মা–ই দেশ, দেশই মা

লাল-সবুজ সব সময়ই আমাদের গর্বের অংশছবি: লেখক

জীবনে প্রথমবারের মতো বাড়ির বাইরে থাকা শুরু করেছি বুয়েটে ভর্তি হওয়ার পর। প্রথম সপ্তাহের ক্লাস শেষ হওয়ার পরই মন পোড়া শুরু করল কুষ্টিয়ার জন্য, মায়ের জন্য। এমন না যে কুষ্টিয়া থাকাকালে সারাক্ষণ মায়ের আঁচলে আঁচলে ঘুরতাম। কিন্তু বাড়ির বাইরে আসার পর মায়ের সঙ্গে নাড়ির টান উপলব্ধি করতে পারলাম। বন্ধু সানজাদ আর আমি বুদ্ধি করলাম সপ্তাহ শেষে বাড়ি যাওয়ার। তখন আমাদের ছুটি ছিল শুক্র ও শনিবার। শেষ কর্মদিবস বৃহস্পতিবার ক্লাস করে আমরা দুই বন্ধু সন্ধ্যার পর চলে গেলাম কল্যাণপুর বাসস্ট্যান্ডে। শেষ সময় বাসের একদম শেষের সারির জে লাইনের টিকিটগুলোই অবিক্রীত থাকে। আমরা দুই বন্ধু সেখান থেকে দুটি টিকিট কিনে বাসে চড়ে বসলাম। বাস যখন কুষ্টিয়া পৌঁছে, তখন মাঝরাত গড়িয়ে গেছে। কুষ্টিয়া বাসস্ট্যান্ড থেকে রিকশা নিয়ে বাড়ির উঠানে পৌঁছামাত্র একবার মা বলে ডাক দিয়েছি। সঙ্গে সঙ্গে দরজা খুলে বাইরে বেরিয়ে এলেন। আমি তো রীতিমতো অবাক। পরে আব্বা বলেছিলেন, আমি ঢাকায় যাওয়ার পর মা একটা রাতও ঠিকমতো ঘুমাতে পারেননি।

প্রতি রাতে একাধিকবার দরজা খুলে বাইরে এসে দেখতেন, আমি ফিরেছি কি না। তখন আমি আমার প্রতি মায়ের ও মায়ের প্রতি আমার ভালোবাসার স্বরূপ কিছুটা হলেও বুঝেছিলাম।

প্রবাসী হওয়ার পর দেশের প্রতি ভালোবাসাটাও একইভাবে টের পেয়েছিলাম। তাই বছর শেষের ছুটিতে সবাই যখন বিভিন্ন দেশে বেড়াতে যায়, আমি তখন প্রতিবার আমার মায়ের কাছে, আমার দেশের কাছে ফিরে আসি। এসেই দেশের দরজা এয়ারপোর্টে এসে ধাক্কা খেতে হয়। এবার ইমিগ্রেশনের লাইনে দাঁড়িয়ে একদম কাউন্টারের সামনে এসে পড়েছি। আমার পেছনে দাঁড়ানো এক স্বদেশি ভাইকে বলছিলাম, পুলিশের এই চাকরি একটা ‘থ্যাংক লেস জব’। একজন পুলিশ তাঁর নির্ধারিত সময়ের চেয়ে বেশি সময় ডিউটি করেন। তখন হঠাৎ ইমিগ্রেশন কাউন্টারের পুলিশ ভদ্রলোক উঠে এসে বলেন, আপনারা উন্নত দেশ থেকে এসে লাইনে দাঁড়ান না কেন? আমি তো আকাশ থেকে পড়লাম। এরপর উনি আমাদের নিয়ে দাঁড় করালেন লাইনের একদম শেষে। আমরা আবারও লাইনে দাঁড়িয়ে আধা ঘণ্টার কাজ দুই ঘণ্টায় শেষ করে আসার সময় সেই পুলিশ ভদ্রলোককে ধন্যবাদ দিলাম। লাগেজের লাইনে এসে দেখি শুধু আমাদের ব্যাগগুলো পড়ে আছে। দুজন ভদ্রলোক বলেন, তাঁরা আমাদের দেরি দেখে গুছিয়ে রেখেছেন। এরপর ট্রলি নিয়ে সেগুলো কুড়িয়ে নিলাম। ওনাদের ধন্যবাদ দিয়ে বকশিশস্বরূপ কিছু টাকা দিলাম। মনে হলো ওনারা খুশি হননি।

বাংলাদেশের এয়ারপোর্ট নিয়ে বহু লেখালেখি হয়। কিন্তু সেগুলো শুধু লেখার জন্যই লেখা। আমি অবশ্য কখনোই দেশের কোনো কিছু নিয়ে তেমন অভিযোগ করি না। দেশে থাকতে একটু–আধটু বিষোদ্‌গার করলেও এখন তার বিন্দুমাত্র অবশিষ্ট নেই। আমাদের মেয়েটা জানে বাবাকে দেশের কোনো বিষয় নিয়ে জিজ্ঞাসা করলে বাবা এমন একটা ব্যাখ্যা দেবেন, যাতে মনে হবে এটাই স্বাভাবিক। তাই আজকে যখন আমাদের সঙ্গে এ ঘটনাগুলো ঘটছিল, তখন দেখি সে মিটিমিটি হাসছে। পরে আমি তাকে বললাম, পুলিশের দায়িত্ব আইনশৃঙ্খলা রক্ষা করা। আর বাংলাদেশের এত বড় জনগোষ্ঠীকে কাজ করে খেতে হবে।

বিশ্বের বুকে এখন জায়গা করে নিয়েছে বাংলাদেশের পতাকা
ছবি: লেখক

কিন্তু সবাই তো আর কাজ পায় না। তাই এয়ারপোর্টে এই বাড়তি মানুষগুলো নিজেদের একটা কাজ খুঁজে নেন। শুনে মেয়েটা বলল, ‘আমি জানতাম দেশের কোনো কিছুই তোমার খারাপ লাগে না, তোমাকে বিরক্ত করে না।’ তখন আমি বললাম, দেশ তো আমার মা। আমার মা আমাকে জন্ম দিয়েছেন। আর এই দেশমাতৃকার আলো–বাতাসে আমি বড় হয়েছি। পরে যখন স্বাবলম্বী হয়েছি, তখন দেশের মানুষের কোনো কাজে না এসে স্বার্থপরের মতো নিজের আরও একটু সুখের আশায় সাত সমুদ্র তেরো নদী পাড়ি দিয়েছি। তাহলে কীভাবে আমি আমার মাকে খারাপ বলি, কীভাবে দেশমাতৃকাকে দোষারোপ করি।

বাংলাদেশের একেবারে প্রত্যন্ত এলাকা চরভবানীপুরে আমার জন্ম। তারপর নানা চড়াই–উতরাই পেরিয়ে এখন প্রবাসী। এই ছোট্ট জীবনে অভিজ্ঞতার ঝুলি অনেক সমৃদ্ধ। একজীবনে যাপন করেছি বহু জীবন।

নামমাত্র খরচে পড়াশোনা করেছি বাংলাদেশের সর্বোচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে, যার খরচ জুগিয়েছে এই দেশের রিকশাচালক থেকে শুরু করে গার্মেন্টসে নিরলসভাবে কাজ করে যাওয়া মেয়েগুলো, প্রবাসী বাংলাদেশের রেমিট্যান্স। আর খাবার জুগিয়েছে গ্রামবাংলার সোনার সন্তান চাষিরা। এরপর পেশাগত জীবনে চাকরি করেছি বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে। এরপর বাংলাদেশ সরকারি কর্ম কমিশনের পরীক্ষার মাধ্যমে চাকরি করেছি প্রথম শ্রেণির সরকারি কর্মকর্তা হিসেবে একেবারে উপজেলা পর্যায় থেকে ঢাকায়।

এরপর দেশ ছাড়ার আগে দৌড়াদৌড়ি করতে হয়েছে সচিবালয়ের বারান্দায়। দেশে দুই রকমের উন্নয়ন হয়। একটা হলো বাস্তব উন্নয়ন, আরেকটা হলো কাগজের উন্নয়ন এবং এই দুই উন্নয়নের মধ্যে ব্যবধান আকাশ–পাতাল। তবুও দেশটা টিকে আছে সাধারণ মানুষের অক্লান্ত পরিশ্রমের কারণে।
আমি বাস্তব অভিজ্ঞতায় দেখেছি, দেশটাকে টিকিয়ে রেখেছে দেশের আপামর সাধারণ মানুষেরা।

উত্তরবঙ্গে দেখেছি, মহিলারা শাড়ি পরে ছেলেদের ফুলহাতা শার্ট পরে মাঠে নেমে পড়েছেন। পাহাড়ে দেখেছি, আদিবাসী নারীরা পাহাড়ি শস্যের ঝুড়ি নিয়ে পাহাড়ে ওঠানামা করেন। গার্মেন্টসের মেয়েগুলো একটা সাধারণ চপ্পল পরে আর টিফিন বাক্সের একটি বাটিতে সামান্য একটু খাবার নিয়ে হাড়ভাঙা খাটুনির পরিশ্রম করছেন। চাষিদের কথা আর কী বলব। নিজে না খেয়ে খেতের সবচেয়ে ভালো ফসলটা তুলে দেন আমাদের পাতে। কিন্তু নিজের ভাগ্য আর বদলাতে পারেন না। দিনে দিনে হাড্ডিসার হতে হতে একসময় মাটির সন্তান মাটিতেই মিশে যান। আর প্রবাসীদের কথা কী বলব। যাঁদের রক্ত পানি করা উপার্জন আমাদের অর্থনীতির চাকা সচল রাখে, তাঁদেরকে আমরা হয়রানি করি প্রতিটি পদক্ষেপে।

পাসপোর্ট বানানো থেকে শুরু করে ভিসা নেওয়া, প্রতিটি বিষয়ে ঘুষ দিয়েও তাঁরা নির্দিষ্ট সার্ভিসটা পান না। আর এয়ারপোর্টে তাঁদের সঙ্গে যে ব্যবহারটা করা হয়, সেটা আমরা রাস্তার কুকুরের সঙ্গেও করি না।

বাংলাদেশের সংবিধানে বলা আছে, প্রজাতন্ত্রের সব ক্ষমতার উৎস জনগণ। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে দেশের সব ক্ষমতার উৎস দেশের আমলারা। রাজনীতিবিদেরা তো দেশের ইজারাদারমাত্র। প্রতি পাঁচ বছর অন্তর অন্তর তাঁদের হাতবদল হয়। এই রাজনীতিবিদ আর আমলারা দেশের সাধারণ মানুষের টাকায় বেতন তো নেনই। আর উপরি নিয়ে সেটা বিদেশে পাচার করে বিভিন্ন দেশে গড়ে তুলেন বেগমপাড়া। আমি ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতায় বেশকিছু মানুষকে চিনি, যাঁরা এমনভাবে আঙুল ফুলে কলাগাছ হয়েছে। তাঁদের স্বামী–স্ত্রী থেকে শুরু করে সন্তানাদি এমন ভাব করেন, যেন দেশটা তাঁদের পূর্বপুরুষদের একান্ত ব্যক্তিগত সম্পত্তি।

তাঁরা দেশের সঙ্গে, দেশের মানুষের সঙ্গে যা খুশি, তা–ই করার অধিকার তাঁদের আছে। মজার ব্যাপার হচ্ছে, দেশটা জোঁকের মতো শুষার পরও দিন শেষে দেশের মুণ্ডুপাত করেন আর দেশে দেশে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য গড়ে তোলে নিরাপদ আবাস। কিন্তু সাধারণ মানুষ দেশের শত প্রতিকূলতা নিয়েও দেশেই থেকে যান। এই দেশের কাদামাটি বুকে নিয়ে পার করে দেন একেকটা সাধারণ জীবন। তাঁদের নেই কোনো ক্ষমতার মোহ, না আছে গোপন মনোবাঞ্ছা। কী অসাধারণ এসব সাধারণ জীবন!

আমার কাছে দেশই মা। মা–ই দেশ। আমি তাই দিন শেষে, বছর শেষে মায়ের কাছেই ফিরে আসি। আমি যেমন আমার মাকে নিয়ে কোনো খারাপ কথা বলি না, দেশকে নিয়েও খারাপ কথা বলি না। দেশকে নিয়ে খারাপ কথা বলা মানে নিজের গায়ে নিজে থুতু দেওয়া। আমি তাই নিজের সম্মান রাখার জন্যই দেশের ভালো দিকগুলোর দিকে তাকাই। তার মানে এই নয় যে দেশের খারাপ বিষয়গুলো আমাকে ভাবায় না।

কিন্তু সেই দুঃখ মনেই পুষে রাখি আর আশাবাদ ব্যক্ত করি একদিন এগুলোরও সমাধান হবে। মুক্তিযুদ্ধের পর পুরোপুরি একটা পঙ্গু অর্থনীতি থেকে আজ বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ার, এমনকি বিশ্বের অন্যান্য অনেক দেশের জন্য রোল মডেল। যেটা কোনো হিসেবেই বিশ্বের জ্ঞানী–গুণীরা মেলাতে পারেন না।

আসলে অনেক বিষয়ই আছে, যেখানে গণিতের, অর্থনীতির সব সূত্র সব সময় খাটে না। তাই ১৯৭১ সালের তলাবিহীন ঝুড়ি আজ অনেক সম্পদের ভান্ডার। প্রতিবছর বিজয় দিবস সামনে এলে এ সত্যটা নতুন করে অনুভব করি।

ফিরে আসি প্রসঙ্গে। আপনি যদি আপনার মাকে ভালোবাসেন, তাহলে অবশ্যই আপনি আপনার দেশকেও ভালোবাসেন। আপনি যেভাবে চান আপনার মা ভালো থাকুক, একইভাবে যদি চান আপনার দেশটা ভালো থাকুক, তাহলে কিন্তু দেশের সত্যিকারের উন্নয়ন আর কোনো কাগজে বন্দী হয়ে থাকবে না।

সামান্য যা কিছু সমস্যা আছে, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সেগুলো মিলিয়ে যাবে বলেই আমার বিশ্বাস। তাই আসুন, বিজয় দিবসকে সামনে রেখে আবারও আমরা নতুন করে মাকে ভালোবাসি, দেশকে ভালোবাসি। কারণ, মা–ই দেশ, দেশই মা।