অস্ট্রেলিয়ার গল্প: ২—অস্ট্রেলিয়ার বর্ণবাদ আর বঙ্গদেশীয় বর্ণবাদ
অনেকে আমাকে সওয়াল করেন, অস্ট্রেলিয়ায় বর্ণবাদ কেমন?
এ মোটেও অযৌক্তিক প্রশ্ন নয়।
যেহেতু আদিবাসী, শরণার্থী আর এশিয়ানদের হেনস্তা করার সুদীর্ঘ ইতিহাস আছে অস্ট্রেলিয়ার। এখনো টুকটাক পেপার পত্রিকায় দু–চারটে বর্ণবাদী ঘটনা চলে আসে। এ সওয়াল আসতেই পারে!
অস্ট্রেলিয়ার গোল্ড কোস্টে থাকলুম তা–ও প্রায় ১০ বছর হলো।
আমার জওয়াবটা তাই ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা, ইতিহাস আর কমনসেন্স মিলিয়েই দিই।
অস্ট্রেলিয়ার বর্ণবাদের ইতিহাস খুব সুবিধের নয়। সেই ১৭৭০ সালে জেমস কুকের নৌবহর যখন অস্ট্রেলিয়ার তীরে ভিড়ল, রাজামশাইয়ের সুস্পষ্ট হুকুম ছিল, এখানকার আদিবাসীদের সঙ্গে ভালো ব্যবহার করার। আর্থার ফিলিপ যখন ১৭৮৭–তে দণ্ডপ্রাপ্ত কারাবন্দী নিয়ে উপনিবেশ গড়ার উদ্দেশ্যে অস্ট্রেলিয়ার তীরে নোঙর ফেললেন, সেই হুকুমের নড়চড় হয়নি।
রাজা জর্জ-৩ তখন ব্রিটিশ সিংহাসনে। যদিও আমেরিকার মিডিয়া ওনাকে অত্যাচারী, শোষক, নিষ্ঠুর আর যুদ্ধবাজ হিসেবে প্রচার করত; ন্যায় নীতিবান এ রাজামশাইয়ের আসলে ছিল দয়ার শরীর।
রাজা কি কখনো অন্যায় অনাচার অত্যাচারের অন্যায্য হুকুম দিতে পারেন? কক্ষনো নয়! কিন্তু ওনার পাইক পেয়াদা সেনাপতিদের সব সময় দয়ামায়ায় পোষায় না। হুকুম রাজা মশাই দেন কিন্তু আসল কম্মো তো পাইক পেয়াদারই করতে হয়। ব্রিটিশ রাজদণ্ড সমুন্নত রাখতে এই পাইক পেয়াদা সেনাপতিদের কত অত্যাচার, অনাচার, নির্যাতন করতে হয় সাম্রাজ্যের প্রজাদের ওপর। রাজামশাই কি তার খোঁজ রাখতে পারেন সব সময়?
রাজা বলেন ধরে আনতে। সে স্বেচ্ছায় কি কেউ আসে? সেপাইকে তাই আনতে হয় বেঁধে!
অস্ট্রেলিয়ার আদিবাসীরা স্বভাবতই নিজ ভূমে বহিরাগত দেখে খোশ হয়নি। তাই ওরা ব্রিটিশদের স্বাগত জানিয়েছিল বর্শা–বল্লম ছুড়ে। আর ব্রিটিশরা উত্তর দিয়েছে গাদা বন্দুকে। সেই করে শুরু থেকেই ব্রিটিশ আর আদিবাসীদের গোল বেধে গেল।
মাস যায়, বছর যায়। অস্ট্রেলিয়ায় ব্রিটিশদের কলোনি দিনে দিনে সমৃদ্ধ হয় আর আদিবাসীদের গায়ের পর গা উজাড় হয়। ব্রিটিশদের সঙ্গে মারামারিতে আদিবাসী বিনাশ হয়। কিন্তু তারচেয়ে বেশি মরে কলেরায়, গুটিবসন্তে আর স্কার্ভি রোগে। এই সব রোগবালাই ছিল না এই মুল্লুকে। ব্রিটিশরা আমদানি করেছিল ইউরোপ থেকে। ১৭৮৭ আনুমানিক ১০ লাখ আদিবাসী সাফা হতে হতে মোটে ৯৩ হাজার বাকি রইল ১৯০০ সাল নাগাদ।
বর্ণবাদের শুরু সেই প্রথম থেকেই।
এর মধ্যে সবচেয়ে মর্মান্তিক বর্ণবাদ ছিল খুব সম্ভবত ‘চুরি যাওয়া প্রজন্ম’ মানে stolen generation.
মূলত আদিবাসী সংকর বর্ণের শিশুদের রক্ষা করার নামে এক আইন পাস হয়েছিল উনিশ শতকের গোড়ায়। দু–চারটে বিছিন্ন ঘটনা বিচার–বিশ্লেষণ করে জ্ঞানী–গুণী আইনপ্রণেতারা এক মহৎ সিদ্ধান্তে উপনীত হলেন। বললেন, আদিবাসীরা নিজেদের সন্তানদের যত্ন নিতে জানে না। এই জন্য নিষ্পাপ শিশুরা কষ্ট পায়, অশিক্ষা কুশিক্ষা পায়, সুচিকিৎসা পায় না, মাঝেমধ্যে ফুট করে মরেও যায়। তাই আদিবাসীদের বৃহত্তর স্বার্থেই প্রণীত হলো এক নতুন আইন। সে হলো জন্মের পরপরই আদিবাসী শিশুদের কোনো সাদা চামড়ার কাছে লালন পালন করতে দেওয়া।
আদিবাসী মায়েদের হাসিমুখেই তাদের সন্তানদের সরকার বাহাদুরের হাতে তুলে দেওয়া উচিত। সে নাহলে এই বাচ্চাদের মায়ের কোল থেকে ছিনিয়ে নেওয়াও আইনসিদ্ধ হবে! বৃহত্তর স্বার্থ বলে কথা! বিজ্ঞ পার্লামেন্ট সিদ্ধান্ত দিলেন, কচিকাঁচা আদিবাসী সংকর শিশুদের জীবন বাঁচানোর এই একমাত্র তরিকা!
নিজের ইচ্ছায় কি কেউ নিজ সন্তানকে সরকারের হতে তুলে দেয়? তাই জোর করে ছিনিয়ে নেওয়া শুরু হলো মায়ের কোল থেকে। তারপর এই শিশুদের দেওয়া হতো কোনো এক শ্বেতবর্ণের ঘরে। নয়তো কোনো সরকারি আশ্রয়ে।
আদিবাসীদের কুশিক্ষা অশিক্ষা অনাচার থেকে ভবিষ্যৎ অস্ট্রেলিয়াকে বাঁচাতে এ ছিল সর্বোত্তম ব্যবস্থা। এদের মানুষের মতো মানুষ করার মহান দায়িত্ব নিয়ে সরকার বাহাদুর এদের ধর্ম শিক্ষা দিতেন। শিশুকাল হতেই ছেলেদের কৃষিকাজ আর মেয়েদের ঘরকন্নার কাজ শেখানো হতো। বয়স ১৫ কি ১৬ হতেই বেঁচে থাকলে এদের স্থান হতো কৃষি খামারে। নয়তো কোনো সাদা চামড়ার ঘরে চাকরানি হিসেবে। উনিশ শতকের শুরু থেকে এই অপকর্ম চলেছে। এমনকি ১৯৭০ সাল পর্যন্ত বলবৎ ছিল এই সাদা কানুন (কালা কানুন নহে)।
শুধু সংকর নয়, এই শিশু ছিনতাই চলেছে কালো বাদামি সব বর্ণের। নির্বিচার। মায়ের কোল থেকে জন্মের পরপরই সন্তান নিয়ে নেওয়া! এমন অনাচারও চলেছে ব্রিটিশ রাজের রাজত্বে! সঠিক সংখ্যা জানা যায় না, খুব সম্ভবত এক লাখের মতো নিষ্পাপ মাসুম শিশু এই ছিনতাইয়ের শিকার হয়েছিল।
সন্তানহারা আদিবাসী মায়ের আর্তনাদে কেউ কর্ণপাত করেনি। আদিবাসীর বাবার কান্না কেউ দেখেনি, দেখলেও কারও টনক নড়েনি সে দেখে। বৃহত্তর স্বার্থ বলে কথা।
কিন্তু টনক নড়ল সেই ছিনতাইকৃত শিশুদের শোচনীয় অবস্থা দেখে। এদের অনেকে নির্যাতিত হয়েছিল, অনেকে হয়েছিল ধর্ষিত। মোটামুটি সবার দেখা দিল বিষণ্নতাসহ নানাবিধ মানসিক রোগ। এমনকি আত্মহত্যার ঘটনা ঘটত অহরহ।
সারা অস্ট্রেলিয়াকে ধৌতকরণের এমন মহান পরিকল্পনা বোধ হয় মাঠেই মারা গেল! কিন্তু এত গোলমালের পরেও হাল ছেড়ে দেয়নি সরকার। নানাবিধ পরীক্ষা–নিরীক্ষা করেই যাচ্ছিল এই মহৎ উদ্দেশ্য লক্ষ্য করে।
অবশেষে ১৯৭০–এ এসে সরকারের বোধোদয় হলো, তা–ও আন্তর্জাতিক চাপে পড়ে। এর কাছাকাছি সময়ে আদিবাসীরা ভোটের অধিকারও পেল।
সত্তর দশকের আগে এদের মোটামুটি পশুসম্পদ হিসেবে গণ্য করা হতো। তাই আদমশুমারিতেও গোনা হতো না আদিবাসীদের। মাত্র সত্তরে এসে মানুষ হিসেবে গণ্য করা শুরু হলো। মানে আজ থেকে মাত্র পঞ্চাশ বছর আগে!
মোটে বর্ণবাদ? এত মানবিকতার সওয়াল!
অস্ট্রেলিয়ার আরেক দিগ্বিজয়ী আইন ছিল ‘সাদা অস্ট্রেলিয়া’ (White Australia) আইন।
সাদা চামড়ারা প্রভু, উত্তম ও মহান। কালো আর বাদামিরা দাসানুদাস, অধম। তাই কঠিন কঠোর নিষ্ঠুর আইন করা হলো। ইউরোপিয়ান সাদা চামড়া নাহলে অস্ট্রেলিয়ার ত্রিসীমানায় ঢুকতে পারবে না কেউ। সেই সাদা (নাকি কালো) আইনও বলবৎ ছিল মোটামুটি ১৯৭০ দশক অব্দি।
ঘটনার শুরু সেই ১৮৫০ দশকে। তখন অস্ট্রেলিয়ায় কাজের অভাব নেই, চারদিকে বরং শ্রমিকের ঘাটতি। তাই দলে দলে চায়নিজ আমদানি শুরু হলো। এরা সস্তায় কাজ করে, অখাদ্য কুখাদ্য যা–ই দেওয়া হয় গোগ্রাসে গিলে খায়। দুবেলা পেট ভরে খাওয়া ছাড়া আর কোনো চাহিদা নেই। কাজও করে বুনো মহিষের মতো। দিনে ১৮ ঘণ্টা কাজ করেও কোনো অভিযোগ নেই। এমন শ্রমিকই তো দরকার।
পিল পিল করে পিঁপড়ার মতো আমদানি হলো হলদে রঙের চায়নিজ। এই সস্তা চায়নিজদের দৌরাত্ম্যে খোদ সাদা ইউরোপিয়ানদের বেগতিক অবস্থা। কোথাও কাজ পাচ্ছিল না। এরা এতো সস্তায় কাজ করবে না। ছুটি লাগবে দুই দিন। দুই বেলা পেটে ভাত পড়লেই হবে না, লাগবে চিত্ত বিনোদন। এমন ন্যাকামি কোনো মালিকের ভালো লাগে?
‘দূর পরবাস’-এ জীবনের গল্প, নানা আয়োজনের খবর, ভিডিও, ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]
আর কোনো উপায় না পেয়ে সাদা চামড়ার জনগোষ্ঠী মিলে তাই শুরু করল হোয়াইট অস্ট্রেলিয়া পলিসি। সাদা চামড়ার না হলে অস্ট্রেলিয়ায় ঢুকতেই বারণ।
আজকের যে অস্ট্রেলিয়া, মানে ফেডারেশন অব অস্ট্রেলিয়া, এর জন্ম ১৯০১ সালে। জন্মের পরপরই পার্লামেন্টে পাস হলো এই হোয়াইট অস্ট্রেলিয়া পলিসি। কিন্তু বাদ সাধল খোদ ব্রিটিশরাজ। তখন চারদিকে শুরু হয়েছে মানবতা আর সম–অধিকারের জয়গান। চক্ষু লজ্জার জন্য হলেও এত বড় ব্রিটিশ সাম্রাজ্যে সমতার আইন দরকার। নাহলে ভারতবর্ষ চলবে কী করে? এশিয়ানদের নাম ধরে আইন হলে শক্তিশালী জাপানের সম্রাটও ছাড় দেবেন না।
অস্ট্রেলিয়ার পার্লামেন্ট তাই বের করল নতুন কুবুদ্ধি। আইন বদলে নতুন ধারা যোগ করল, অস্ট্রেলিয়ায় সব্বাই ঢুকতে পারবে কিন্তু তার আগে দিতে হবে ভাষার পরীক্ষা (Language Test)। এমনভাবে এই পরীক্ষা সাজানো হলো, যাতে ইউরোপিয়ান বাদে কোনো কাকপক্ষীও ঢুকতে না পারে।
এই তো বেড়ে বুদ্ধি।
সাপও মরল আর লাঠিও ভাঙল না।
সাদা অস্ট্রেলিয়ার সেই ভাষা পরীক্ষাই হলো আজকের আইইএলটিএসের পিতামহ।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরেও অনেক দিন টিকে ছিল সেই সাদা অস্ট্রেলিয়া পলিসি। কিন্তু অবস্থা তখন ঠগ বাছতে গা উজাড়। সাদা সাদা করে মুখে ফেনা তুলে অস্ট্রেলিয়ার জনসংখ্যা কমতির দিকে। আমেরিকা ব্রিটিশরাজ দিল ধমক, ‘Populate or Perish!’ অগত্যা আর কী করা? আস্তে আস্তে আগল খোলা শুরু হলো। আবার আমদানি শুরু হলো চায়নিজ, জাপানি, ভারতীয়, মালয়, আফ্রিকান।
শুরু হলো মাল্টি কালচারের ধোয়া।
সাদা অস্ট্রেলিয়া সেই সত্তরে বিলুপ্ত হলেও সাদা মানুষের মনে আরও কিছুদিন শ্রেষ্ঠত্ব ভাবটা বজায় ছিল। মোটামুটি আশির দশক পর্যন্ত। পথেঘাটে এশিয়ান দেখলে দু–চারটে কটু বাক্য, সে আকছার হতো। এখন দিন বদলেছে। কিন্তু তা–ও বিচ্ছিন্ন দু–চারটে ঘটনা পেপার পত্রিকায় আসে এখনো। সরকার বাহাদুর কিন্তু এখন আর এসব প্রশ্রয় দেন না। এখন হয়েছে মাল্টি কালচারের ফ্যাশন। শুধু ফ্যাশন নয়। আস্তে আস্তে আমজনতাও বুঝে যাচ্ছে চায়নিজ ইন্ডিয়ান ভাই ভাই, এদের ছাড়া গতি নেই। সবাই বুঝছে দুনিয়া বদলে গেছে, মাল্টি কালচার ছাড়া গতি নেই।
তবে পুরোপুরি বুঝে উঠতে আরও সময় লাগবে। শত শত বছরের বর্ণবাদের ঐতিহ্য, একটু সময় তো দিতেই হবে।
ইতিহাস তো বললুম, এখন আমার নিজের গল্প বলি।
গোল্ড কোস্টে আমার একটা বড় ইয়ার দোস্ত গ্রুপ আছে। এরা ভারতীয় বড় বড় ডাক্তার কোবরেজ আর হাসপাতাল ক্লিনিকের মালিক। এরা একেকটা টাকার কুমির। আমি রসিকতা করে এদের ডাকি কোবরেজ মাফিয়া। প্রত্যেকেরই নদীর সামনে প্রাসাদের মতো বাড়ি, ঘরের সামনে মিলিয়ন মিলিয়ন ডলারের বিলাসবহুল জলযান আর দামি দামি গাড়ি। এদের ফি হপ্তায় চলে পার্টি আর পার্টি। যেকোনো ছুতোয় মদ আর মদিরার উৎসব। এদের হাসপাতালে ক্লিনিকে সাদাকালো বাদামি সবাই মিলেমিশে কাজ করে। দু–চারজন আবার টুকটাক হিন্দি বাংলাও শিখে নিয়েছে।
এদের ভারতীয় বা বাঙালি আড্ডায় দেখি জম্পেশ গপ্পো হচ্ছে মাতৃভাষায়। এর মধ্যে দু–চারটে ইউরোপিয়ান কিছুই না বুঝে হু হা করে যাচ্ছে হাসিমুখে। আমি ভাবি এ–ও তো বর্ণবাদ! ইংরেজিতে কথা কইলে ক্ষতিটা কী?
আমার সুইডিশ সহকর্মীর গল্প বলি। তার থাইল্যান্ডে পোস্টিং। হিন্দি ভাষার অত্যাচারে অবশেষে পুরোদস্তুর কোর্স করে হিন্দি শিখল। এখন মোটামুটি কাজ চালানোর হিন্দি বলে ফুটফাট করে। বাধ্য হয়েই। ও জোক করে বলে আমার টিমে আমি হলুম হোয়াইট মাইনরিটি। হিন্দি শিখে যদি এ যাত্রা টিকে যাই!
এ–ও তো বর্ণবাদ বৈকি!
ভারতবর্ষে মনে হয় জাতপাত বর্ণবাদের উপদ্রব সবচেয়ে বেশি। এখন তো আবার ধর্মাবতার মোদিজির যুগ।
অনেক আগে মালয় দেশে থাকতুম। চাইলুম একটা বাড়ি ভাড়া নিতে। এক এলাকা পছন্দ হলো।
এজেন্ট বলে, ‘তোমার জাতীয়তা কী?’
আমি তো আকাশ থেকে পড়লুম, ‘বাড়ি ভাড়ার সঙ্গে জাতীয়তার সম্পর্কটা কী?’ বলে, ‘বাড়ির মালিক ভারতীয়দের ভাড়া দেবে না। তার ওপরে এ মালয় এলাকা। এদিকে ভারতীয় বা চায়নিজরা থাকে না।’
ওকে বললুম, ‘এ কারবার অস্ট্রেলিয়ায় হলে তোমার বাড়ির মালিক জেল খাটত সাত বছর। আর তুমি যে আমার জাতীয়তা জানতে চাইলে, সে জন্য তুমি খাটতে দুই বছর!’
মালয় দেশে বর্ণবাদ মোটামুটি পাকাপোক্ত। সরকার বাহাদুর নিজেই আইনকানুন করে উৎসাহ দেন তাতে। মালয়রা মানে ভূমিপুত্ররা ধরাছোঁয়ার বাইরে, ফেরেশতা। আর বঙ্গদেশি বা ভারতীয় শ্রমিক হলো নমঃশূদ্র। মাঝামাঝি জাতের হলো মালয় চায়নিজ আর তামিলরা—এরা ক্ষত্রিয়, বৈশ্য।
এ নিয়ম মেনে এ দেশে থাকলে থাকুন, নয়তো পত্রপাঠ বিদেয় হোন!
দুবাইয়ে ছিলুম আপিসের বড় কর্তা। মধ্যপ্রাচ্য অঞ্চলের ডিরেক্টর।
আপিসের মধ্যে কেউ উঁচু নিচু সাদা কালো ভেদ করত না। কিন্তু বাইরে বেরোলে ভয়ে ভয়ে থাকতুম বাদামি চামড়া নিয়ে। কে কখন কী বলে ফেলে। ইজ্জতের সাওয়াল। সাদা চামড়া অধস্তন সহকর্মী নিয়ে রেস্টুরেন্টে গেলুম। ওয়েটার কথা কইবে সাদা চামড়ার সঙ্গে। অর্ডার নেবে আর বিল ধরিয়ে দেবে সাদা চামড়ার হাতে। এ কি চর্মজনিত আপদ।
কোনো কারণে আইন ভেঙেছেন? কালো বাদামি হলে সরাসরি গলাধাক্কা মানে deportation. সাদা হলে দুটি সতর্কীকরণ কথা, ভাগ্য খারাপ হলে কয়েক শ দিরহাম জরিমানা। অপরাধ একই কিন্তু চামড়া আলাদা। ওখানে অস্ট্রেলিয়ার মতো আইনের সাহায্য পাব, সে আশা কম।
কপালের ফেরে সৌদি যেতে হলে ‘ফেয়ার অ্যান্ড লাভলি’ টাইপের স্নো ক্রিম মেখে সাদা হয়ে যাওয়াই সবচেয়ে নিরাপদ। বাদামি মানেই মিসকিন। নেহাত স্যুটটাই পরে সাহেব সেজে গেলে ওরা সামান্য একটু ইজ্জত করে। তা–ও মালুম করে, এ কাক, পুচ্ছ লাগিয়ে ময়ূর সেজেছে।
সেখানে প্রথমবার গিয়েছিলুম একখানা মিটিং করতে। কাস্টমারের ডিরেক্টর, উনি ওখানকার লোকাল। উনি তো আমার সঙ্গে কথাই বলতে চাননি প্রথম। আমি বাদামি চামড়ার বলে! কোনো রাখঢাক নেই, সরাসরি বলেই দিলেন মুখের ওপর। অস্ট্রেলিয়ায় হলে ভদ্রলোক নির্ঘাত সাত বছর জেলের ঘানি টানতেন।
তারপর ভাবুন, সারা মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে বাদামি চামড়ার শ্রমিকদের ঠকানো। কথায় কথায় বাঙাল বলে গালি দেওয়া। একটু ভুলচুক হলে বেতন কেটে নেওয়া। একে কি বর্ণবাদ বলা যায় না?
বর্ণবাদ মধ্যপ্রাচ্যের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ঢুকে আছে। আমেরিকান আর ইউরোপিয়ান উঁচু জাত আর উপমহাদেশীয় আর আফ্রিকানরা নিচু জাত।
আমার নিজের বঙ্গদেশে কি বর্ণবাদ কম?
সাদা চামড়া দেখলে এখনো বঙ্গদেশির মনে ভক্তি আসে। ২০০ বছর ব্রিটিশ প্রভুত্বের ছায়া দিলে গেঁথে আছে। সাদা চামড়া পেলে নিজেরাই অবহেলা করি স্বদেশিদের। একি বর্ণবাদ নাকি অন্য কিছু? ঘরের ড্রাইভার আর কাজের বুয়াকে নিয়ে একসঙ্গে ডিনারের টেবিলে বসে ভাত খায় কজন বাঙালি? মনে হয় হাতে গোনা। অস্ট্রেলিয়ায় এ রকম আচরণ করলে এখানকার ড্রাইভার আর কাজের বুয়া আপনাকে বয়কট করবে বাকি জীবনের জন্য।
অস্ট্রেলিয়ার সরকার বাহাদুর তা–ও ক্ষমা চেয়েছেন পূর্বপুরুষের অপকর্মের জন্য।
চেষ্টা করছেন আগে বঞ্চিত আদিবাসীদের বেশি সুযোগ–সুবিধা দিতে। অশিক্ষিত আমজনতা তা–ও দু–চারটে বর্ণবাদী আচরণ করে কদাচিৎ। কঠিন আইনকানুনের জন্য সে হালে পানি পায় না।
আমার বাড়ির পূর্ব পশ্চিম দক্ষিণে সাদা কালো হলদে বাদামি সব মিলেমিশেই থাকে। কোনো ভেদ পাইনে। উত্তরের ঘরে থাকে রে আর তার বউ। রে চার পুরুষ ধরে অস্ট্রেলিয়ান। ট্রাক ড্রাইভার। বউ ফিলিপিনো, পেশায় আইনজীবী। আমাদের ঘরের এত গাছপালা সামলাতে পারিনে, ওরা এসে মাঝেমধ্যে সাহায্য করে। ডালপালা কেটে দেয়। আর কোনো দিন আমার বেগম তেহারি বা পোলাও রান্না করবে, সে আশায় বসে থাকে। বাঙাল খাবারের জন্য ছোক ছোক করে। রমজান আসতে না আসতেই এদের ঈদ। জানে ইফতারিতে পেঁয়াজু, বুটের ডাল আর ভালো ভালো বাঙাল খাবার মিলবে। সারা বছর তাই জানতে চায়, রমজান আসবে কবে! এখন তো গুগল করেই জেনে যায় আর শাবান মাসেই বলে ‘রমজান মোবারক।’ মানে লোভনীয় সব খাবার আসছে শিগগির। চলবে..
আগামীকাল পড়ুন: অস্ট্রেলিয়ার গল্প: ৩—বঙ্গজ অস্ট্রেলিয়ানদের গপ্প
পুব দিকে আছে আকু আর তার বউ কাই। আকুর বাবা এসেছিল নরওয়ে থেকে, আর বউ কাই জাপানি। এদের ঘরে পার্টি দিলে ধুন্ধুমার লেগে যায়। আকু কাম কাজ কিছু করে না তেমন, তাই সর্ব কাজের কাজি। কোনো কাজে ডাকলে এক পায়ে খাড়া। এক বাড়ি পরে মন্ডল পরিবার। দিলখোলা ক্যালকেশিয়ান বাঙালি পরিবার, ভাইয়ের বরাবর। পশ্চিমে রজার আর নাতালিয়া। সাদা আর আদিবাসীর মিশ্রণ। স্ত্রী স্কুলের প্রিন্সিপাল আর স্বামী ছুতোর মিস্ত্রি। দুই ঘর পরে এক আফ্রিকান পরিবার।
সবাই মিলেমিশে থাকি। ধর্ম, বর্ণ, গোত্র, পেশা—এ কোনো বিচার্য নয়।
সবাই ভালোবাসে বেগমের রান্না করা বাঙাল খাবার, বিশেষ করে তেহারি আর বিরিয়ানি। তাই গিন্নি ভালো কিছু রান্না করলে এ–বাড়ি ও–বাড়ি বিলান। এ প্রসাদ পেলে সব্বাই চেটেপুটে খায়। মাল্টি কালচারাল অস্ট্রেলিয়ার আসল ধারণাটা তো তাই। সব কালচার থেকে ভালোটা নিয়ে এক নতুন কালচার।
এখানে বর্ণবাদের জায়গা কোথায়? চলবে...