বাংলার বৈশাখ ও পারস্যের নওরোজ—ঋতুর মাধুরীতে বাঁধা দুই উৎসব
নতুন বছরের প্রথম প্রহর আমাদের ডাকে নতুন এক দিগন্তের দিকে। ঋতুর পরিবর্তনের মতোই মানুষের জীবনেও নববর্ষ নিয়ে আসে নতুন আশা, নতুন স্বপ্ন, নতুন প্রতিজ্ঞা নতুন বছরের নতুন বন্দোবস্ত নতুন করে নিজেকে পরিবর্তন। পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে মানুষ তাঁর নিজ নিজ ট্র্যাডিশনের আলোকেই বছরের প্রথম দিন নববর্ষকে উদ্যাপন করে। বাঙালির পয়লা বৈশাখ আর পারস্যের নওরোজ—এই দুটি উৎসব সবচেয়ে প্রাচীন উদাহরণ। উৎসব দুটি ভিন্ন দুদেশের ভিন্ন মাটিতে জন্মালেও নিয়ে আসে একই আনন্দের আবহ।
পয়লা বৈশাখ বাংলার আবহমান গ্রামীণ জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। খোলা আকাশের নিচে মাটির সোঁদা গন্ধ, লাল-সাদা ও রংবেরঙের পাঞ্জাবি-শাড়িতে সজ্জিত হয় মানুষ। ঢাকের বাদ্যে মুখর হয়ে ওঠে নববর্ষী প্রভাত—সব মিলিয়ে বৈশাখের প্রথম দিনটি হয়ে ওঠে সর্বজনীন আনন্দমুখর। বছরজুড়ে হালখাতার পুরোনো সব হিসাব চুকিয়ে নতুন দিনের পথচলা, পান্তা-ইলিশের ঐতিহ্য—এসবকিছুই পয়লা বৈশাখকে স্বতন্ত্র এক রূপ দিয়েছে।
অন্যদিকে, নওরোজ আসে বসন্তের স্নিগ্ধ বাতাসে। পারস্য সভ্যতার হাজার বছরের ঐতিহ্যে লালিত হয় এই উৎসব। এই দিনে দস্তরখান সাজানো হয় হাফত-সিন নামক পরিচিত বিশেষ এক খাবার দিয়ে, যেখানে থাকে সাতটি প্রতীকী বস্তু—সবজি, আপেল, রসুন, সুগন্ধি, মুদ্রা, আয়না ও মোমবাতি। আগুনের কুণ্ডলীর ওপর লাফ দিয়ে পার হওয়া নওরোজের ঐতিহ্যবাহী একটি রীতি ও এটি এই উৎসবেরও মহান অংশ।
পয়লা বৈশাখ ও নওরোজ দুটি দিবসের সংস্কৃতিক গভীরে গেলে দেখা যায় উভয় উৎসবই প্রকৃতির পরিবর্তনের সঙ্গে জড়িয়ে আছে। নওরোজ যেমন বসন্তের সূচনা নিয়ে হাজির হয়, পয়লা বৈশাখও তেমনি গ্রীষ্মের প্রথম প্রহরে ধরা দেয়। মধ্য এশিয়া ও পারস্যে যেমন শীতের অবসান হয়ে প্রকৃতিতে নতুন একটি প্রাণের স্পন্দন ধরা দেয়, তেমনি দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে বিশেষ করে বাংলার মাঠ-ঘাটে চৈত্রের খরার পর বৈশাখ নিয়ে আসে নতুন দিনের শুভেচ্ছা।
নওরোজের আলোয় আলোকিত হয় মধ্য এশিয়ার প্রায় সব দেশ; আফগানিস্তান হতে শুরু করে উজবেকিস্তান, তুর্কমেনিস্তান, কাজাখস্তান, ইরান, তুরান, আজারবাইজান ও তুর্কিতেও উদ্যাপিত হয় এই দিন। পৃথিবীর প্রায় ১৫টি দেশে উদ্যাপন হয় নওরোজ।
বাঙালি সংস্কৃতির সঙ্গে পারস্য সংস্কৃতির যোগসূত্র বহুকাল পুরোনো। মোগল আমলে বাংলার দরবারে ফারসি ভাষা যেমন উচ্চ মর্যাদা পেয়েছিল, তেমনি বাংলার সাহিত্য ও সংগীতে পারস্যের প্রভাব ছিল সুস্পষ্ট। যে কারণে লালনের গানে, রবীন্দ্রনাথের কবিতায়, কাজী নজরুলের গজলে পারস্যের ছোঁয়া আজও স্পষ্ট চোখে পড়ে। পয়লা বৈশাখের পান্তা ইলিশ যেমন নতুন সূর্যের আগমনী বার্তা দেয়, নওরোজের হাফতে-সিন দস্তরখানাও জীবনের নতুন দিগন্তের প্রতীকী রূপে হাজির হয়।
যেকোনো সংস্কৃতিই কেবল একটি জাতির মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে না, বরং দুনিয়ার সব জাতি তার স্বতন্ত্র সংস্কৃতির সঙ্গে একাত্মতা পোষণ করে মিলেমিশেই পৃথিবীতে ঐতিহ্যে রূপান্তরিত হয়।
পয়লা বৈশাখ ও নওরোজ ভিন্ন দুটি দেশের ভিন্ন ভিন্ন ঐতিহ্যের অংশ হলেও দুটো সংস্কৃতির সুর মূলত এক—নতুন বছরের সূচনাকে আনন্দ, সম্প্রীতি ও আশাবাদের মাধ্যমে বরণ করে নেওয়া। এই ঐতিহাসিক উৎসবের মিলনমেলা আমাদের মনে করিয়ে দেয় নববর্ষ শুধু একটি দিন নয়; বরং এটা আমাদের স্বতন্ত্র ট্র্যাডিশন। নবজাগরণের আহ্বান, যেখানে পুরোনো দিনের গ্লানি মুছে সামনে এগিয়ে যাওয়ার প্রত্যয় নিহিত থাকে।
*লেখক: সুনান খান, শহীদ মুনুর আলকান অনাতলিয়ান লিসেসি এবং ইস্তাম্বুল ইবনে হালদুন ইউনিভার্সিটি, তুরস্ক
‘দূর পরবাস’-এ জীবনের গল্প, নানা আয়োজনের খবর, ভিডিও, ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]