চলো হাঁটি-৩

অলংকরণ: মাসুক হেলাল

বিকেল বেলা। কোহিনূর নামের মেয়েটি আমার টেবিলে বসে আছে। হাতে একটি বই আছে। বইটির নাম ‘বাদশাহ নামদার’। কোহিনূর বইটির পাতা ওল্টাচ্ছে। পেছন থেকে আমি দেখছি মেয়েটির লম্বা চুলগুলো। আহা! কত সুন্দর চুল! মেয়েদের সৌন্দর্য অর্ধেক বাড়িয়ে দেয় তাদের লম্বা চুল। এই জন্য কবি জীবনানন্দ লিখেছেন, ‘চুল তার কবেকার অন্ধকার বিদিশার নিশা, মুখ তার শ্রাবস্তীর কারুকার্য; অতিদূর সমুদ্রের’পর হাল ভেঙে যে নাবিক হারায়েছে দিশা...’

আহা কী কথা! এই কবি কেন বনলতাকে পাইল না।
কোহিনূর আমাকে দেখে দাঁড়াল। আমি বললাম, ‘আরে কোহিনূর বেগম, দাঁড়াতে হবে না। আপনি বসেন।’
‘আপনি আমাকে আপনি করে বলেন কেন?’
‘তুমি বলাটা একটু কঠিন, তাই আপনি বলাটা আমি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করি।’
‘না, তুমি বলবেন।’
‘আচ্ছা, ঠিক আছে, সেটা পড়ে দেখা যাবে।’
‘আরেকটা সমস্যা আছে?’
‘আরে, কী বলেন, সমস্যাও আছে?’
‘আপনি আমাকে কোহিনূর বেগম বলবেন না। শুধু কোহিনূর বলবেন।’
‘ও আচ্ছা।’
‘শুধু কোহিনূর। ডোন্ট কল বেগম।’
‘আপনি কি রেগে যাচ্ছেন?’
‘কিছুটা।’
‘ও মাই গড, তাই তো আগের চেয়ে একটু বেশি সুন্দর লাগছে আপনাকে।’

কোহিনূর আমার কথা শুনে হেসে দিল। আর সঙ্গে সঙ্গে আমার ভেতরে একটা মোচড় দিল। সে কী! একেবারে আলোর হাসির কপি। যে হাসি দেখলে আমি অবাক হয়ে যাই। যে হাসির জন্য আমি মাঝেমধ্যে আলোকে কল করি। যে হাসির জন্য আলো ছাড়া আমি অন্য কাউকে ভাবতে পারি না। আমি কোহিনূরকে কিছু না বলে ঘর থেকে বেরিয়ে আসি। আজকে আর থামা যাবে না। আজকে আর বাসায় ফেরা যাবে না। সোজা রাস্তায় চলে আসি। আমাকে হাঁটতে হবে। পেছন থেকে শেলী ডাক দিল। সোম ভাইয়া, আমি দাঁড়ালাম না। হাঁটার গতি বাড়িয়ে দিলাম। সামনে ফুফাকে পেলাম। ফুফা বললেন, ‘সোম, বাবা এত তাড়াহুড়ো করে কোথাও যাচ্ছ।’
‘এই তো ফুফা, একটু বাজারে যাব।’
‘আচ্ছা, তাড়াতাড়ি চলে এসো। কথা আছে।’
‘আচ্ছা, ঠিক আছে চলে আসব।’

আজকে হাঁটতে বেশ ভালো লাগছে। সঙ্গে কেউ থাকলে ভালো লাগত। আচ্ছা, আলো তো বলে ঢাকাতে যাওয়ার জন্য। সে আমাকে সময় দেবে। দূর থেকে বহু দূরে চলে যাবে আমাকে সঙ্গে পেলে। আচ্ছা আমি যে হুট করে চলে আসলাম, কোহিনূর বেগম কী ভাববে। নাহ, মেয়েটি আমাদের বাড়িতে বেড়াতে এসেছে, তাকে কষ্ট দেওয়া যাবে না। আমি বরং কিছুটা সময় হেঁটে বাড়িতে চলে যাই।

দূর পরবাস-এ জীবনের গল্প, নানা আয়োজনের খবর, ভিডিও, ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]

রাস্তার মধ্যে একটি ব্রিজের ওপর দিয়ে হাঁটছি। এক বৃদ্ধ মুরব্বি একটি কলাভর্তি ভ্যান নিয়ে ব্রিজে ওঠার চেষ্টা করছেন, কিন্তু পারছেন না। আমি লোকটাকে হেল্প করতে পারি। একটু ধাক্কা দিলেই গাড়িটা উঠে যাবে, কিন্তু দিচ্ছি না। কারণ, মুরব্বি মানুষ অতটা ভালো হয় না। কিন্তু এই লোকটাকে দেখে মনে হচ্ছে, তিনি অন্যদের মতো নন। তাই ইচ্ছা না থাকা সত্ত্বেও আমি ধাক্কা দিয়ে লোকটাকে উঠিয়ে দিলাম। লোকটা আমাকে ধন্যবাদ দিয়ে বললেন, ‘বাজান, আপনারে আল্লাহ ভালা করব।’

‘বাহ! এই মুরব্বি কত সুন্দর করে কথা বলেন।’ আমি ভাবছি। ঠিক এই মুহূর্তে পেছনে আরেকটা ভ্যান চলে আসে। তিনিও কলার গাড়ি নিয়ে আসেন। আর বলেন, ‘ওই মিয়া, বিরিজের মইদ্যে খাড়াইয়া লইছ ক্যা?’

মুরব্বি চাচা দ্রুত ভ্যান নিয়ে চলে গেলেন। পেছনের ভ্যানেরও একই অবস্থা। গাড়ি ওঠাতে পারছেন না। তিনিও মুরব্বি। আমি তাঁকে হেল্প করতে চাচ্ছি না। কিন্তু মুরব্বি বলছেন, ‘আফনার লাগি আমার সমস্যা হয়ছে। অহন আফনি আমাকে ধাক্কা দিতে অইব।’

আমি মুরব্বিকে ধাক্কা দিলাম না। হেঁটে চলে যাচ্ছি। মুরব্বি নিরুপায় হয়ে নিজে থেকে গাড়ি টান দিয়ে ব্রিজের ওপর তুলতে গিয়ে গাড়ি কন্ট্রোল করতে ব্যর্থ হন। ফলে ভ্যান পেছনে আসতে আসতে রাস্তার নামাতে পড়ে যায়। লেও ঠেলা। মুরব্বি চিতপটাং শুয়ে আছেন। আশপাশের মানুষজন ছুটে আসেন। বেশ কয়েকটি গাড়ি থামিয়ে লোকজন মুরব্বিকে টেনে তোলেন। মুরব্বি উঁচু গলায় আমাকে দেখিয়ে বলেন, ‘এই ছেরাডার লাইগা আমার আইজ্জা এই দশা।’

আমি অবাক হওয়ার সর্বোচ্চ আসনে পোঁছে যাই। ঘটনা ঘটে আমাদের গ্রামের পেছনে। ফলে কয়েকজন আমাকে চিনতে পারেন। তা না হলে আজকে মুরব্বির কথামতে, পাবলিক আমাকে গণধোলাই দিতেন। একজন আমাকে বলেন, ‘ভাই, আপনি কাজটা ঠিক করলেন না কিন্তু!’

‘আরে ভাই, আমি কী করেছি, এই মুরব্বি বলছেন আমাকে ধাক্কা দেওয়ার জন্য, আমি ধাক্কা দিইনি, এটা কি আমার অপরাধ?’

আরেকজন বলেন, ‘একটু ধাক্কা দিতেন, তাহলেই তো এই মুরব্বির চাচার এত বড় ক্ষতি হতো না।’

লোকজন বেশি হওয়াতে সুবিধা হয়েছে বটে। সবাই ধরাধরি করে মুরব্বির ভ্যান গাড়িটা রাস্তায় তুলে এনেছেন। কলার ছড়িগুলো কিছুটা তুলেছেন। পাকা কলাগুলো অনেকে নিয়ে যাচ্ছেন। কেউ কেউ খাচ্ছেনও। বিশেষ করে ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা খাচ্ছে। মুরব্বি কান্না করে বলছেন, ‘আমি অহন মালিকরে কী জবাব দিয়াম। আফনারা কন?’
‘আপনার মালিকে আপনাকে চুমা দেবে, আপনি যান।’

ঠিক তখন মুরুব্বি হাউমাউ করে কেঁদে সবাইকে বলেন, ‘দেখছেন ভাইসব, হে অহনেও কেমনে কথা কয়। আমার দিকে কেমন করে তাকায়।’

এই কথাটা বলে বোধ হয় ভুল করে ফেললাম। এখন পাবলিক উল্টে যাচ্ছে। পকেটে দুই হাজার টাকা ছিল। সেটা আলোচনার মাধ্যমে মুরব্বিকে দিয়ে এখান থেকে সরে আসি।
বাড়িতে আসার আগেই বাড়ির সবাই জেনে গেছে ঘটনা। মা বলছে, ‘সোম, এটা কী শুনলাম?’

‘কী শুনেছ, বলো?’
‘তুই নাকি ভ্যান গাড়িকে ধাক্কা দিয়ে রাস্তার নিচে ফেলে দিয়েছিস।’
মায়ের কথা শুনে বোকা হয়ে গেলাম। মা এটা কী বলল। হয়েছে কী, মা শুনল কী! মনে পড়ে গেল একটা ঘটনা, এক রাজার ঘরে কালো সন্তান হয়েছে। এটা নিয়ে লোকজন অনেক কথা বলাবলি করছে। একজন বলল, ‘রাজার কালো সন্তান হয়েছে।’ যে শুনেছে, সে আরেকজনকে বলল, ‘রাজার কালো চিকচিক করে এমন এক সন্তান হয়েছে।’ সে আবার আরেকজনকে বলল, ‘রাজার ঘরে কাউয়া হয়েছে।’ এটা ভেবে আমি হেসে উঠলাম। ঠিক তখন মা বলল, ‘কি রে, তুই হাসছিস! একটা বাবার বয়সী লোককে বিপদে ফেলে তুই হাসছিস! ছিঃ ছিঃ ছিঃ...
‘মা, তুমি যা শুনেছ, এটা সত্য নয়। সত্যটা হলো...’
‘সত্যটা হলো ভাইয়া মাইর খাওয়া থেকে বেঁচে ফিরেছে।’

পেছন থেকে শেলী এসে এই কথা বলে। কোহিনূর মিট মিট করে হাঁসছে। আমি ভেবাচেকা হয়ে দাঁড়িয়ে আছি। সত্যটা আর বোঝাতে পারলাম না। মায়ের বকা খেয়ে চলে আসি। সব শেলীর জন্য। সে এসে এত কথা বলে, যেখানে আমার কথার কোনো পাত্তাই ছিল না।

ফুফা, শেলী, কোহিনূর, মা ডাইনিং টেবিলে বসে আছে। ডিনার করতে আমিও আসলাম। ফুফা বললেন, ‘তা কী ব্যাপার ইয়াং ম্যান, তুমি নাকি ভ্যান গাড়িওয়ালাকে মেরেছ?’

ফুফার কথা শুনে একটু খারাপ লাগল। কিন্তু নিজেকে সংযত করার চেষ্টা করি। ইচ্ছা হচ্ছিল টেবিল থেকে উঠে চলে যাই। তাহলে বিষয়টা আরও বেশি খারাপ দেখাবে। আমি বললাম, ‘আসলে ফুফা আপনি যেটা বলছেন, সেটা ঠিক নয়। আমি আসলে এমন কিছু করিনি।’

শেলী বলল, ‘না বাবা, তুমি যেটা শুনেছ, এটা মিথ্যা শুনেছ। আসল বিষয়টা হলো...।’
‘থাক, এই বিষয় আর কিছু শোনার দরকার নেই। আগে রাতের খাবার খেয়ে নাও। পড়ে কথা হবে।’

যা–ই হোক, ফুফাকে ধন্যবাদ। অন্তত এই বিষয়ে কথাটা স্টপ করার জন্য। খাবার শেষে আমি চলে আসি আমার রুমে। বাহ! রুমটা দেখতে বেশ ভালো লাগছে। খুব সুন্দরভাবে সবকিছু গোছানো আছে। টেবিলের ওপরে ফুলদানির ফুলগুলো কত সুন্দর দেখাচ্ছে। আমার বিছানাটাও বেশ গোছানো। আচ্ছা, এত সুন্দর করে আমার কক্ষটাকে কে সাজাল। কে হতে পারে?

যা–ই হোক, একটু বিশ্রাম নিই। এই ভেবে খাটের ওপর শুয়ে পড়ি। ঠিক তখন দরজায় টক টক শব্দ। বললাম, ‘চলে আসুন।’
শেলী এল। একি! শেলী শাড়ি পরেছে! কী দারুণ দেখাচ্ছে শেলীকে। নীল শাড়ি পরেছে। কানে লম্বা দুল, গলায় নেকলেস। এককথায় অসাধারণ। আমি কী দেখছি, বুঝতে পারছি না। শেলী এত সুন্দর!

শেলী বলে, ‘এই মিয়া, কী দেখছ?’
আমি রীতিমতো অবাক। শেলীর কথা, অঙ্গভঙ্গিতে আমি বিস্মিত।
‘এই শেলী, তুই এমন করছিস কেন?’
‘কেন, আমাকে কি খারাপ লাগছে?’
‘আমার বোনকে কি কখনো খারাপ লাগতে পারে।’
‘দেখো সোম, আরেকবার যদি আমাকে বোন বলেছ, তাহলে তোমার খবর আছে।’
শেলী রাগান্বিত হয়ে চোখ বড় বড় করে আমার অতি নিকটে এসে আস্তে করে বলল। আমি হেসে উঠে বললাম, ‘বাহ! তুই তো দেখি রাগও করতে পারিস। তা এত রাতে শাড়ি পরার কারণ কী?’

‘কেন, আমাকে কি খারাপ লাগছে?’
‘না, তা লাগবে কেন। তা ছাড়া তোর মতো এত সুন্দরী মেয়ে আছে নাকি এই এলাকায়।’
‘শোনো, আজকে রাতে আমি তোমার সাথে থাকব। তুমি আমাকে মন ভরে আদর করবে।’

হঠাৎ করে শেলী আমার দিকে নজর দেওয়ার কারণ কী? যে মেয়ের কিছুদিন পর বিয়ে, সে আমার সঙ্গে এমন করছে কেন? হায় আল্লাহ! তুমি রক্ষা করো।
‘এই যে সোম সাহেব, তুমি কী ভাবছ, তা আমি জানি না। কিন্তু আমি যা বলছি, তা–ই হবে। তা না হলে এখন আমি শাড়ি খুলে সবাইকে ডেকে নিয়ে আসব। তারপর কী হবে, সেটা তো বুঝতেই পারছ।’

আমি চুপ। এমন সিচুয়েশনে নিজেকে উত্তেজিত করা যাবে না। তাহলে হিতে বিপরীত হবে। ইচ্ছা তো করছে এখনই ওর গালে কয়েকটা চড় বসিয়ে দিই। কিন্তু এটা এখন করা যাবে না।

‘শোনো, আজকে রাত হবে তোমার আর আমার রাত। আমি ঠিক রাত ১২টা বাজে তোমার রুমে চলে আসব। তুমি দরজা খুলে রাখবে। তা না হলে আমি যে কী করবে, তা তোমার ধারণার বাইরে।’

এই কথা বলে শেলী শাড়ির আঁচলটা সরিয়ে আমার কাছে এসে চুলে হাত দিয়ে কানের কাছে মুখ নিয়ে আবারও বলে, ‘মনে রেখো, আজকের রাত শুধু তোমার আর আমার রাত। গুড নাইট।’

শেলী চলে গেল, ঘড়িতে ১০টা বাজতেছে। আজকে আর রুমে থাকা ঠিক হবে না। আমার বাড়ি, আমার ঘর, আমাকে কিনা এখন মেহমানের ভয়ে বাইরে থাকতে হবে। কিন্তু আমার কাছে বিষয়টা অন্য রকম কিছু মনে হচ্ছে। আমি বাইরে যাব না। কারণ, এখানে অন্য কিছু হতে পারে। জাস্ট অপেক্ষা করে দেখতে হবে। রাত ১২টা বেজে গেছে। আমি আমার রুমের বাইরে জানালার পাশে দাঁড়িয়ে আছি। জানালার পাল্লাটা আগে থেকে একটু খুলে রেখেছিলাম। শুধু কী হয়, তা দেখার জন্য।

১২টা ৫ বাজে, শেলী তো আসছে না। হঠাৎ দরজার শব্দটা কানে আসে। হুম যে কথা সেই কাজ। শেলী চলে এসেছে। নিজের শরীরে একটা ভয় কাজ করছে। শেলী আমার ফুফাতো বোন। তাকে কতটা ভালোবাসি। সে কিনা আমার সাথে...ছিঃ...।

রুম ফাঁকা। ওমা এ কী দেখছি! এ তো শেলী নয়। কোহিনূর এসেছে। সেম শাড়ি পরেছে সে। তবে তাকে দেখতে অনেক সুন্দর লাগছে। দেখি, সে করে কী? আমি জানতাম, ঘটনার পেছনে ঘটনা আছে। তার মানে কোহিনূর আর শেলী মিলে আমার সঙ্গে মজা করছে। আমি এখন শুধু অপেক্ষা করছি, খালি রুমে কোহিনূর কী করে, সেটা দেখার। (চলবে)

  • এম হৃদয়, পিঞ্জুরু, সিঙ্গাপুর