ঈদুল ফিতরের স্মৃতি

ঈদুল ফিতর

স্মৃতি সতত মধুর। ছেলেবেলার ঈদের কথা মনে পড়লে সবাই স্মৃতিকাতর হন। অনেকেই বলেন, শৈশব-কৈশোরের ঈদের স্মৃতি তুলনাহীন। সময় ও যুগের পরিবর্তনের ফলে ষাট-সত্তরের দশকে আমাদের ছেলেবেলার ঈদ এবং এখন ডিভাইসের যুগে আমাদের সন্তানদের ঈদ উদ্‌যাপনে অনেক পার্থক্য রয়েছে। পবিত্র রমজান মাস শেষ হওয়ার পর সন্ধ্যায় ঈদের চাঁদ উঠলে ওই রাতকে ‘চানরাত’ বলা হতো। ঈদ উপলক্ষে চাঁদরাতে আমাদের পড়াশোনা করতে হতো না। সে কি আনন্দ—‘আজ আমাদের ছুটি ও ভাই, আজ আমাদের ছুটি।’ ঈদের চাঁদ দেখার পর্বটি শৈশব-কৈশোরে আমরা একটি উৎসবের মতো উদ্‌যাপন করেছি। শৈশবে আমার বাসায় টিভি ছিল না। বাসায় সাদা-কালো টিভি এসেছে আমার কৈশোরে। রেডিও, টিভিতে ঈদের চাঁদ দেখার সংবাদ ঘোষণা করা হতো। সন্ধ্যার আগে রেডিও ও টিভি দুটোই অন করে রেখেছি সংবাদ শোনার অপেক্ষায়। পশ্চিমাকাশে চাঁদ দেখা গেলে শিশু-কিশোরের দল যার যার বাসা থেকে হইহই শব্দে কোলাহলের ঢেউ তুলে মহল্লার রাস্তায় ও মাঠে চলে আসত। ছেলেরা বিভিন্ন রকমের বাজি-পটকা ফোটাত।

পবিত্র ঈদুল ফিতরের চাঁদ দেখা গেলে বড়রাও তাঁদের মতো করেই চাঁদ দেখার আনন্দ উপভোগ করতেন। চাঁদ দেখার পর বারান্দায় চেয়ারে বসে মা মোনাজাত করতেন। আমাকে বলতেন, ‘আয় আমার সঙ্গে মোনাজাত ধর।’ আব্বা হয়তো চাঁদ দেখার জন্যই বাসায় চলে আসতেন। যদিও এ কথা তিনি বলেননি কখনো। আব্বা আমাকে বলতেন, ‘আয় চাঁদ দেখি।’ এরপর তিনি দোনলা বন্দুক ও পিস্তল থেকে আকাশে গুলি ছুড়তেন। ঈদুল ফিতরে আমরা নতুন জামা-জুতা পেয়েছি। ঈদের আগে সবাই সবাইকে নতুন পোশাক দেখাতে অনাগ্রহী ছিল। বলত ঈদের আগে পোশাক দেখলে পুরোনো হয়ে যাবে। চাঁদরাতে আমরা অনেকেই হাতে মেহেদি দিয়েছি। মা আমাদের সঙ্গে হাতে মেহেদি দিতেন। আমরা বাঁ হাতের পাঁচ আঙুলে ও হাতের তালুতে গোল করে লেপটে দিয়েছি। ঈদ উপলক্ষে মেহেদি দিয়ে হাত রাঙানোটা ছিল ঈদে আনন্দের একটা অংশ। ঈদের দিন একে অপরের হাত কাছে টেনে নিয়ে দেখত, কার হাত কতটা গাঢ় রঙিন হলো। কেউ কেউ দুই হাতেও দিত। শেষ রোজার বিকেলে আমরা মেহেদিপাতা সংগ্রহের অভিযানে গিয়েছি। কারণ, তখন বাজারে মেহেদিগাছের পাতাসহ ডাল বিক্রির প্রচলন শুরু হয়নি। দেশে এখন মেহেদিপাতাসহ ডাল বিক্রি হয়। পারলারগুলো মেহেদির বিকল্প হিসেবে চায়ের পাতা থেকে রং তৈরি করে। এ ছাড়া বাজারে মেহেদির টিউব বা কুন পাওয়া যায়। মেহেদিপাতার রস থেকে যে রং তৈরি হয়, এই তথ্য এ যুগের সন্তানদের কাছে অজানা রয়ে গেল। তখন কাঠির সাহায্যে মেয়েরা হাতে মেহেদির আলপনা আঁকত।

শৈশবে দেখেছি, রোজার মাসের মাঝামাঝি সময়ে মা হাতের তালুর সাহায্য কাঠের তক্তার ওপর ঘষে সেমাই বানাতেন এবং দুই আঙুলের সাহায্যেও বানাতেন। বড়দা ও মেঝদাও মায়ের সঙ্গে বসে সেমাই বানিয়েছেন। বাসায় সেমাই বানানোর একটি মেশিন ছিল। মেশিনটি চৌকির কোনার বেশ শক্ত করে আটকে নেওয়া হতো। এরপর মেশিনের মুখে মা আটা বা ময়দার দো ভরে দিতেন। আমি মহা আনন্দের সঙ্গে মেশিনটির হাতল ঘুরিয়েছি। রাশি রাশি লম্বা সেমাই নেমে আসত মেশিনটির বহির্গমন ছিদ্রপথ দিয়ে। মা কুলায় নিয়ে ঘরে তৈরি সেই সব সেমাই রোদে শুকিয়ে রাখতেন। এ ছাড়া ঈদের আগে মহল্লার অনেকেই আসত সেমাই বানানোর মেশিনটি নেওয়ার জন্য।

চাঁদরাতটি ছিল আমার মায়ের নির্ঘুম রাত। মা সারা রাত জেগে লাকড়ির চুলায় ঈদের খাবার রান্না করতেন। ভোরে উঠেই আব্বা জাতীয় পতাকা বাঁশের কঞ্চিতে বেঁধে আমাকে বলতেন, ‘আয় বাঁশটা ধর।’ সকালে আমরা সবাই গোসল সেরে পোলাও, খিচুড়ি, সেমাই, জর্দা খেয়ে আব্বার সঙ্গে ঈদের নামাজ পড়তে গিয়েছি। স্বাধীনতার আগে আব্বার সঙ্গে মহল্লার মসজিদে ঈদের নামাজ পড়েছি। স্বাধীনতার পর থেকে আব্বাকে সঙ্গে নিয়ে ঈদগাহে গিয়ে ঈদের নামাজ পড়েছি। মহল্লার ক্লাবের উদ্যোগে ঈদের আগের রাতে রঙিন কাগজের ঝালর বানিয়ে রশির মাধ্যমে মহল্লার রাস্তায় ঝুলিয়ে দিত। সম্পূর্ণ ক্লাবও রঙিন কাগজের ঝালরে সাজানো হতো। ঈদের নামাজের কোলাকুলি পর্ব শেষে ‘ঈদ মোবারক’লেখা চতুষ্কোণ প্রিন্টের ছোট্ট কাগজ আলপিন দিয়ে পাঞ্জাবিতে আটকে দেওয়া হতো। আরেকজনের হাতে ছোট্ট বাক্স বা কৌটা থাকত অর্থ সংগ্রহের জন্য। স্বাধীনতার পর ফজর নামাজের পরপরই মসজিদ পরিষ্কার করেছি ঈদের নামাজের জন্য। নামাজের জন্য মসজিদের ছাদে ও রাস্তায় হোগলা বিছিয়ে দিয়েছি। নামাজ শেষ হলে রাস্তা থেকে হোগলা টেনে মসজিদে নিয়ে গুছিয়ে রাখতে হতো।

ঈদে নতুন টাকা
প্রথম আলো ফাইল ছবি

নামাজ শেষে বাসায় এসে পায়জামা-পাঞ্জাবির পরিবর্তে ঈদের নতুন জামা গায়ে দিয়েছি। এরপর শুরু হতো ঈদের সালাম পর্ব। পা স্পর্শ করে সালাম করার ব্যাপারে আব্বা বাধা দিতেন। আব্বা বলতেন, হাত তুলে সালাম ও হ্যান্ডশেক করলেই যথেষ্ট। কারণ, পা ছুঁয়ে সালাম করতে গেলে অসাবধানতাবশত মাথা নিচু হয়ে যায়। আল্লাহ ব্যতীত কারও কাছে মাথা নিচু করা যায় না। আমরা তখন সর্বসাকল্যে এক টাকা বা দুই টাকা ঈদসালামি পেতাম। প্রাইমারি স্কুলে যাওয়ার সময় আব্বা রোজ এক আনা দিতেন। সেখানে ঈদে এক টাকা বা দুই টাকা তো বিরাট ব্যাপার। নর্থ আমেরিকায় শিশুদের মধ্যে ঈদসালামি পর্বের রেওয়াজটি আজও জনপ্রিয়তা পায়নি। এ যুগে প্রবাসী শিশুরা এই আনন্দ থেকে বঞ্চিত। এখন দেশে ঈদসালামি শব্দের পরিবর্তে ঈদি শব্দের প্রচলন শুরু হয়েছে। ঢাকায় থাকার সময় আমার ছেলে-মেয়ে ওর কাজিনদের সঙ্গে দলবদ্ধ হয়ে ঈদি সংগ্রহ পর্বটি অত্যন্ত আনন্দের সঙ্গে উপভোগ করেছে। মেয়ে এখন চাকরিজীবী হয়েও আজও ঈদের সকালে বলে, ‘বাবা, আমার ঈদি কই? আমার ঈদি দাও।’

ঈদের নামাজের পর ঈদগাহে আব্বার সঙ্গে কোলাকুলি করি প্রতিবছর। বৎসরে দুই ঈদেই শুধু দুবার আব্বার সঙ্গে কোলাকুলি করেছি, এর বেশি নয়। এখন আমার ছেলে সব সময়ই হাগ দেওয়ার জন্য উন্মুখ হয়ে থাকে। সে তার মায়ের কাছে গিয়ে বলে, ‘মা হাগ দাও।’ আমাকেও বলে। ঈদের নামাজ শেষে বাসায় আসার পর মেয়ে আমাকে জিজ্ঞেস করে, ‘মাকে হাগ দিয়েছ?’ আত্মজ শৈশবে ঢাকায় যাওয়ার পর হাগ বিষণ্নতায় ভুগেছে। ঢাকা থেকে টরেন্টো ফিরে আসার পর আমাকে বলল, ‘বাবা, ঢাকায় তো কেউ হাগ দেয় না।’ বললাম, ‘দেখ, দেশের মানুষ শুধু ঈদের সময়েই হাগ করে। অন্য সময়ে হাগ করে না। আমাদের দেশে এই হাগের প্রচলন গড়ে ওঠেনি। এরপর রয়েছে ধর্মীয় অনুশাসন।

ঈদসালামি পর্বের পর মেহমান ও আত্মীয়রা বাসায় এলে তাঁদের আপ্যায়নে ব্যস্ত থাকতে হয়েছে। দুপুরের পর বেড়াতে গিয়েছি। কৈশোরে বন্ধুদের বাসায় না গেলে মনে হয়েছে ঈদটাই অসম্পূর্ণ রয়ে গেল। অধীর আগ্রহে অপেক্ষায় রয়েছি, কখন সন্ধ্যা হবে? সন্ধ্যার পর মহানন্দে বসেছি বিটিভির সামনে। দেখেছি ঈদের নাটক, আনন্দমেলা, সপ্তবর্ণা ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান এবং আমজাদ হোসেনের নাটক ‘রোকন, দুলাল, জবা, কুসুমের মাকে’। আমাদের সময় রাতে বিটিভিতে সাদা-কালো অনুষ্ঠানগুলো ছিল ঈদ উৎসবেরই একটি অংশ। সন্ধ্যার পর শতবার বলেছি, আল্লাহ টিভি অনুষ্ঠান চলার সময়ে মেহমান যেন না আসে!

‘ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এল খুশীর ঈদ’—ঈদুল ফিতর উপলক্ষে কবি কাজী নজরুল ইসলাম রচিত কালজয়ী গান। এটি আজ বাংলাদেশে ঈদ উৎসবের আবশ্যকীয় অংশ। শিল্পী আব্বাসউদ্দীন আহ্‌মদের অনুরোধে ১৯৩১ সালে কবি কাজী নজরুল ইসলাম গানটি রচনা ও সুরারোপ করেন।

 *লেখক: কামাল উদ্দিন, টরেন্টো, কানাডা

দূর পরবাসে ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল অ্যাড্রেস [email protected]