ঘ্রাণ

অলংকরণ: মাসুক হেলাল

আমি এখন ঢাকা নিউমার্কেটের একটা শাড়ির দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে আছি। দোকানের ভেতর ঢুকতে যাব, ঠিক তখন দেখলাম, একজন ভদ্রমহিলা বেশ কয়েকটি শপিংব্যাগ হাতে দোকান থেকে বের হয়ে যাচ্ছেন। ভদ্রমহিলা যথেষ্ট স্মার্ট। মাথার চুলগুলো রং করা। সেই চুলের ওপর দামি একটি সানগ্লাস। তাঁর সঙ্গে ১০–১২ বছর বয়সের একটি ছেলেও আছে। আমি তাঁর সামনে গিয়ে বললাম,
-এক্সকিউজ মি, আপনার হাতে কি একটু সময় হবে?

তিনি ভুরু কুঁচকে বললেন,
-আমার হাতে সময় থাকলে কী হবে?

-না মানে আপনি যদি ব্যস্ত না হোন, তাহলে আপনাকে একটা কথা বলার ছিল।
-তোমাদের আজকালকার ছেলেদের সমস্যা কী বলো তো? তোমরা তো ছোট ছোট মেয়েকে বিরক্ত করোই, এখন তো দেখছি, তোমরা আমাদের মতো বয়স্ক নারীদেরও বাদ দিচ্ছ না। এসব কী?

-সরি আপনি সম্ভবত আমাকে  ভুল বুঝেছেন। ঠিক আছে আপনি যান, আপনাকে আমার কথা শুনতে হবে না।

-কী নাম তোমার?

-আকাশ।

-সুন্দর নাম। ওকে আকাশ, বলো কী বলতে চেয়েছ? আমি অবশ্য জানি তুমি কী বলবে।
-আপনি জানেন আমি কী বলব!

-অবশ্যই। তোমাদের মতো বখাটে ছেলেরা আর কীইবা বলতে পারে। হয়তো বলবে, আপনি অস্থির সুন্দর। পুরোই সিনেমার নায়িকা ইত্যাদি ইত্যাদি। শোনো, যা–ই বলো না কেন, একটা কথা মনে রাখবে। আমি দুই সন্তানের মা। এই যে একে দেখছ। এটা আমার ছেলে। এর বয়স ১২ বছর। আর আমার মেয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে দ্বিতীয় বর্ষে পড়ছে। সুতরাং যা বলবা, একটু হিসাব করে বলবা।

-আমি আপনাকে আবারও বলছি, আপনি আমাকে ভুল বুঝেছেন। আমি ওই রকম ছেলে না। আসলে আমি একটা শাড়ি কিনতে এসেছি। সমস্যা হচ্ছে আমি ভালো রং ও সুতা চিনে শাড়ি কিনতে পারি না। তাই ভাবছিলাম, কাউকে বলব আমাকে একটু সাহায্য করতে। দোকানে ঢুকতে যাব, ঠিক এ সময় আপনাকে সামনে পেলাম। তাই ভাবলাম, আপনাকে অনুরোধ করি। কিন্তু আপনাকে অনুরোধ করব কি, আপনি তো আমার কথা শোনার আগেই আমাকে বখাটে ছেলে মনে করে বসে আছেন।

- শাড়ি কিনবা কার জন্য? নিশ্চয় গার্লফ্রেন্ডের জন্য, তাই না? শোনো, তোমরা এই যুগের ছেলেরা সারাক্ষণ গার্লফ্রেন্ড গার্লফ্রন্ড করো কেন? বিয়ের পর তো তোমরা মা–বাবাকে এমনিতেই দেখবা না। অ্যাটলিস্ট বিয়ের আগে মা–বাবার জন্য কিছু করো। মা-বাবাকে ভালো-মন্দ কিছু কিনে দাও। শাড়িটা গার্লফ্রেন্ডকে কিনে না দিয়ে মাকে কিনে দেওয়া যায় না?

- আমার কোনো গার্লফ্রেন্ড নেই। আমি আসলে মায়ের জন্যই শাড়ি কিনতে আসছি।
-ও এই কথা? সরি তুমি কিছু মনে করো না। আসলে সুযোগ পেলেই আমি লেকচার দেওয়া শুরু করি। এমনকি আমার স্বামীকেও সারাক্ষণ উপদেশ দেই হি হি হি....। একটা সত্যি কথা বলি, প্রথম দেখায় তোমাকে আসলে বখাটে ছেলে বলেই মনে হয়েছিল। মনে হয়েছিল, তুমি আমাকে বিরক্ত করতে এসেছ। বুঝোই তো রাস্তাঘাটে মেয়েদের ছেলেরা কত বিরক্ত করে।

-সেটা অবশ্য ঠিক বলেছেন। তবে সব ছেলে কিন্তু এমন করে না। অল্প কিছু বখাটে ছেলে এসব করে। তবে ঐসব বখাটে ছেলেরা তো আপনাকে বিরক্ত করার কথা না।

-কেন কথা না? তুমি কী বলতে চাইছ, আমি সুন্দরী না?

-না না তা হবে কেন? আপনি অ-নে-ক সুন্দর।

- তাহলে নিশ্চয় বলতে চাইছ আমাকে দেখতে অনেক বয়স্ক লাগে? শোনো আমার খুব অল্প বয়সে বিয়ে হয়েছে। যার কারণে আমার এত বড় বড় বাচ্চা আছে। আসলে কিন্তু আমার বয়স বেশি না। তুমিই বলো, আমাকে দেখে কি মনে হয়, আমার এত বড় বাচ্চা আছে?
-একদম না।

অলংকরণ: মাসুক হেলাল

-কী ব্যাপার তুমি হাসছ কেন?

-সরি। আপনি খুব মজার মানুষ। আপনার সঙ্গে যতই কথা বলছি, ততই মুগ্ধ হচ্ছি।
-এই ছেলে, তুমি আমাকে হাওয়া দিয়ে কথা বলবা না। তুমি কি ভাবছ মিষ্টি মিষ্টি কথা বলে আমাকে গলিয়ে ফেলবা? তারপর নাম জানতে চাইবা। তারপর ফোন নম্বর চাইবা? তারপর বাসার ঠিকানা?

-না না, আমার মনে এসব কিছুই নেই।

-গুড। না থাকলেই ভালো। শোনো আমাকে নিয়ে কিছু ভাবার আগে বা আমাকে কোনো কিছু বলার আগে মনে রাখবা আমার বড় দুটি বাচ্চা আছে।

-জি আন্টি আমার মনে আছে। আপনি এ কথাটা একটু আগে আরেকবার বলেছেন।
-এই ছেলে, তুমি আমাকে আন্টি বলছ কেন? আমি তো তোমাকে বলেছি, আমার বয়স বেশি না।

আমি হো হো করে হেসে উঠলাম।

-আবার হাসছ কেন?

-না এমনি হাসছি। আপনি সত্যি মজার মানুষ। আপনার সঙ্গে কিছুক্ষণ কথা বললে যেকোনো মানুষের মন ভালো হয়ে যাবে।

-তোমার আঙ্কেল তো বলে উল্টো কথা। সে বলে আমি মুখ খুললেই নাকি তার মাথাব্যথা শুরু হয়ে যায়।

-আপনি না একটু আগে আপনাকে আন্টি বলতে মানা করলেন? এখন আবার আপনার স্বামীকে তোমার আঙ্কেল বলছেন কেন?

-শোনো, আমার স্বামীকে তুমি আঙ্কেল বলতে পারো। এতে কোনো সমস্যা নেই। শুধু আমাকে আন্টি বলতে পারবা না।

-আচ্ছা তাহলে আপনাকে কী বলে ডাকব?

-যুথি ম্যাডাম বলে ডাকবে।

বলে নিজেই হি হি হি করে হাসতে লাগলেন।

আমি অবাক হয়ে তাঁর হাসি দেখতে লাগলাম। তাঁর হাসিটি অবিকল আমার মায়ের মতন। আচ্ছা সব মায়েরা কি একই রকমভাবে হাসে?

আজ নিউমার্কেটে এসেছি মায়ের জন্য একটা শাড়ি কিনতে। আজ আমার মায়ের জন্মদিন। তবে এ জন্মদিনটা মায়ের প্রকৃত জন্মদিন নয়। এটা আমার ঠিক করে দেওয়া জন্মদিন।

আমি যখন নবম শ্রেণিতে পড়ি, তখন হঠাৎ করেই আমার মাথায় এলো এ বছর মায়ের জন্মদিন উদ্‌যাপন করব। আমাদের বাসায় সবার জন্মদিন উদ্‌যাপন করা হলেও মায়ের জন্মদিন উদ্‌যাপন করা হতো না। এর অবশ্য একটা কারণও ছিল। আসলে আমাদের পরিবারের কেউই মায়ের সঠিক জন্ম তারিখ জানত না। নানা জীবিত নেই। নানি আমাদের সঙ্গেই থাকেন। তাঁকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, কিন্তু তিনিও বলতে পারলেন না। আসলে আমার নানা-নানি আগের কালের মানুষ। তাঁরা এতটা সচেতন ছিলেন না যে সন্তানদের জন্মতারিখটা লিখে রাখবেন বা মনে করে রাখবেন। আমিও নাছোড়বান্দা। জিদ ধরলাম মায়ের জন্মদিন বের করেই ছাড়ব। অবশেষে বড় ভাই-বোন, বাবা-মা, নানি মিলে মিটিংয়ে বসলাম। সবাই মিলে নানিকে বিভিন্ন প্রশ্ন করে করে তথ্য নিলাম। নানির তথ্যে জানলাম, মা যুদ্ধের প্রায় ১৫ কি ১৬ বছর আগে এক তীব্র শীতের রাতে জন্মগ্রহণ করেছেন। মাসটি সম্ভবত বছরের শেষ মাস। এই তথ্য কাজে লাগিয়ে ঠিক করলাম ১৯৫৫ সালের ডিসেম্বর মাসে মায়ের জন্ম। বছর মাস তো বের করা হলো, এখন দিন? নানি বললেন দিনটি মাসের প্রথম দিকে সম্ভবত ১০ তারিখের মধ্যে কোনো একটা দিন হবে। মিটিংয়ে উপস্থিত একেকজন একেক তারিখ প্রস্তাব করল। কিন্তু কেন জানি একটা তারিখও আমার পছন্দ হলো না। আমি হঠাৎ করে মাকে বললাম,
-মা তুমি এক থেকে দশের মধ্যে একটা সংখ্যা বেছে নাও।

মা একমুহূর্ত না ভেবে বলল,
- পাঁচ
- পাঁচ কেন মা?

-তোরা যে পাঁচ ভাই–বোন,তাই।

মায়ের উত্তর শুনে মনে বললাম, ‘হায়রে মা। সন্তানের বাইরে কি তোমরা কোনো কিছু চিন্তা করতে পারো না?’

সেই থেকে ৫ ডিসেম্বর আমরা মায়ের জন্মদিন উদ্‌যাপন করি। মনে আছে, মায়ের প্রথম জন্মদিন উদ্‌যাপনের দিন মায়ের চোখেমুখে এক অন্যরকম আনন্দ দেখেছিলাম। বাবা–মায়ের জন্য একটা সোনার চেইন কিনে এনেছিলেন। ভাই-বোনেরা যে যার মতো মাকে উপহার দিয়েছিলেন। আমার মাটির ব্যাংকে অনেক টাকা জমেছিল। সেই ব্যাংক ভেঙে বড় বোনকে সঙ্গে নিয়ে মায়ের জন্য একটা শাড়ি কিনে এনেছিলাম। সম্ভবত ওই শাড়িই ছিল বাংলাদেশের সবচেয়ে কম দামি শাড়ি। তবে ওই কম দামের শাড়িটাই মা অনেক আবেগ আর ভালোবাসা নিয়ে পরেছিলেন। ওই শাড়িতে মাকে পরির মতো লাগছিল। মা শাড়ি পরে সামনে এসে বললেন,
-ওই পাগলা দেখ তো আমাকে তোর শাড়িতে কেমন লাগছে?

আমি অবাক হয়ে মায়ের দিকে তাকিয়ে রইলাম। জানিনা, কেন জানি মাকে দেখে খুব কান্না পাচ্ছিল। কান্না চেপে বললাম,
-তোমাকে পরির মতো লাগছে।

মা আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন। অনেকক্ষণ ধরে রাখলেন। সেই সময় মায়ের শরীর থেকে সুন্দর একটা ঘ্রাণ আসছিল। কেন জানি আর কান্নাটা ধরে রাখতে পারলাম না। অনুভব করলাম, আমার সঙ্গে মা–ও কাঁদছেন। আমি অবাক হয়ে মাকে বললাম—
-মা তুমি কাঁদছ কেন?

-এমনি কাঁদছি।

-না মা সত্যি করে বলো তুমি কেন কান্না করছ?

-তোর জন্য এত সুন্দর একটা দিন পেলাম। সেই আনন্দে কাঁদছি। সন্তানের ছোট ছোট ভালোবাসা একটা মায়ের জন্য যে কী, সেটা তুই বুঝবি না। মা ছাড়া দুনিয়ার আর কেউ এটা বোঝে না।

এরপর থেকে প্রতি জন্মদিনে মাকে আমি একটি শাড়ি উপহার দিই। এখন যেহেতু বড় চাকরি করি, তাই দামি শাড়িই কিনে দিই। তবে সমস্যা হচ্ছে, আমার রুচি খুবই খারাপ। আমি আসলে ভালো শপিং করতে পারি না। প্রতিবারই তাই কারও না কারও সাহায্য নিয়ে শাড়ি কিনতে হয়। বেশির ভাগ সময় দোকানদারের সাহায্য নিই। মাঝে মাঝে দোকানে অন্য কোনো নারী ক্রেতা থাকলে তাদেরও সাহায্য নিই। আজ যেমন যুথি ম্যাডামের সাহায্য নিচ্ছি।

যুথি ম্যাডাম তার হাতঘড়িতে সময় দেখে আমাকে বললেন—
- শোনো, আমি তোমাকে বেশি সময় দিতে পারব না। একটু পর আমার মেয়েকে কলাভবনের সামনে থেকে পিক করতে হবে।

-বেশি সময় লাগবে না। একটি মাত্র দোকানেই ঢুকব। আপনি যে শাড়িটা পছন্দ করবেন, আমি সেটাই কিনব। দাম নিয়ে ভাববেন না। শুধু একটা জিনিস খেয়াল রাখবেন, শাড়িটা যেন সুন্দর হয়।

- শোনো, শাড়ি শুধু সুন্দর হলেই হবে না। সেটা পরলে মানাবে কি না, সেটাও তোমাকে ভেবে দেখতে হবে। যেটা আমাকে মানাবে, সেটা হয়তো তোমার মাকে না–ও মানাতে পারে। আবার যেটা তোমার মাকে মানাবে, সেটা হয়তো আমাকে মানাবে না। আমি কী বলতে চাচ্ছি, তুমি কি বুঝতে পারছ?
-না পারছি না।

-শোনো কাপড় কিনতে হয়—যার জন্য কিনছ, তার বয়স, শারীরিক গঠন, গায়ের রং ইত্যাদি বিবেচনা করে। সুতরাং তোমার মায়ের জন্য সঠিক শাড়িটি কিনতে তোমার মা সম্পর্কে আমার কিছু তথ্য লাগবে। তা তোমার মা দেখতে কেমন?
-পরির মতন।

-তা তো অবশ্যই। মায়েরা পরির মতই হয়। ওনার গায়ের রং কেমন?
-পরির মতন।

-হি হি হি...আরে বোকা ছেলে। আচ্ছা ওনার শারীরিক কাঠামো কেমন?
-পরির মতন।

উনি মাথা ঝাঁকিয়ে বললেন,
-বুঝতে পারছি। তোমার মা পরির মতোই সুন্দর। তা হলে তো কোনো সমস্যাই নেই। পরিদের সব শাড়িতেই মানাবে।

-জি। মাকে যা পরাবেন, তাতেই সুন্দর লাগবে।

১০ মিনিটের মধ্যেই যুথি ম্যাডাম মায়ের জন্য একটা শাড়ি পছন্দ করে দিলেন। শাড়িটা অনেক সুন্দর। দোকানদার যে দাম বললেন, আমি সেই দাম দিয়েই শাড়িটি কিনলাম। শাড়ি নিয়ে দোকান থেকে বের হতেই যুথি ম্যাডাম আমাকে ধমক দিয়ে বললেন,
-আকাশ তুমি দামাদামি করলে না কেন? এমনি এমনি এতগুলো টাকা দিয়ে দিলে?
-আসলে আমি মায়ের জন্য গিফট কিনতে কখনো দামাদামি করি না। মায়ের জন্য একটা গিফট কিনছি, সেখানে আবার দামাদামি করব কেন?

উনি আমাকে আবারও ধমক দিয়ে বললেন,
-বোকার মতো কথা বলবা না। তুমি বাড়তি যে টাকাটা দোকানদারকে দিলে, সে টাকাটা তুমি একজন গরিব লোককে দিতে পারতে। ওই গরিব লোকটি তোমার মায়ের দীর্ঘ জীবনের জন্য দোয়া করত।

আমি কিছু না বলে ওনার দিকে তাকিয়ে রইলাম।

-এভাবে করুণ মুখ করে তাকিয়ে আছ কেন? এরপর থেকে এমন বোকামি করবে না।
-জি করব না। এতক্ষণ আপনি আপনার সময় নষ্ট করে আমাকে সাহায্য করেছেন, সে জন্য আপনাকে অনেক ধন্যবাদ। ভালো থাকবেন। খোদা হাফেজ।

বলে আমি সামনের দিকে পা বাড়ালাম।

নিউমার্কেট থেকে বের হয়ে ফুটপাত দিয়ে হেঁটে নীলক্ষেতের দিকে রওনা হলাম। কয়েক কদম যেতেই ফুটপাতে এক বয়স্ক নারীকে দেখলাম বসে ভিক্ষা করছেন। নারীর সামনে গিয়ে ফুটপাতে বসে পড়লাম। বললাম,
-মা, কেমন আছেন? টাকাপয়সা কেমন পাইলেন?

নারী ভুরু কুঁচকে বললেন,
-তা দিয়া আমনে কী করবেন?

-কিছু না। এমনি বললাম। শোনেন আমার কাছে দামি একটা শাড়ি আছে। অনেক দামি শাড়ি। দাম বলব না। কারণ, বললেও আপনি বিশ্বাস করবেন না। শাড়িটি আমার মায়ের জন্য কিনেছিলাম। কিন্তু সেই শাড়ি এখন আমি আপনাকে দিতে চাচ্ছি।

-ক্যান? আমারে দিবেন ক্যান? আমনের মায়ের শাড়ি আমনের মায়েরে দেন।

-আসলে আমার মা অনেক দূরে থাকেন। এত দূরে এখন যাওয়া সম্ভব না। তাই আপনাকে দিচ্ছি। তবে দুটি শর্ত আছে। এক, শাড়িটি গায়ে পেঁচিয়ে মিষ্টি একটা হাসি দিতে হবে। দুই, আমার মায়ের জন্য দোয়া করতে হবে। ঠিক আছে?

উনি কিছু না বলে ফ্যালফ্যাল করে আমার দিকে তাকিয়ে রইলেন। আমি শাড়িটা প্যাকেট থেকে বের করে নারীর গায়ের ওপর চাদরের মতো করে পেঁচিয়ে দিলাম।

-মাশা আল্লাহ। মা আপনাকে তো অনেক সুন্দর লাগছে। পুরাই পরির মতন। এবার একটা মিষ্টি হাসি দেন তো।

উনি লজ্জামাখা নিষ্পাপ একটা হাসি দিলেন। আমি অবাক হয়ে দেখলাম, পুরোই আমার মায়ের মতন হাসি। আচ্ছা সব মায়েরা কীভাবে একই রকমভাবে হাসেন?

তিনি আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন। আমি তাঁর হাতটি দুই হাতে ধরে আমার দুচোখে লাগালাম। সেই সময় আমি ওনার শরীর থেকে একটা মিষ্টি সুন্দর ঘ্রাণ পেলাম।ঠিক যেই ঘ্রাণ আমি আমার মায়ের শরীর থেকেও পেতাম।

আমি আর কিছু না বলে ওই নারীর হাতটি ছেড়ে উঠে দাঁড়ালাম। ঠিক তখনই পেছন থেকে কেউ একজন ধমক দিয়ে বললেন,
-এই ছেলে, তুমি তোমার মায়ের শাড়িটা দিয়ে দিলে?

আমি ঘাড় ঘুরিয়ে দেখলাম, যুথি ম্যাডাম অবাক চোখে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন। আমি ফান করে বললাম,
-কী ব্যাপার, আপনি আমাকে ফলো করছেন কেন? এখন তো আপনার উদ্দেশ্যই আমার কাছে ভালো মনে হচ্ছে না।

হা হা হা...।

-খবরদার বোকার মতো হাসবে না। আমি তোমার ফোন নম্বর নেওয়ার জন্য পেছন থেকে তোমাকে কয়েকবার ডেকেছি। তুমি শোনোনি। তাই ফোন নম্বর নেওয়ার জন্য তোমার পিছু পিছু এলাম।

-আমার ফোন নম্বর দিয়ে আপনি কী করবেন?

-তার আগে তুমি বলো, তুমি কেন তোমার মায়ের শাড়ি ওনাকে দিয়ে দিলে?
-আজ মায়ের জন্মদিন। শাড়িটা তো মাকে আজকেই দিতে হবে। কিন্তু উনি থাকেন অনেক দূরে। আমি আজকের মধ্যে ওনার কাছে যেতে পারব না। তাই এই মাকেই শাড়িটি দিয়ে দিলাম।

-কোথায় থাকেন তোমার মা? গ্রামে? ঢাকা শহর থেকে এখন বাংলাদেশের সব জায়গায় দিনে দিনেই যাওয়া যায়। তুমি এখন রওনা দিলে ঠিকই রাতের মধ্যে তোমার মায়ের কাছে পৌঁছাতে পারতে।

-না পারতাম না।
-কেন? কোথায় থাকেন উনি? সেন্ট মার্টিন?
-না।

-তাহলে কোথায় থাকে?

আমি আঙুল দিয়ে আকাশের দিকে দেখিয়ে বললাম,

-ওই যে, ওখানে।

আমার আঙুল লক্ষ্য করে যুথি ম্যাডাম আকাশের দিকে তাকালেন। কী ঝকঝকে স্বচ্ছ নীল আকাশ। এক ফোঁটা মেঘও নেই। তিনি যখন আকাশ থেকে চোখ নামিয়ে আমার দিকে তাকালেন। দেখলাম, তাঁর দুচোখে পানি টলমল করছে। কিছুক্ষণ তিনি আমার চোখের দিকে তাকিয়ে রইলেন। তারপর হঠাৎ করেই তিনি হাজারো মানুষের সামনে আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন। আমি কী করব বুঝতে না পেরে মূর্তির মতো শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। আমার চোখ দুটো ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে। মনে হলো, যুথি ম্যাডাম না, আমার মা–ই আমাকে শক্ত করে বুকে জড়িয়ে ধরেছেন। অনুভব করলাম, আমার গাল বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে। কান্নার সেই ঢেউ বন্ধ করতে চোখ দুটোকে শক্ত করে বন্ধ করলাম। ঠিক তখনই অবাক হয়ে খেয়াল করলাম, যুথি ম্যাডামের শরীর থেকেও সেই অতি চেনা আমার মায়ের শরীরের ঘ্রাণটি আসছে। আচ্ছা পৃথিবীর সব মায়ের শরীরের ঘ্রাণ কি একই রকম?