমাকে জানানো হয়। আমি এই শোক সইতে পারব না বলে কেউ আমাকে জানায়নি। বাবাকে শেষ দেখাটাও দেখতে পাইনি।

মানুষ মরণশীল, সবাইকে একদিন সৃষ্টিকর্তার ডাকে পরপারে যেতে হবে। আল্লাহ যা করেন, মানুষের মঙ্গলের জন্যই করেন। আমি দেশে থাকতে যদি আমার বাবা মারা যেতেন, আমাকে কেউ সামলাতে পারত না। আমি বোধ হয় স্টোক করে বাবার সঙ্গেই চলে যেতাম। আমার মনে আছে, যেদিন আমার স্বামী বাবার মৃত্যুর সংবাদ দেয়, তার বুকে মুখটি গুঁজে আমি অনেক চিৎকার করে কেঁদেছি। নিজেকে অনেক হতভাগ্য, অসহায় লাগছিল। তবে আমার স্বামীর সান্ত্বনামূলক কিছু কথা আমার মনে দাগ কেটেছে। সেদিনের পর থেকে তার প্রতি আমার আস্থা আরও বেড়ে গেছে। আমার স্বামীর কথাগুলো ওই মুহূর্তে আমার কষ্ট কিছুটা কমালেও পিতা হারানোর শোকে মনের গভীরে আগুন জ্বলতে থাকে। বারবার বাবার স্মৃতিগুলো চোখের সামনে ভেসে উঠত। নামাজ পড়ে আল্লাহর কাছে দোয়া করতাম।

সব সময় আমার মন খারাপ থাকত। তখন আমার দেবর বলে, ‘ভাবি, আপনি এভাবে থাকলে তো অসুস্থ হয়ে যাবেন।’ সে যে কোম্পানিতে জব করত, সেখানে আমাকে নিয়ে গেল। আর বলল, ‘আপনি চাইলে এখানে জয়েন করতে পারেন। বাইরের পরিবেশে আপনার অনেক ভালো লাগবে।’ আমি তাকে বলি, ‘তোমার ভাইয়ের সঙ্গে আলাপ করে জানাব।’ তারপর আমার স্বামীকে জানাই। প্রথমে সে রাজি ছিল না।

কারণ, আমার মেয়ে ছোট ছিল। পরে আমার মেয়েকে ডে–কেয়ারে দিয়ে আমি চাকরিতে জয়েন করি।

আমি যে কোম্পানিতে জব করি, সেখানে আরও অনেক বাঙালি কাজ করত। আমাদের বস ছিলেন জাপানি ভদ্র মহিলা। তিনি আমাকে খুব আদর করতেন। তাঁর দুই ছেলে, কোনো মেয়ে ছিল না বলে আমাকে মেয়ের মতো আদর করতেন। আমি জাপানি ভাষা ওনার কাছ থেকে শিখি। ওনাকে আমার ভীষণ ভালো লাগত, মনে হতো, প্রবাসে আমি মা পেয়েছি।

আমি সব সময় আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করতাম। আল্লাহ যেন আমাকে একটা পুত্রসন্তান দান করেন। অনেক বছর পর আমার দ্বিতীয় সন্তান কনসিভ হয়। আলহামদুলিল্লাহ, আল্লাহর অশেষ মেহেরবানি, অনেক দেরিতে হলেও আল্লাহ তায়ালা আমার মনের আশা পূরণ করেছেন।

আমার ছেলে আমার বাবার চেহারা পেয়েছে। আমার ছেলের মধ্যে আমি আমার বাবাকে খুঁজে পাই।