শুভ লগ্নে হয়ে ছিল শুভ পরিণয়

নতুন প্রেমের ছোঁয়ায় হৃদয়ে আলোর জোয়ার এসেছিল, তাই তো খুশিতে চারদিকে কানাঘুষার ছড়াছড়ি। হৃদয়জুড়ে নতুন করে প্রেম এসেছিল জীবনে, ভালোবাসার প্রেম, সেপ্টেম্বর ১৯৯৩ সালে। আমার ডিপার্টমেন্টে একজন রসায়নবিদ নিয়োগ করতে হবে বলল প্রোডাকশন ম্যানেজার।

রিক্রুটমেন্ট প্রসেসের কাজ শুরু করতে বললাম আমার ম্যানেজারকে। এখানে রিক্রুটমেন্ট প্রসেসে সাধারণত ম্যানেজার, হিউম্যান রিসোর্স, যে গ্রুপের সঙ্গে কাজ করবে, সে গ্রুপের কেউ এবং ওয়ার্কার বা ইউনিয়নের রিপ্রেজেন্টেটিভের সমন্বয়ে একটি টিম তৈরি করা হয়। এ টিমের কাজ যাচাই-বাছাইপর্ব শেষ করা এবং শেষে ডিপার্টমেন্টের যিনি দায়িত্বে, তার কাছে সুপারিশ পাঠানো। ফাইনাল সিদ্ধান্ত সাধারণত তিনি নিয়ে থাকেন গুরুত্বপূর্ণ পজিশনের ক্ষেত্রে।

মারিয়া বার্সেলো নামে একটি মেয়েকে তারা সিলেক্ট করেছে। মারিয়ার বাবা স্পেনিশ, মা সুইডিশ বিধায় তার লেখাপড়ার ব্যাকগ্রাউন্ডের সঙ্গে ভাষাজ্ঞান অন্যের তুলনায় বেশি থাকা ছিল প্রধান কারণ তাকে পছন্দ করার পেছনে। আমি তার সঙ্গে সীমিত সময় কিছু কথা বলার পর তাকে চাকরির প্রস্তাব দিই।

সে দুদিন পরে জানাল যে সে একই কোম্পানির অন্য আরেকটি ডিপার্টমেন্টে অ্যানালিটিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে প্রস্তাব পেয়েছে বিধায় তাদের প্রস্তাব গ্রহণ করছে। আমার চাকরি তখন ফার্মাসিয়ার হেড অফিস স্টকহোমে।

মাঝেমধ্যে বড় বড় পার্টি, যেমনটি টিম বিল্ডিং বা বছরের শেষে ম্যানেজিং ডারেক্টর সবাইকে একত্রে করে বড় আকারে অনুষ্ঠানের আয়োজন করে থাকেন। স্টকহোমের সিটি হল যেখানে নোবেল প্রাইজের পার্টি হয়ে থাকে প্রতিবছর ১০ ডিসেম্বরে, ফার্মাসিয়া পুরো সেই সিটি হল বুকিং করেছে। এ সিটি হলে হবে আমাদের গালা ডিনার, সঙ্গে বিনোদনের ব্যবস্থাও থাকবে। এসব বড় বড় পার্টিতে প্লেস কার্ড দেওয়া হয় একে অপরকে চেনাজানার জন্য, একই সঙ্গে বলা যেতে পারে এ ধরনের সম্মেলন টিম বিল্ডিং অ্যাকটিভিটিজের একটা অংশ।

এবারের প্রোগ্রামে টোবাগো-ক্যারিবিয়ান সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, সঙ্গে স্পেনিশ নাচ-গান এবং সেখানকার খাবারদাবারের ব্যবস্থা থাকবে। আমাদের পোশাক-আশাকও কিছুটা সেভাবে অ্যাডজাস্ট করা হয়েছে, বিশেষ করে এই পার্টির কারণে।

খাবার টেবিলে বসতেই আমার সামনে যে মেয়েটির ছিট পড়েছে সে হলো সেদিনের সেই মারিয়া, যে আমার ডিপার্টমেন্টে চাকরি পেয়েও না করেছিল। চিনতে কারও দেরি হলো না। আমাদের টেবিলে ছিল সব মিলে ১২ জন। তবে মনের অজান্তে দুজনে কখন কীভাবে যে মিশে গিয়েছিলাম তা জানি না, তবে কেমিস্ট্রির সঙ্গে কাজকর্ম করি, তাই হয়তো বা সেদিন ঘটেছিল দুটি মনের ওপর কেমিক্যাল রিঅ্যাকশন।

ভালোবাসার সেতু তৈরি না হলেও তেমনটি ভাবনার জন্ম নিয়েছিল সেদিনের সেই ঐতিহ্যবাহী গালা ডিনার স্টকহোমের সিটি হলে। ভালো লাগা পরে ভালোবাসায় রূপ নিতে শুরু করে এবং ঘটনাটি আস্তে আস্তে শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশে বাবা-মার কানে এসে পৌঁছায়।
বাবা-মা শেষে ১৯৯৪ সালের মে মাসে বাংলাদেশ থেকে সুইডেনে আসেন। এসেই বাবা-মা শুরু করলেন নানা ধরনের প্রশ্ন আমাকে যেমন, মেয়ে কী করে? মেয়ের বাবা-মা কী করেন? ভাইবোন কজন এবং কী করে? সব শোনার পর তাদের উত্তর—বিয়ে হবে না। কারণ, বিদেশি মেয়ে টিকবে না।

এরপর ধর্মে খ্রিষ্টান ইত্যাদি ইত্যাদি। বিপদে পড়ে গেলাম! কী যে করি এবং কীভাবে বাবা-মাকে মোটিভেট করব! ওদিকে মারিয়ার বাবাও না করেছেন। কারণ, তিনি বাংলাদেশের ওপর একটি তথ্যচিত্র দেখেছেন, যেখানে বাংলাদেশের ছেলেরা তাদের বউকে পেটায়। অতএব, বিয়ের পরে এমনটি আমিও করতে পারি বলে তার আমার ওপর ধারণা।

এবার লাও খেলা! আমার বাবার থেকে মাকে মনে হচ্ছে বেশি কঠিন! পরের দিন বাবা-মাকে আমি বললাম, আচ্ছা, মেয়েটিকে বাসায় আসতে বলি? তার সঙ্গে আপনারা দেখা করেন? অনেক কষ্টে দুজনকে রাজি করালাম এবং ফোন করে মারিয়াকে সেদিনের ডিনারে আসতে বললাম। মা রান্না শুরু করলেন, কই মাছ রান্না করেছেন, সঙ্গে সবজি ও ডাল, ভাত।

প্রসঙ্গত, উনারা বাংলাদেশ থেকে কিছু সবজির সঙ্গে মাছও এনেছেন, তা–ও কই মাছ। আমি মাকে বললাম, মা কই মাছ তো আমরা খাব কিন্তু মারিয়া তো কই মাছ খেতে পারবে না? কই মাছে তো অনেক কাটা?

উত্তরে মা বললেন, কই মাছ যদি বেছে খেতে না পারে, তবে সবজি এবং ডাল ভাত খাবে এবং তারপর বিদায়।

আমি তো হতভম্ব হয়ে গেলাম! আমার মা বলেন কী? শুধু কি তাই? বললেন, সব শর্ত না মানলে (যেমন ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করতে হবে) এ বিয়েতে আমি নেই এবং তুমি তোমার মতো, আমরা আমাদের মতো! দুপুর থেকে দোয়াদরুদ যা মুখস্থ ছিল পড়তে শুরু করেছি। মাঝেমধ্যে ভুল হচ্ছে কিছু কিছু সুরার অংশ। বিপদের আর শেষ নেই!

সন্ধ্যা লাগতেই মারিয়া এসে দরজায় নক করতেই বুকের ভেতর ধড়ফড় করা শুরু হয়ে গেল। বিসমিল্লাহ বলে দরজা খুলতেই দেখি মারিয়া শাড়ি পরে এসেছে এবং ঘরে ঢুকে পরিচয়ে আমার বাবা-মাকে পায়ে হাত দিয়ে সালাম করল।

আমি অবাক! এদিকে আমার মা বলছেন বাবাকে—এ মেয়ে তো পুরো ট্রেনিংপ্রাপ্ত? এবং আমাকে না বললেন, তুই তো একে গোপনে সব শিখিয়েছিস এবং তোদের মধ্যে পরিচয় নিশ্চয়ই অনেক দিনের?

মারিয়ার কাজকর্ম দেখে আমি নিজেই স্তব্ধ! মাকে আর কী বলব। টেবিলে রীতিমতো কাঁটাচামচ দিয়েছি মারিয়াকে। সে দিব্বি হাত দিয়ে ভাত খাওয়া থেকে শুরু করে কই মাছ বেছে খেতে শুরু করেছে। বাবা-মা আরও অবাক!

একপর্যায়ে আমার মা তাকে একটু ধমক দিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, এই মেয়ে, তোমাদের মধ্যে কত দিনের পরিচয়?

মারিয়া একটু মৃদু হাসির সঙ্গে বলেছিল, ইসলাম ধর্মে খাবার সময় বেশি কথা বলা নিষেধ।
এতক্ষণ বাবা-মার সন্দেহ! এবার আমারও অবস্থা তাই! কিছুই বুঝতে পারছিনে! খাবার শেষে মারিয়া আমার বাবা-মাকে সব কথা বলতে শুরু করল। যেমন সে বলল, সুইডেনের স্কুলে তাদের সব ধর্মের বিষয় পড়তে হয়, জানতে হয়। অন্যদের সংস্কৃতি সম্পর্কে তারা সচেতন। এ–ও বলল, সে বাংলাদেশ সম্পর্কে একটু বেশি জেনেছে, আমার বাবা-মার আসার কথা শুনে।

মারিয়া আরও বলল, ‘আমার বাবার বাড়ি স্পেনে, সেখানে আমি ছোটবেলা থেকেছি, আমার দাদি আমাকে ছোট কাঁটাভরা মাছ খাওয়া শিখিয়েছেন। আমি এ কারণে ম্যানেজ করতে অভ্যস্ত।’ আমরা সবাই বেশ মুগ্ধ হয়ে শুনছি।

কিছুক্ষণ আগের সন্দেহজনক ভাবনার অবসান ঘটল এবং মনের ভেতরের যে ভয়টুকু ছিল, তা যেন দূর হয়ে গেল। বাবা হঠাৎ বললেন, ‘কালই বিয়ের কলমা পড়ানো হবে।’
সাহস যা জোগাড় করেছিলাম, এবার তা তো গেছেই, মনে হচ্ছিল হার্টফেল না করে ফেলি! এদিকে বড় ভাই এবং ছোট দুই বোন জলি এবং মণি ওরাও জড়িত হয়েছে। শেষে দুই দিন পর মারিয়ার বাবা-মার সঙ্গে আমার বাবা-মার সাক্ষাৎ হলো এবং বাবার দায়িত্বে সবার সমন্বয়ে হয়েছিল সেদিনের বিয়ে, যা সত্যি ভালো লাগা থেকে ভালোবাসা এবং পরে প্রণয়।

আমার বাবা-মা পরলোকগমন করেছেন, তবে মারিয়ার সঙ্গে তাদের যে স্নেহ এবং প্রীতির সম্পর্ক তৈরি হয়েছিল, তা বর্ণনা করার মতো ভাষা আমার জানা নেই। বাবা-মার দেওয়া বিয়ে জানি না কতজনের ভাগ্যে এমন সুযোগ এসেছে, যা এসেছিল আমার জীবনে।

আজ থেকে ৩০ বছর আগে দুটি ভিন্ন সংস্কৃতির সমন্বয় ঘটেছিল আমাদের দুজনের মধ্যে। হাত ধরেছিলাম দুজন দুজনার সেদিন। সে হাত ছিল ভালোবাসার হাত, তা ছাড়িনি আজও।