আবার দেখা হবে ইস্তাম্বুল

পৃথিবীর যে কয়টি প্রাচীন শহর রয়েছে, তার মধ্য তুরস্কের ইস্তাম্বুল অন্যতম। শহরটি সম্পর্কে জানাশোনা আমার অনেক বছরের। প্রায় এক যুগ আগে বিশ্ববিদ্যালয়জীবনে একবার তুরস্কে যাওয়ার সুযোগ পেয়েও নানা জটিলতায় যেতে পারিনি। সেদিন থেকে মনের মধ্যে ইস্তাম্বুল ও আঙ্কারা শহর ঘুরে দেখার ইচ্ছা ছিল। অবশেষে সে স্বপ্ন পূরণ হলো এবার। পবিত্র ঈদুল ফিতরে মিয়ামি থেকে বাংলাদেশে গিয়েছিলাম। টার্কিশ এয়ারলাইনসে টিকিট কেটে ৩ মে ঢাকা থেকে ফেরার পথে প্রায় ১৩ ঘণ্টা যাত্রাবিরতি নিয়েছিলাম ইস্তাম্বুল বিমানবন্দরে। এ সুযোগে শহরটিকে একটু ঘুরে দেখলাম। দিনব্যাপী ঘোরাঘুরির অভিজ্ঞতা তুলে ধরব।

১৯২৩ সালে তুরস্কের স্বাধীনতাযুদ্ধের পর দেশটির রাজধানী আঙ্কারায় স্থানান্তরিত করা হয়। আঙ্কারা শহরটি তুরস্কের প্রশাসনিক রাজধানী হলেও ইস্তাম্বুল আজও দেশটির ইতিহাস, অর্থনীতি ও সংস্কৃতির মূল কেন্দ্র। ১৯৩০ সালে শহরটির নাম আনুষ্ঠানিকভাবে ইস্তাম্বুল রাখা হয়, যা এগারো শতক থেকে গ্রিকভাষীরা কথোপকথনে শহরটিকে বোঝাতে ব্যবহার করত।

ই-ভিসা

যাঁদের ইতিমধ্যে সেনজেনসহ যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও আয়ারল্যান্ডের ভিসা আছে, তাঁরাই এই ওয়েবসাইটে https://www.evisa.gov.tr/en/ গিয়ে ৬০ ডলার পরিশোধ করে খুব সহজেই ই–ভিসা নিতে পারবেন। অথবা শুধু ক্যাশ দিয়ে ইস্তাম্বুল বিমানবন্দর থেকেও নিতে পারবেন। আমি বাংলাদেশে থাকেন সময়ে ই-ভিসা করে নিয়েছিলাম। মেয়াদ ৬ মাস পর্যন্ত ছিল।

টার্কিশ এয়ারলাইনের যেসব যাত্রীর যাত্রাবিরতি ৬ থেকে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে, তাঁদের জন্য কমপ্লিমেন্টরি ট্যুর ইস্তাম্বুল নামে একটি প্যাকেজ আছে। আমি এই প্যাকেজ নিয়েছিলাম। বিকেল ৪টা থেকে রাত সাড়ে ৯টা পর্যন্ত ঘুরে বেড়িয়েছি ইস্তাম্বুল শহর।

একজন দক্ষ গাইড আমাদের নিয়ে বাসে রওনা দেন। ৪০ থেকে ৫০ জনের একটা গ্রুপ হয়েছিল। সৌভাগ্যক্রমে তানজিম নামের এক বাংলাদেশি ভাইকে পেয়েছিলাম। উনি জার্মানি থাকেন। যাহোক, আমাদের বহনকারী বাস ৪০ মিনিট পর ইস্তাম্বুল শহরে পৌঁছায়। পথিমধ্যে আমাদের গাইড মি ওকান বিভিন্ন ইতিহাস সম্পর্কে বর্ণনা দেন। ইস্তাম্বুলের ঘরবাড়িগুলো মোটামুটি একই নকশার। এটা আমাকে মুগ্ধ করেছে।

বাস থেকে নেমে আমরা ইস্তাম্বুল বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে যাই। আঠারো শতকে অটোমান সাম্রাজ্যের সময়ে নির্মিত নুরুওসমানিয়ে মসজিদ। এর নির্মাণশৈলীতে মুগ্ধ হবেন সবাই। মার্বেল পাথরের কী নিখুঁত গাঁথুনি! মসজিদে যখন প্রবেশ করি, তখন আসরের ওয়াক্ত, তাই এই সুযোগে ঐতিহাসিক মসজিদে দুই রাকাত কসরের নামাজ আদায় করলাম। নামাজ পড়ে দেখি, আমার গ্রুপের সবাই চলে গেছে, কারণ নির্দিষ্ট সময়ের চেয়ে আমি ২ মিনিট পরে এসেছিলাম। আমার মুঠোফোনে নেটওয়ার্ক ছিল না। আল্লাহর রহমতে দুই টার্কিশ যুবক আমাদের সাহায্য করেছিল।

আমি গ্র্যান্ড বাজারের গিয়ে গ্রুপের সঙ্গে যুক্ত হয়ে যাই। গ্র্যান্ড বাজার মূলত আমাদের দেশের গুলিস্তানের মার্কেটের মতো। কী নেই এখানে! গার্মেন্টস, জুয়েলারি, জুতাসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় সব পণ্যেরই দোকান রয়েছে। সবচেয়ে বেশি চোখে পড়ল মিষ্টির দোকান। বাহারি রকমের মিষ্টান্ন। এখানকার ব্যবসায়ীরা অনেক ধূর্ত মনে হলো। তাই সাবধান। প্রায় ৬০০ বছরের পুরোনো এই মার্কেট। এই বাজারের দোকানি বাদে বাকি সবাই ট্যুরিস্টই মনে হলো।

বাজার ঘুরতে ঘুরতে ক্লান্ত হয়ে চলে গেলাম ডিনারে। বিখ্যাত টার্কিশ কাবাব দিয়ে ডিনার শুরু করলাম। সঙ্গে ছিল পাউরুটি, ভাত, সালাদ, স্পেশাল পানীয়, চাটনি। ডিনার শেষ করে আবার ইস্তাম্বুলের রাস্তায় বের হলাম। এত মানুষ, মনে হয়েছে ঢাকার গুলিস্তানেই আছি।

আমাদের এবারের গন্তব্য ৬০০ বছরের পুরোনো স্থাপনা থিও ডিওসিয়াসের ওবেলিস্ক। এখানে কিছু ছবি তুলতে গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি শুরু হলো। এই স্থাপনার পাশেই অবস্থিত বিখ্যাত ব্ল মসজিদ। এটাকে অনেকে সুলতান আহমেদ মসজিদ নামে চেনেন। অটোমান সাম্রাজ্যের সময়ে ১৬০৯-১৭ সালের মধ্যে আহমেদ-১ এটি নির্মাণ করেন। আমরা যখন এই মসজিদের ভেতরে প্রবেশ করি, তখন মাগরিবের ওয়াক্ত শুরু হলো। বাইরে প্রচণ্ড বৃষ্টিও শুরু হলো। মসজিদের ভেতরের কারুকার্য সত্যিই মনোমুগ্ধকর। প্রায় ১০ হাজার মুসল্লি একসঙ্গে এই মসজিদে নামাজ আদায় করতে পারেন। রাতের মসজিদের লাইটগুলো যখন জ্বালানো হলো, অন্য রকম দেখতে লাগছিল। সুলতান আহমেদ মসজিদের পাশেই আরেক বিখ্যাত আয়া সোফিয়া।

দেখতে দেখতে কখন যে সময় শেষ হয়ে রাত হয়ে গেল, বুঝতেই পারলাম না। ইস্তাম্বুল থেকে বিমানবন্দরে ফেরার পথে বসফরাস সেতু দেখলাম, যা এশিয়া আর ইউরোপ মহাদেশকে যুক্ত করেছে।

যাঁরা টার্কিশ এয়ারলাইনসে ভ্রমণ করেন, ইচ্ছা করলে এ ধরনের ট্যুর ইস্তাম্বুল প্যাকেজ আপনারাও উপভোগ করতে পারেন। যা–ই হোক, সংক্ষিপ্ত এই সফরে অনেক অভিজ্ঞতা নিয়ে ফিরলাম। ইনশা আল্লাহ আবার দেখা হবে ইস্তাম্বুল।

লেখক: মো. মুস্তাফিজুর রহমান পাপ্পু, সাধারণ সম্পাদক, আটলান্টিস বিশ্ববিদ্যালয় স্টুডেন্টস লাইফ অর্গানাইজেশন, মিয়ামি, ফ্লোরিডা, যুক্তরাষ্ট্র।

**দূর পরবাসে ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]