পরিবার-পরিজন ফেলে প্রবাসে রোজা পালন করা ধর্মীয় কর্তব্যের পাশাপাশি একটি সাংস্কৃতিক অভিজ্ঞতাও। দেশভেদে রোজা ও রমজানের অনুষ্ঠান, আচার-আচরণ এবং কৃষ্টি-কালচারের মধ্যে রয়েছে নানা পার্থক্য ও বৈচিত্র্য। প্রবাসীদের জন্য রোজা রাখা খানিকটা চ্যালেঞ্জিং হতে পারে। কিন্তু আমাদের ধর্মীয় পরিচয়, সংস্কৃতির অংশ, আত্মশুদ্ধি এবং মহান আল্লাহর প্রতি আনুগত্য প্রকাশের আশায় ধর্মপ্রাণ প্রবাসীরা সিয়াম সাধনায় সচেষ্ট থাকেন। এই লেখায় থাকছে প্রবাসে (জার্মানিতে) রোজা রাখার অভিজ্ঞতা, ইফতারের আয়োজন এবং নানা বিষয়ে আলোচনা।
সাহ্রি
আমাদের দেশে সাহ্রির সময় ঘুম ভাঙে মুয়াজ্জিনের ডাকে কিংবা পরিবার-পরিজনের আহ্বানে। কিন্তু প্রবাসে ঘুম ভাঙে মুঠোফোনের অ্যালার্মে। এখানে (জার্মানিতে) মাইক ব্যবহারের অভাবে আমাদের দেশের মতো সাহ্রির ডাকের সংস্কৃতি গড়ে ওঠেনি। তবে এখানে ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা সিয়াম সাধনার ব্যাপারে অত্যন্ত আন্তরিক।
জার্মানিতে রমজান মাস পালন করা কখনো কখনো চ্যালেঞ্জিং। বিশেষ করে যখন দিনের সময়কাল দীর্ঘ হয়। তবে মুসলিমরা সাধারণত এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে সক্ষম হন। অনেকেই কর্মক্ষেত্রে তাঁদের রোজা রাখার সময়সূচি সম্পর্কে নিয়োগকর্তাকে অবহিত করেন, যাতে কাজের সময় তাঁরা তাঁদের ধর্মীয় কর্তব্য পালন করতে পারেন। কিছু প্রতিষ্ঠান রমজান মাসে মুসলিম কর্মচারীদের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ করে, যেমন ফ্লেক্সিবল কাজের সময়। অমুসলিম সহকর্মীরাও ধর্মীয় সাধনাকে সম্মান জানান।
ইফতার
জার্মানিতেও রমজানে আমাদের দেশের মতো মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে একটি বিশেষ সামাজিক ও সাংস্কৃতিক পরিবেশের সৃষ্টি হয়। অনেক মুসলিম পরিবার একসঙ্গে ইফতার করার জন্য প্রস্তুতি নেয় এবং তারা তাদের প্রতিবেশী ও বন্ধুদের আমন্ত্রণ জানায়। কিছু শহরে মুসলিম সংগঠনগুলো পাবলিক ইফতার অনুষ্ঠানের আয়োজন করে, যেখানে বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মানুষ একত্র হয়। আমাদের দেশীয় রাজনৈতিক ও অরাজনৈতিক সংগঠনগুলোও ইফতার অনুষ্ঠানের আয়োজন করে, যেখানে দেশীয় সংস্কৃতির সম্মিলন ঘটে। বিভিন্ন পরিবার বা বন্ধুবান্ধব মিলে খোলা মাঠে, নদীর পাড়ে, পার্কে ইফতার আয়োজন করে। সাধারণত আমরা ইফতারের সময় দেশীয় ঐতিহ্যবাহী খাবারের পাশাপাশি বিভিন্ন আরবি, তুর্কি খাবারের মেনুও যোগ করে থাকি। যেমন ডোনার, লামাজুন, স্যুপ, ইসকন্দার, ইসুলি ইউপকা, পিডে এবং ব্যক্তিপছন্দের বাহারি রকমের বিভিন্ন দেশের খাবার।
এ ছাড়া জার্মানিতে রমজান মাসজুড়ে বিভিন্ন ধর্মীয় অনুষ্ঠান ও সভা অনুষ্ঠিত হয়। বিভিন্ন মসজিদে প্রতিদিন ইফতার আয়োজন করা হয়। বাংলাদেশিদের পরিচালিত মসজিদগুলোতে সাধারণত দেশীয় খাবার দেওয়া হয়।
জার্মানির ফাংঙ্কফুর্টে
মাবিন মসজিদ বাংলাদেশিদের কাছে রমজানে ইসলামচর্চার প্রাণকেন্দ্র হয়ে দাঁড়িয়েছে। মসজিদ পরিচালনা কমিটির অন্যতম সদস্য জনাব মো. আমান ইসলামের ভাষ্য, এখানে প্রতিদিন প্রায় ২৫০ জনের জন্য ইফতারের আয়োজন করা হয়। বাংলাদেশি ছোলা, মুড়ি, পেঁয়াজুসহ দেশীয় প্রায় সব মেনু রাখা হয়, মাগরিবের নামাজ শেষে সবার মধ্যে বিরিয়ানি কিংবা ভাত–মাংস বিতরণ করা হয়। তিনি আরও মন্তব্য করেন, প্রবাসে রমজানে মাবিন মসজিদ যেন একটি দেশীয় সংস্কৃতি চর্চার ধারক ও বাহক।
ইফতারের সময় মসজিদগুলোতে ব্যাপক ভিড় থাকে। সাধারণত বেশির ভাগ ব্যাচেলর প্রবাসী মসজিদে ইফতার করাকে পছন্দ করেন। আরবি, তুর্কি, আফগানি কিংবা পাকিস্তানি হালাল রেস্টুরেন্টগুলোতে তৈরি করা হয় তাদের দেশীয় ঐতিহ্যবাহী মুখরোচক নানান খাবার। ইফতারের সময় হালাল রেস্টুরেন্টে থাকে উপচে পড়া ভিড়।
বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত বাংলাদেশি শিক্ষার্থীরাও তাঁদের ডর্মে (হলে) ইফতারের আয়োজন করে থাকেন। এ সময় তাঁরা বিভিন্ন দেশের মুসলিম-অমুসলিম সহকর্মী বা ক্লাসমেটদের দাওয়াত দিয়ে থাকেন। এ সময় তাঁদের মধ্যে বন্ধুত্ব ও ভ্রাতৃত্বের বন্ধন দৃঢ় হওয়ার পাশাপাশি বহুজাতিক সাংস্কৃতিক বিকাশ ঘটে। তবে বাংলাদেশিদের রোজা-রমজানের দেশীয় সংস্কৃতি প্রবাসেও এক ও অভিন্ন।
রমজানের এই ত্যাগ-মহিমার বিনিময়ে মুসলিম উম্মাহসহ বিশ্বব্যাপী সবার শান্তি প্রতিষ্ঠিত হোক।
‘দূর পরবাস’-এ জীবনের গল্প, নানা আয়োজনের খবর, ভিডিও, ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]