হংসকন্যা

অলংকরণ: মাসুক হেলাল

কত দিন পর গণকখালী সেতুটিতে এলাম। কত-না স্মৃতি জমা আছে এই সেতু ঘিরে। পুরোনো জায়গায় গেলে মন পুলকিত হওয়ার কথা। অথচ আমার মনটা বিষাদে ভর করেছে। কেন এমন হলো? আমার তো কোনো দোষ ছিল না! তবে কেন সে এমন করল। কেন?

একদিন ভোরবেলায় গণকখালী সেতুর রেলিং ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছি। প্রতিনিয়ত ভোরবেলায় আমার হাঁটা হয়। সেদিন হঠাৎ হাঁটতে মন চাইছে না। তাই সেতুর রেলিংয়ে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলাম। রাস্তা দিয়ে মাঝেমধ্যে মালবাহী যানবাহন যাতায়াত করছে। ঘন কুয়াশায় চারপাশ মোড়ানো। কাছ থেকে একটু দূরে কিছু দেখা যায় না। হঠাৎ একদল হংসের শব্দ কানে এল। কিন্তু কিছুই দেখা যাচ্ছে না। কিছুটা সময় যেতেই চোখে পড়ল একঝাঁক হাঁস। সঙ্গে কেউ একজন রয়েছে। সে হলো হংসের মালিক। আমার পাশ দিয়ে যাচ্ছে। আমি মজা করে বলে উঠি, কেমন আছো হংসকন্যা?
মেয়েটি আমার দিকে তাকাল। আমি দেখে রীতিমতো বিস্মিত। এতটা সুন্দর মানুষ হয়। মনে হচ্ছে আকাশ থেকে পরি নেমে এসেছে। মেয়েটি বলল, ‘অত ভোর বেহাইনে এহানে কী হরেন?’

আমি কোনো উত্তর দিলাম না। শুধু মুগ্ধ হয়ে মেয়েটিকে দেখছিলাম। মেয়েটি চলে গেল হাঁসের সঙ্গে। আমি ভাবতে লাগলাম, এটা কী হলো আমার সঙ্গে।

গ্রামের মেয়ে। লেখাপড়াও তেমন জানে না। দেখতে যেন পৃথিবীর সেরা সুন্দরীদের একজন। কত সুন্দর চোখ। যে চোখের দিকে তাকিয়ে জীবন কাটিয়ে দেওয়া যাবে। এক দিন, দুই দিন, তিন দিন—অল্প অল্প কথা বলতে বলতে হংসকন্যার সঙ্গে প্রেম হয়ে যায়। হংসকন্যা যথেষ্ট শিক্ষিত ও মার্জিত একজন মানুষ। অনার্সের প্রথম বর্ষের ছাত্রী। অথচ আমার সঙ্গে আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলাতে শুরুতে আমি ভেবেছিলাম অশিক্ষিত।

একদিন হংসকন্যা শাড়ি পরে এসেছে। কী যে সুন্দর লাগছিল। ইচ্ছা করছে জড়িয়ে ধরে চুমু খেতে। হংসকন্যা আমার খুব কাছে এসে বলল, ‘কী দেখছো?’
‘তোমাকে দেখছি।’
‘আমাকে তো প্রতিদিনই দেখো।’
‘প্রতিদিনের দেখা আর আজকের দেখা এক নয়।’
‘কেন, আজকের আমার মাঝে কী এমন আছে যে অন্য রকম লাগছে।’
‘আমি কী তোমাকে একটু জড়িয়ে ধরতে পারি।’

অলংকরণ: আরাফাত করিম

জড়িয়ে ধরার কথা শোনে হংসকন্যাও চুপ হয়ে গেল। একদম চুপ। আমাদের মাঝে এখন নৈঃশব্দ্যেরা খেলা করছে। মুখের ভাষা টাটা জানিয়েছে, চোখের ভাষার আবির্ভাব হলো। কিছুটা সময় যেতে না যেতেই চোখটাও লুকিয়ে গেল। দুজনার দুটি দেহের ভাষার কাছে অন্য সব হার মানল। হংসকন্যার ইন্দ্রিয় জাগ্রত হলো। তার দেহের পারফিউমের ঝাঁজালো গন্ধে আমি মাতাল। হংসকন্যা খুব বেশি উত্তেজিত। শরীর থেকে শাড়িটা ফেলে দিতে চাইছে। আমি কোনোমতেই তাকে নিয়ন্ত্রণে আনতে পারছি না। চোখ মেলে দেখি, কেউ একজন আসছে। এদিকে হংসকন্যার দিকে তাকিয়ে দেখি, শাড়ির ভাঁজটা আর আগের মতো নেই। কপালের টিপটাও সরে গেছে। বুকের ওপরের কাপড়টাও ঠিক নেই। দাঁত দিয়ে যেন নিজের ঠোঁট দুটিকে চিবিয়ে খাবে। নিজের হাতে কপালের টিপ, আঁচল, শাড়ির ভাঁজ তড়িঘড়ি করে ঠিক করে কেটে পড়ি।

এর দুই দিন পরের ঘটনা। গণকখালীর সেতু থেকে একটু দূরে। ভোরবেলায় কার যেন চিৎকার শুনলাম। আমি ছুটে গেলাম। কাছাকাছি আসার পর স্পষ্ট বুঝতে পারি, এটা আমার হংসকন্যার গলার শব্দ। আমার মাথার ওপর আকাশ ভেঙে পড়ে। এক দৌড়ে কাছে এসে দেখি, তিনজন দৌড়ে পালাচ্ছে। হংসকন্যার নিথর দেহটা উলঙ্গ হয়ে পড়ে আছে ধানখেতের আলের ওপর। আমি সানজিদার গলা থেকে ওড়নার প্যাঁচ খোলে শরীরটা ঢাকতে গেলে সানজিদা জেগে ওঠে এবং আমাকে কিলঘুষি দিতে থাকে। চিৎকার করে বলে, ‘শুয়োরের বাইচ্চা, কুত্তার বাইচ্ছা...।’

আমি সানজিদাকে জড়িয়ে ধরে বলি, ‘সানজিদা আমি তোমার অন্তর।’

সেদিন আমি হংসকন্যাকে অনেক বুঝিয়ে ছিলাম। এটা একটা অ্যাক্সিডেন্ট। তোমার কিচ্ছু হয়নি। আমি তোমার পাশে আছি। এক ফাঁকে সানজিদা বলে ওঠে, ‘অন্তর, আমি না তোমার হংসকন্যা। তাহলে আজ কেন সানজিদা বলে ডাকলে?’ সানজিদাকে নিয়ে গণকখালী সেতুর ওপর দিয়ে যাওয়ার সময় চলতি গাড়ির সামনে ঝাঁপিয়ে পড়ে। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে হংসকন্যা ধ্বংস হয়ে যায়। আমাকে গ্রেপ্তার করা হয়। আজ ১৪ বছর পর এই সেতুর ওপর এসে আমার হংসকন্যাকে খুব বেশি মনে পড়ছে।

*লেখক: এম হৃদয়, সিঙ্গাপুর

**দূর পরবাসে লেখা, ভ্রমণ, গল্প পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল অ্যাড্রেস [email protected]