বাংলাদেশের আর্থিক পরিস্থিতির অর্থনৈতিক দৃষ্টিকোণ

ছবিটি প্রতীকী।ফাইল ছবি: এএফপি

বাংলাদেশের অর্থমন্ত্রী সম্প্রতি ৪ দশমিক ৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ঋণসহ একটি সংমিশ্রণ প্যাকেজ চেয়ে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল আইএমএফকে চিঠি লিখেছেন। অনেকেই মনে করছেন, দেশের চরম আর্থিক দুর্দশার কারণে তিনি এমনটা করেছেন। কিন্তু যদি সঠিকভাবে বিশ্লেষণ করা হয় তবে আইএমএফের দ্বারস্থ হওয়ার পেছনে অনেকগুলো যুক্তি রয়েছে। সহজ–সরলভাবে আমরা যদি ধরে নিই বাংলাদেশও পতনের দোরগোড়ায় পৌঁছে গেছে, তবে ভুল হবে। কলম্বোর টাটকা স্মৃতি আমাদের সেদিকে ধাবিত করায় অনেকেই তুলনামূলক আলোচনা থেকে বিপদের ঘণ্টাধ্বনি নাকি শুনতেও পাচ্ছেন। কিন্তু বাংলাদেশের বর্তমান মাথাপিছু আয় এবং প্রবৃদ্ধির হার তার প্রতিবেশীদের তুলনায় বেশি হওয়ায় এখনই আঁতকে ওঠার সময় হয়নি বলে অর্থনীতিবিদেরা মনে করেন।

প্রতিবেশীদের মধ্যে বাংলাদেশ সম্ভবত ভারতের সবচেয়ে কাছের এবং সবচেয়ে মূল্যবান বন্ধু। উভয়েই একে অন্যের উন্নয়নের অংশীদার। দুই দেশেরই আর্থিক পরিস্থিতি এখনো স্থিতিশীল। তবে বাংলাদেশ নিয়ে উদ্বেগের কারণ হলো এই উপমহাদেশের তৃতীয় দেশ হিসেবে তারা আইএমএফের কাছে ঋণ চেয়েছে। শ্রীলঙ্কা ও পাকিস্তানের পর এখন বাংলাদেশ, এমন সরলীকরণ প্রচারণা শুরু করেছেন কেউ কেউ। বাংলাদেশ একটি তরুণ দেশ। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পশ্চিম পাকিস্তানের হাত থেকে দেশটি স্বাধীনতা লাভ করে। বর্তমানে দেশে একটি কার্যকরী গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত রয়েছে। এখানকার গণমাধ্যম স্বাধীন এবং তারা মুক্তভাবে নিজেদের মত প্রকাশ করতে পারে। তাই অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল আইএমএফের পরিচালক ক্রিস্টালিনা জর্জিভার কাছে প্যাকেজ চাওয়ার বিষয়টি নিয়ে ব্যাপক চর্চা শুরু হয়েছে। কিন্তু মনে রাখতে হবে, বর্তমানে বাংলাদেশের দ্রুতবর্ধনশীল অর্থনীতির কথা। বর্তমানে মোট দেশজ উৎপাদন বা জিডিপির বহর ৪১৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার।

আইএমএফের কাছে চাওয়া প্যাকেজে স্থিতিস্থাপকতা এবং টেকসই–সুবিধা অন্তর্ভুক্ত করা রয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে প্রথম সারিতে থাকা স্বল্পোন্নত দেশগুলোর জন্য আইএমএফের কিছু বিশেষ পদক্ষেপ রয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে লড়াই করছে বাংলাদেশ। এখানকার প্রচুর নিচু জমি বন্যার কারণে প্রতিবছর বিরূপভাবে প্রভাবিত হয় এবং বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের নেতিবাচক প্রভাবের শিকার হই আমরা। জলবায়ু পরিবর্তনে খুব বেশি প্রভাবিত দেশগুলোর তাদের দুর্বল অবস্থান থেকে স্থিতিস্থাপকতা এবং প্রশমন তহবিল স্থাপনের জন্য আইএমএফের নির্দিষ্ট প্রকল্পও রয়েছে। তাই তাদের কাছ থেকে সাহায্য চাওয়াটাই স্বাভাবিক।

ফাইল ছবি: রয়টার্স

অনুমান করা হচ্ছে, এই তহবিল থেকে ১ থেকে ১ দশমিক ৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার পর্যন্ত কার্যকরভাবে সুদমুক্ত অর্থ পাওয়া যেতে পারে। এ ছাড়া বাংলাদেশ প্রথমত বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বাড়াতে এবং দ্বিতীয়ত আর্থিক দৃষ্টিকোণ থেকে টেকসই ও সহায়ক অর্থনীতির স্বার্থে ৩ থেকে ৩ দশমিক ৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের একটি প্যাকেজ চাইছে। আসলে কোভিড-১৯ মহামারি এবং ইউক্রেন–রাশিয়া যুদ্ধের ফলে তৈরি হওয়া বৈশ্বিক পরিস্থিতি মোকাবিলার অর্থনৈতিক ভিত্তিকে আরও মজবুত করতে চাইছে বাংলাদেশ। গত বছরের ৪৫ দশমিক ৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের তুলনায় এ বছর বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ প্রায় ৩৯ দশমিক ৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে নেমে এসেছে। জিডিপির শতাংশের সঙ্গে তুলনা করা হলে এটি চিন্তার। কিন্তু বিশ্বব্যাপী বর্তমান পরিস্থিতির কারণে মোটেই বিপর্যয়কর নয়।

জ্বালানি আমদানি এবং মুদ্রাস্ফীতি এখনো ঊর্ধ্বমুখী গতিপথে চলছে। তাই ভারসাম্যমূলক পদক্ষেপের দরকার ছিল। বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় রপ্তানি হলো তৈরি পোশাক। কিন্তু এখানেও সমস্যা দেখা দিয়েছে। কারণ, চেইন স্টোর ওয়ালমার্ট, এইচঅ্যান্ডএমের মতো কোম্পানিগুলোও মুদ্রাস্ফীতির কবলে পড়েছে। সরকারের বৈদেশিক মুদ্রালাভের আরেকটি বড় রাস্তা হলো মধ্যপ্রাচ্য থেকে আসা প্রবাসীদের রেমিট্যান্স। সেখানেও সমস্যা বাড়িয়েছে কোভিড মহামারি। তাই বিদেশি মুদ্রার মজুত কমার বিষয়টি বেশ যৌক্তিক। বাংলাদেশ এখন সক্রিয়ভাবে কৃষি ও ভোগ্যপণ্য খাতে রপ্তানিতে বৈচিত্র্য আনার চেষ্টা করছে। ফুটবল বিশ্বকাপের মতো বিশাল অবকাঠামোগত শ্রমঘন প্রকল্প আশার আলো দেখাচ্ছে। এখনো বাংলাদেশের সাড়ে পাঁচ মাস পর্যন্ত আমদানি বিল মেটানোর জন্য পর্যাপ্ত অর্থ রয়েছে। তুলনায় পাঁচ সপ্তাহের আমদানি বিল মেটাতে পাকিস্তানের রয়েছে মাত্র ৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। তাই বাংলাদেশের পরিস্থিতি পাকিস্তানের মতো অনিশ্চিত নয়। শ্রীলঙ্কার চেয়ে অনেক ভালো।

ফাইল ছবি

শ্রীলঙ্কার মুদ্রাস্ফীতির হার ৬০ শতাংশেরও বেশি এবং পাকিস্তানেরও প্রায় ২৫ শতাংশ। সেখানে বাংলাদেশে মুদ্রাস্ফীতি ৭ দশমিক ৫ শতাংশ। তা–ও গম বা অন্যান্য খাদ্যশস্য এর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি বলেই এত বেশি মনে হচ্ছে বলে সমালোচকেরা মনে করেন। তবে বেশির ভাগ মুদ্রার মতোই বাংলাদেশি টাকারও ডলারের বিপরীতে অবমূল্যায়ন হয়েছে। গত ১১ মাসে টাকার দাম প্রায় ১০ টাকা কমেছে। বর্তমানে ৯৪ টাকায় লেনদেন হচ্ছে। তবে সেটিও পাকিস্তানি রুপি বা শ্রীলঙ্কার তুনলায় অনেকটাই স্থিতিশীল। পাকিস্তানি রুপি এখন ডলারপ্রতি ২৩৫ এবং শ্রীলঙ্কার ৩৬৫। তাই এই দুই দেশের তুলনায় টাকা এখনো অনেক শক্তিশালী। বাংলাদেশের অর্থনীতিকে তাই মোটেই দেউলিয়া বলা চলে না। তবে জিডিপির প্রায় ১ দশমিক ৫ শতাংশ ঘাটতি বৃদ্ধি পাচ্ছে।
বাণিজ্য ব্যবধান বেড়েছে। ৮১ দশমিক ৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার আমদানির বিপরীতে রপ্তানি হয়েছে ৬৪ দশমিক ৩ বিলিয়ন। ১৭ দশমিক ২ বিলিয়ন ডলার বাণিজ্যঘাটতি। গত বছরের তুলনায় ঘাটতি ২ দশমিক ৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। কোভিড মহামারি কারণে অর্থনৈতিক কার্যকলাপ কম থাকার প্রভাব পড়েছে। এই সংকটময় পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের অন্যান্য ঋণের প্রসঙ্গও আলোচনায় উঠে আসছে। চলমান অবকাঠামো প্রকল্পগুলোতে সহজ ঋণের পরিমাণ ১০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। রূপপুরে পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প নির্মাণের জন্য রাশিয়ান ফেডারেশন থেকে প্রায় ২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ঋণ নেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া অন্যান্য বড় ঋণের মধ্যে রয়েছে ঢাকায় প্রথম মেট্রোরেল নির্মাণের জন্য প্রায় ২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক থেকে ২ দশমিক ৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার প্রভৃতি।

পরিস্থিতি মোকাবিলায় বাংলাদেশ অতিরিক্ত সতর্কতা অবলম্বন করছে। বিভিন্ন খাতে সরকারি খরচ কমানো হয়েছে। তাই এখনই দেশ সংকটে পড়েছে, বলার সময় হয়নি। বরং জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধি থেকে শুরু করে সম্ভাব্য প্রতিকূল পরিস্থিতি মোকাবিলা করার জন্য নেওয়া হয়েছে একটি উপযুক্ত কৌশল। সেপ্টেম্বরে আইএমএফ সফর–পরবর্তী পদক্ষেপের বিষয়ে পরামর্শ পেতে সহায়ক হবে। সরকার ইতিমধ্যেই কার্যকরভাবে আমদানি বিল রোধ করতে ডিজেলচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ করার কঠোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। মনে রাখতে হবে, বাংলাদেশেও যথেষ্ট পরিমাণে প্রাকৃতিক গ্যাস রয়েছে। দেশের জ্বালানি চাহিদা মেটাতে প্রতিবেশী দেশ ভারত থেকে ডিজেল ও বিদ্যুৎ সহজেই আনা যেতে পারে।

কঠিন পরিস্থিতিতেও শ্রীলঙ্কার চরম আর্থিক সংকটে ২৫০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার ‘লাইন অব ক্রেডিট’ দিয়ে তাদের দুর্দিনে পাশে দাঁড়ানোর মানসিকতা দেখিয়েছে বাংলাদেশ। সব প্রতিকূলতার সঙ্গে লড়াই করে আমরা এক কঠিন সময়ের মুখোমুখি। তবে শ্রীলঙ্কার মতো বিপর্যয় বা পাকিস্তানের মতো বিদেশি সাহায্যের জন্য চাতক পাখির মতো আন্তর্জাতিক দুনিয়ার দিকে তাকিয়ে নেই আমরা। সঠিক সিদ্ধান্ত আর দক্ষ নেতৃত্ব দেশকে কঠিন লড়াইয়ের জন্য প্রস্তুত রেখেছে।

  • প্রিয়জিৎ দেবসরকার : লেখক ও গবেষক, যুক্তরাজ্য