বাংলাদেশের দুর্নীতি এবং অমানবিক আচরণ: মানবিকতা সংকটের পথে

দুর্নীতিপ্রতীকী ছবি

বাংলাদেশ, দক্ষিণ এশিয়ার একটি উন্নয়নশীল দেশ, যেখানে গত কয়েক দশকে আর্থিক ও সামাজিক উন্নয়ন অনেকাংশে সাধিত হয়েছে। তবে এ অগ্রগতির পাশাপাশি দুর্নীতি এবং অমানবিক আচরণ বড় সমস্যা হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। এ সমস্যা এতই ব্যাপক এবং গভীর যে সমাজের প্রতিটি স্তরে এর প্রভাব পরিলক্ষিত হচ্ছে এবং মানুষের মধ্যে মনুষ্যত্ববোধ ক্রমে বিলীন হতে শুরু করেছে।

বাংলাদেশে ইদানীং দুর্নীতিগ্রস্ত ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের নাম উঠে আসছে। ক্ষমতার অপব্যবহারের কারণে এ ধরনের দুর্নীতির বিরুদ্ধে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে না, যখন তারা কার্যরত অবস্থায় এবং সক্রিয়ভাবে দুর্নীতি করছে। এটি একটি সামাজিক ও রাজনৈতিক সমস্যা, যা দক্ষিণ এশিয়ার অন্য দেশগুলোতেও বিদ্যমান। ক্ষমতা এবং চাকরিতে থাকাকালে দুর্নীতির তদন্ত না হওয়া এবং ক্ষমতা চলে গেলে তথ্য ফাঁস হওয়ার প্রধান কারণ হলো ক্ষমতার অপব্যবহার ও রাজনৈতিক প্রভাব। এই অপব্যবহারের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ নেওয়া জরুরি এবং এটি যে সমস্যার মূল কারণগুলোর সঙ্গে সামাজিক ও নৈতিক স্তরে মেলানোর প্রয়োজন, সেদিকে গুরুত্ব দেওয়া আশু প্রয়োজন। কারণ, দুর্নীতি একটি সর্বগ্রাসী সমস্যা।

দুর্নীতি বাংলাদেশের জন্য নতুন কোনো সমস্যা নয়। সরকারি-বেসরকারি, সামাজিক—সব স্তরেই দুর্নীতি ব্যাপকভাবে বিস্তৃত। সরকারি কর্মকর্তাদের ঘুষ গ্রহণ, সরকারি তহবিলের অপব্যবহার এবং প্রকল্প বাস্তবায়নে অনিয়ম, এসবই দুর্নীতির পরিচিত রূপ। তা ছাড়া নির্বাচনপ্রক্রিয়ায় দুর্নীতির ছোঁয়া, প্রভাবশালী রাজনৈতিক দলের দুর্নীতিপূর্ণ কার্যকলাপ এবং বিচারব্যবস্থায় দুর্নীতির উপস্থিতি—সব মিলিয়ে এক ভয়াবহ চিত্র তুলে ধরে। দুর্নীতি কেবল অর্থনৈতিক ক্ষতি করে না, এটি সামাজিক মূল্যবোধকেও দুর্বল করে দেয়। জনগণের মধ্যে বিশ্বাসহীনতা সৃষ্টি হয় এবং সুশাসনের প্রতি আস্থা হারিয়ে ফেলে। এর ফলে নাগরিকেরা আইনের প্রতি শ্রদ্ধা হারিয়ে ফেলে এবং নিজেদের স্বার্থে অমানবিক ও অসামাজিক আচরণ করতে শুরু করে।

অমানবিক আচরণ

অমানবিক আচরণ বাংলাদেশের আরেকটি বড় সমস্যা হিসেবে দেখা দিয়েছে। শ্রমিকদের অধিকার লঙ্ঘন, নারী ও শিশুদের প্রতি সহিংসতা এবং সংখ্যালঘুদের প্রতি নির্যাতন, এসবই অমানবিক আচরণের উদাহরণ। পোশাকশিল্পে শ্রমিকদের অমানবিক পরিশ্রম করানো হয়, যেখানে নিরাপত্তার কোনো ব্যবস্থা নেই এবং মজুরিও ন্যায্য নয়। নারীদের ওপর পারিবারিক নির্যাতন, শিশুশ্রম এবং মানব পাচারের ঘটনা প্রতিনিয়ত ঘটছে। সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের প্রতি বৈষম্য ও নির্যাতন, বিশেষ করে হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান সম্প্রদায়ের ওপর আক্রমণ; তাদের সম্পত্তি ধ্বংস এবং জোরপূর্বক ধর্মান্তরকরণ সমাজে বিভেদ ও অস্থিরতা সৃষ্টি করে।

সমাধানের পথে

দুর্নীতি ও অমানবিক আচরণ মানুষের মনুষ্যত্ববোধকে ক্রমে ক্ষীণ করে দিচ্ছে। সাধারণ মানুষ নিজেদের স্বার্থের জন্য অন্যের প্রতি সহানুভূতি হারিয়ে ফেলছে। সমাজে এক ধরনের অসুস্থ প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে, যেখানে একে অপরকে পরাজিত করে নিজেকে ওপরে তোলাই প্রধান লক্ষ্য। ফলে সহানুভূতি, সহমর্মিতা ও সহানুভূতির মূল্যবোধ হারিয়ে যাচ্ছে। মানবিক মূল্যবোধের এই অবক্ষয় রোধ করতে হলে প্রয়োজন সুশাসন, ন্যায়বিচার ও সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধি। দুর্নীতি প্রতিরোধে কঠোর আইন ও তার কার্যকর বাস্তবায়ন, শিক্ষাব্যবস্থায় নৈতিক শিক্ষা ও সামাজিক আন্দোলন জরুরি। জনগণের মধ্যে মানবিক মূল্যবোধের উন্নয়ন করতে হবে, যাতে তারা একে অপরের প্রতি সহানুভূতিশীল হয়ে উঠতে পারে এবং সমাজে শান্তি ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা পায়।

আন্তর্জাতিক মূল্যায়নে প্রভাব

জাতি হিসেবে বিশ্বে আমাদের পাসপোর্টের গুরুত্ব, অর্থনীতি এবং মূল্যায়নে দুর্নীতি মারাত্মকভাবে নেগেটিভ প্রভাব বিস্তার করছে। পাসপোর্ট আমাদের আন্তর্জাতিক পরিচয় ও স্বাধীনতা প্রকাশের মাধ্যম। এটি প্রতিটি দেশের নাগরিকের প্রতি অন্যদের বিশ্বাস ও বিনম্র দেখায়। পাসপোর্টের গুরুত্ব হিসেবে নিজের দেশ এবং বিশ্বের মধ্যে সম্পর্ক ও প্রভাবের বিশ্বাসযোগ্য প্রতীক হয়ে ওঠে। পাসপোর্টের মাধ্যমে আমরা অন্য দেশে ভ্রমণ করতে পারি, বিদেশি শিক্ষা অর্জন করতে পারি, ব্যবসা করতে পারি এবং বিভিন্ন অনুষ্ঠানে অংশ নিতে পারি। কিন্তু বাংলাদেশের পাসপোর্ট সেই সুযোগগুলো জাতিকে সঠিকভাবে দিতে পারছে না, দুর্নীতি ও নীতিহীনতার কারণে।

জাতি হিসেবে বিশ্বের মধ্যে অর্থনৈতিক অবস্থা এবং উন্নতি মূল্যায়ন করা হয় দেশের উৎপাদনক্ষমতা, বাজারের প্রবৃদ্ধি, আয় ও সঞ্চয়ের মানদণ্ড, বেতন এবং মজুরির স্তর, প্রযুক্তিগত উন্নতি, মানুষের জীবনধারা ইত্যাদি পারিপার্শ্বিকতার সঙ্গে। প্রতিটি দেশের অর্থনীতির পরিসংখ্যানিক তথ্য এবং সুস্থ প্রার্থনাব্যবস্থা মাধ্যমে তা মূল্যায়ন করা হয়। এটি কোনো দেশের সক্ষমতা ও স্থিতিশীলতা মূল্যায়নের অগ্রগতি ও বিকাশের পরিসংখ্যানিক মূল্যায়ন করে দেখায়।

বাংলাদেশের দুর্নীতি এবং অমানবিক আচরণের সমস্যা এতই ব্যাপক যে এটি মনুষ্যত্ববোধকেও ক্ষতিগ্রস্ত করছে। ভোট চুরি এবং গণতন্ত্রের হুমকি সমাজের ন্যায়বিচার এবং সুশাসনের পথে বড় বাধা সৃষ্টি করছে। এই অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য প্রয়োজন সম্মিলিত প্রচেষ্টা, কঠোর আইন প্রয়োগ, এবং মানবিক মূল্যবোধের পুনর্জাগরণ। শুধু তখনই আমরা একটি সুষ্ঠু, শান্তিপূর্ণ ও ন্যায়ভিত্তিক সমাজ গড়ে তুলতে সক্ষম হব।

*লেখক: রহমান মৃধা, সাবেক পরিচালক, ফাইজার, সুইডেন।
     *দূর পরবাসে ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]