চক্র...
চট করে বুকিংটা দিয়ে দিন, আর যাওয়া হবে না হয়তো।
তাজমহলটা দেখতে যাবেন স্বপ্ন অনেক দিনের। ভাবছেন, আরেকটু অপেক্ষা করি। বাড়ির কিছু লোন আছে। মেয়েটার বিয়ের খরচ আছে। আরও কিছু টাকা জমিয়ে নিই। পরে নাহয় ঘুরে আসব।
পরে আর হবে নারে ভাই।
হুট করে হার্টে অসুখ ধরা পড়বে কিংবা ভাগিনার অ্যাকসিডেন্টে অনেক টাকা চলে যাবে। মায়ের চিকিৎসায় জমিটাও বেচে দিতে হতে পারে। ইন্ডিয়া হয়তো যাওয়া হবে হার্টে রিং লাগাতে, তাজমহল দেখতে নয়।
সেই তো সকাল–বিকেল কাজ আর কাজ। ব্যবসার টেনশন কিংবা বসের ঝাড়ি, ছেলের পড়ালেখার টেনশন, মায়ের অসুখ, বোনের সংসারের অশান্তি, জমিজমা নিয়ে ভাইয়ের সঙ্গে গন্ডগোল। ঘানিই তো টেনে গেলেন সারা জীবন। আর কত?
সামর্থ্য থাকলে বালি চলে যান। স্ক্যান্ডিনেভিয়ায় নর্দান লাইটটা দেখে আসুন। কিংবা কুয়াকাটা চলে যান বাচ্চাকাচ্চা নিয়ে। সেন্ট মার্টিন ঘুরে আসেন সপ্তাহখানেকের জন্য। দামি একটা হোটেলে থাকেন। হোটেলের বারান্দায় বসে সবাইকে নিয়ে সূর্যাস্ত দেখেন, সন্ধ্যায় কফির মগ হাতে ওদের আপনার গল্প শোনান। আপনার জীবনসংগ্রামের গল্প, তিল থেকে আপনার তাল হয়ে ওঠার গল্প।
বলি কি, নিজেকে একটু সময় দিন। একটা ভোরে জেগে উঠে ভাবুন, আপনিও তো একটা মানুষ। আপনারও হক আছে নিজের ওপর। এই শরীর বেচে পরিবারের ঘানি টানুন আপত্তি নেই, তবে শখ–আহ্লাদও করতে শিখুন। শুধু নয়টা–পাঁচটা কাজ করে ভাত খেলেই মানুষের ক্ষুধা মেটে না, এটাও শিখুন।
আরও কিছু টাকা জমিয়ে, আরও কিছু কষ্ট করে, হেসেখেলে বাকি জীবনটা কাটিয়ে দেওয়ার দেশে আপনি থাকেন না। আপনার শরীরই আপনার সব, আর কেউ নন। আপনার সরকার নেই, আপনার পরিবার নেই, আপনার কোনো সোশ্যাল সিকিউরিটি নেই। আপনি বড্ড একা। তাই আপনাকে নিয়েই আপনার ভাবতে হবে।
আপনার শুধু বয়সই বাড়ছে। দুর্বল হলে আপনি হবেন অন্যের বোঝা। যে সন্তানকে মানুষ করার জন্য আপনি সুখ–শান্তি বিসর্জন দিচ্ছেন, সে আপনার মতোই ব্যস্ত হয়ে যাবে। অনেক কিছুই সে চাইলেও পারবে না। তাকেও যে চক্রে ঢুকে যেতে হবে। টাকা কামাতে হবে, জমাতে হবে, বাড়ি করতে হবে, তাকেও তো ঘানি টানার চক্রে ঢুকে যেতে হবে।
ভাবছেন, অবসরে গিয়ে দুনিয়া দেখবেন? হবে না ভাই। অবসরের পর আপনার ফোন ধরার লোক পাবেন না। আপনাকে পাসপোর্ট অফিসে নেওয়ার কেউ থাকবে না। যে মানুষগুলো আপনার সোনালি সময়ে মাছির মতো লেগে ছিল, ওরা নাই হয়ে যাবে।
খুব দেরিতে আপনি বুঝে যাবেন, এই দুনিয়ার সবাই ব্যস্ত, আপনি ছাড়া। সবার কাজ, চাকরি ও ক্যারিয়ার অনেক গুরুত্বপূর্ণ, আপনি কেবল একটা এক্সপায়ার্ড শরীর টেনে নিয়ে যাচ্ছেন এক অজানা গন্তব্যের দিকে। আপনি রাগ করবেন, অভিমান করবেন। আপনি ছেলের বোঝা হবেন, বউমার চক্ষুশূল হবেন, নাতি–নাতনির হাসির খোরাক হবেন। আপনার অভিমান যে আসলে আপনার নিজের ওপর, সেটাও আপনি অনুধাবন করা শুরু করবেন।
কেবল তখনি আপনি বুঝে যাবেন, ২০ টাকা বাঁচানোর জন্য বাসস্ট্যান্ড থেকে প্রতিদিন ঘর্মক্লান্ত শরীরে হেঁটে বাসায় আসাটা ভুল ছিল। গরমের দিনে শখ করে একটা আইসক্রিম কিনে না খাওয়াটাও ভুল ছিল। অনেকবার ভেবেও টাকার কথা চিন্তা করে শহরের নতুন টার্কিশ রেস্টুরেন্টে একবারও ঢুঁ না দেওয়া ভুল ছিল। বারবার প্ল্যান করেও অনেক শখের জ্যাকেটটা, হাতঘড়িটা কিংবা মোটরসাইকেলটা না কেনা ভুল ছিল। আহা, জীবনে কোনো শখই তো পূরণ হলো না।
আপনার মনে হবে, হুটহাট এসব ছোটখাটো শখ পূরণ করলে এমন কিছু হাতি–ঘোড়া মারা যেত না। মাসে একবার সবাইকে নিয়ে বাইরে খেলে আপনি ফকির হয়ে যেতেন না। সারা জীবন আপনার সংসারের হেঁশেল সামলানো বউটাকে নিয়ে কখনো সখনো নেপাল কিংবা দার্জিলিং ঘুরে এলে আপনি পথের ফকির হতেন না; বরং ভালোবাসাটাই বাড়ত, সংসারে সুখটাই বাড়ত। শুধু এসব সুখস্মৃতি রোমন্থন করেই দুই বুড়ো–বুড়ি আরও অনেক বছর পাড়ি দেওয়া যেত।
বলি কি, চক্র থেকে বেরিয়ে যান। সন্তানদের জন্য বাড়ি, গাড়ি ও ভবিষ্যৎ বানাতে নিজেকে কষ্ট দেবেন না। আপনি মরার তিন দিনের মধ্যে সবাই ব্যস্ত হয়ে যাবে আর তিন মাসের মধ্যে আপনি ইতিহাস হয়ে যাবেন। আপনি একজীবন সঞ্চয় করে তিলে তিলে ওদের জন্য না করে বরঞ্চ জীবনের ছোট ছোট সময়গুলো ওদের সঙ্গে এনজয় করুন। ওদের জন্য এটা বেটার পাওয়া। ওদের প্রাপ্তবয়স্ক জীবনে আপনার সব সঞ্চয় অর্থমূল্যে কিছুই হবে না। ওদের বরং পারিবারিক স্নেহ–ভালোবাসায় মানুষ করে যান, ওরাই হবে বড় সম্পদ।
তাই শেষ বয়সে ভালো থাকার প্ল্যান না করে প্রতিদিন ভালো থাকুন। ষাটোর্ধ্ব বয়সে নয়, প্রতিবছর দুনিয়া দেখুন। আপনার এই যে এত ব্যস্ততার অজুহাত, এসবই আপনার নিজের সঙ্গে ছলনা। নিজেকে না দেওয়ার, নিজের জন্য না করার ছলনা। আপনি বুঝতে পারছেন না যে আপনি আকাশকুসুম কিছুই করছেন না। আপনি এসব না করলেও দুনিয়া খুব সুন্দর চলবে। নিজেকে আপনি আপনার পেশায় ও সংসারে যতটা গুরুত্বপূর্ণ ভাবছেন, আসলে আপনি ততটা গুরুত্বপূর্ণ নন।
আপনার গুরুত্ব শুধুই আপনার কাছেই। তাই নিজেকে সময় দিন, পরিবারকে সময় দিন, খরচ করুন। বিশ্বাস করুন, এত সব লেনদেনে দিন শেষে খরচের খাতায় শুধু আপনার জীবনটাই যাবে। কিন্তু চক্র ভেঙে জীবনের ছোট ছোট আনন্দগুলো উপভোগ করলে আপনার প্রাপ্তির খাতাটা নেহায়েত মন্দ হবে না।
লেখক: লিয়াকত হাসান, ম্যানচেস্টার, ইংল্যান্ড থেকে