স্বাস্থ্যমন্ত্রীর ছুড়ে ফেলা ফাইল বর হয়ে ফিরে আসুক

নতুন স্বাস্থ্যমন্ত্রী সামন্ত লাল সেনকে ফুল দিয়ে শুভেচ্ছা জানান মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা–কর্মচারীরাফাইল ছবি: বাসস

গত ১৮ জানুয়ারি প্রথম আলোর একটি সংবাদের শিরোনাম ‘স্বাস্থ্যমন্ত্রী হওয়া সামন্ত লাল সেনের ফাইল একসময় ছুড়ে ফেলেছিলেন কর্মকর্তারা’। খবরে বলা হয়েছে, দগ্ধ রোগীদের চিকিৎসায় ৫ শয্যার ছোট একটি ইউনিট থেকে ৫০০ শয্যার হাসপাতাল ও ইনস্টিটিউট তৈরির মূল ব্যক্তি বিশিষ্ট বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জন সামন্ত লাল সেন। এ কাজ করতে গিয়ে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অনেক কর্মকর্তার টেবিলে টেবিলে ঘুরেছেন তিনি। তাঁর ফাইল ছুড়ে ফেলে দিয়েছেন কর্মকর্তারা। মন্ত্রিত্ব পাওয়ার পর স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে এসে কর্মকর্তা ও সাংবাদিকদের সঙ্গে মতবিনিময়ের সময় নিজের এমন তিক্ত অভিজ্ঞতার কথা শোনান সামন্ত লাল সেন।

গণতান্ত্রিক দেশের একটি প্রধান সংবাদপত্রের ওই সংবাদ শিরোনাম কী বার্তা বহন করে? জনগণ, অর্থাৎ করদাতাদের বেতনভুক্ত প্রশাসন, তা–ও যদি হয় ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা, তাঁদের এ রকম কার্যকলাপের দায়দায়িত্ব সরকার বা সংসদ এড়িয়ে যেতে পারে না। সংবাদ প্রকাশের পর এ–সম্পর্কিত তদন্তের কোনো সংবাদ গোচরে আসেনি। নতুন সরকারের কাছে আমাদের সবার প্রত্যাশা একটিই—প্রশাসনের সব স্তর মোটামুটি জবাবদিহির আওতায় আনা হোক। পুরোপুরি জবাবদিহি আমরা বাংলাদেশে আশা করি না। সেটা সম্ভব নয় আগামী কয়েক দশকে। বর্তমান প্রজন্ম যেদিন রাজনীতি আর প্রশাসনের উপরিস্থলে আসবে, সেদিন আশা করি জবাবদিহি একটি গ্রহণযোগ্য স্তরে পৌঁছাবে।

তবে স্বাস্থ্যমন্ত্রী সামন্ত লাল সেনকে নমস্কার ও সাধুবাদ জানাই। তিনি অত্যন্ত সাহসী একটি পদক্ষেপ নিতে পেরেছেন। মন্ত্রণালয়ে বসে সংবাদ সম্মেলনে সচিব ও ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সামনে তিনি তথ্যের একটি ভয়ংকর বোমা ফেলেছেন। তিনি যে একজন সজ্জন ও একনিষ্ঠ স্বাস্থ্যসেবক ও চিকিৎসক, তা যাঁরা তাঁকে চেনেন, তাঁরা নির্দ্বিধায় জানিয়েছেন। এ ধরনের মানুষ আজকের বাংলাদেশে যে কোণঠাসা, সেটা প্রমাণ করছে মন্ত্রীর সত্য বক্তব্য। অবশ্য এ ধরনের মানুষের সংখ্যাও দিন দিন কমছে বৈকি!

বহুল পঠিত প্রথম আলো অনলাইনের পাঠকদের মধ্যে যাঁরা মন্ত্রীর এই সংবাদ প্রকাশের পর পাঠকদের মন্তব্য পড়েছেন, তাঁরা নিশ্চয় কয়েকটি মন্তব্য লক্ষ করেছেন? নিচে ৬৮টি মন্তব্যের কয়েকটি পাঠকদের জন্য দেওয়া হলো।

‘ভালো একজন মানুষ দুর্নীতিবাজদের ধাক্কা সামলাতে পারবেন না।’

‘বর্তমান স্বাস্থ্যমন্ত্রী একজন পরীক্ষিত দেশপ্রেমিক মানুষ। সাধারণ মানুষের জন্য তিনি দেশে একটি ইতিবাচক উদাহরণ সৃষ্টি করবেন বলে প্রত্যাশা করছি।’

‘নতুন নিয়োগপ্রাপ্ত সরকারি ডাক্তারদের বাধ্যতামূলকভাবে কমপক্ষে প্রথম পাঁচ বছর উপজেলার হাসপাতালগুলোয় চাকরি করার বিধান জারি করার জন্য বিনীত অনুরোধ রইল।’

‘মাননীয় মন্ত্রী, আপনি পারবেন। আপনার হাত ধরেই স্বাস্থ্যসেবা অচলায়তন ভেঙে প্রান্তিক জনগণের দরজায় পৌঁছাবে। শুভকামনা।’

‘সাধারণ জনগণকে কিছুটা চিকিৎসা সুবিধা দিতে হলে বিএমএ, স্বাচিপ, ড্যাব ইত্যাদি চিকিৎসকদের সংগঠন বিলুপ্ত করে দিতে হবে।’

‘আগে ওষুধ কোম্পানিগুলোর বিক্রয় প্রতিনিধিদের নিয়ন্ত্রণ আইন দরকার।’

‘বর্তমান সরকারের এই একটা কাজ আমার ভালো লেগেছে। শুধু স্বাস্থ্য নয়, শিক্ষা এবং ধর্মমন্ত্রীও টেকনোক্র্যাট কোটা থেকে নেওয়া উচিত।’

স্বাস্থ্যব্যবস্থা নিয়ে আমাদের সমস্যা যেমন অনেক, তেমনি আমাদের আশা–প্রত্যাশাও অসীম। সেটা মন্তব্যগুলো দেখলেই বোঝা যায়। মানুষ স্বপ্ন থেকে যদি চাঁদে যেতে পারে এবং পরবর্তী সময়ে মঙ্গল গ্রহে যাওয়ার প্রস্তুতি নিতে পারে, তাহলে বাংলাদেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থাকেও মোটামুটি একটি সহনীয় পর্যায়ে নিয়ে আসা সম্ভব। স্বাস্থ্যমন্ত্রীকে এ জন্য ১০ বছরের একটি পরিকল্পনা নিতে হবে। এর বাইরে তাঁকে রাজনৈতিক পরিচয়বিহীন, স্বার্থবিহীন, তবে সম্পূর্ণ পেশাদার ১০ জন লোক প্রজেক্ট ব্যবস্থায় নিয়োগ দিতে হবে। তাঁদের পরিচালনা ও মনিটর করার দায়িত্ব শুধু স্বাস্থ্যমন্ত্রীর এখতিয়ারে থাকবে।

চ্যালেঞ্জ অনেক এবং সেগুলো পাঠকদের মন্তব্য থেকেই বেছে নেওয়া যাবে। সেগুলোকে পর্যালোচনা করার পর অগ্রাধিকার ভিত্তিতে পরিকল্পনা করে কার্যকর করতে হবে। প্রয়োজনে বিভিন্ন আইনকানুন স্বল্প সময়ে তৈরি করতে হবে।

কোভিডকালে বাংলাদেশের সফল ব্যবসায়ী, রাজনীতিবিদ, মন্ত্রী, আমলা, এমনকি বহু সফল চিকিৎসক চিকিৎসার জন্য সিএমএইচে ছুটেছেন। হোমরাচোমরা অনেককেই আবার বলতে শুনেছি, ‘সিএমএইচের’ মতো হাসপাতাল তৈরি করা যাচ্ছে না কেন প্রতিটি জেলা–উপজেলায়? সত্যিই তো, একই দেশে, একই সরকারের অধীনে, একই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করা চিকিৎসক, সব এক। তবু কেন এ তফাত? কোনো গবেষণার প্রয়োজন আছে কি?

গত কয়েক বছর দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমে যাচ্ছে বলে শোনা যাচ্ছে। পাচারের পাশাপাশি যে কারণে মুদ্রা বিদেশে চলে যাচ্ছে, সেটা যে চিকিৎসা খাতের ভয়াবহ অবস্থা থেকে সৃষ্টি হচ্ছে, সেটা কি বলার অপেক্ষা রাখে? পার্শ্ববর্তী দেশে কী পরিমাণ মানুষ উন্নত চিকিৎসার জন্য যাচ্ছেন এবং কেন, সেটা বিবেচনা করা উচিত স্বাস্থ্যমন্ত্রীর। এক ঢিলে দুই পাখি মারা যাবে চিকিৎসা খাতকে আধুনিক করা গেলে—আধুনিক স্বাস্থ্যসেবা এবং বৈদেশিক মুদ্রার সাশ্রয়।

স্বাস্থ্যমন্ত্রীর সততা, দৃঢ়তা, বিচক্ষণতা ও সবাইকে নিয়ে কাজ করার গুণাগুণ এবং প্রধানমন্ত্রীর সরাসরি আশীর্বাদ থাকায় আশা করি, ফাইল ছুড়ে ফেলাকে তাত্ত্বিক অর্থে সাপে বর হওয়ার মতো আন্তর্জাতিক মানের আধুনিক একটি স্বাস্থ্যসেবা উপহার দিতে পারবে এ সরকার। সব স্তরের সহযোগিতা দরকার, দরকার ধৈর্য পরীক্ষা।

আমরা সেই সুদিনের অপেক্ষায় রইলাম।
*লেখক: কামরুল ইসলাম, সুইডেনপ্রবাসী
**দূর পরবাসে ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল অ্যাড্রেস [email protected]