বাংলাদেশের অভূতপূর্ব অগ্রগতিতে ৪ আদি পেশার ভূমিকা
বাংলাদেশের অগ্রগতিতে ৪ আদি পেশার ভূমিকা রেখে চলেছে। এগুলো হলো— কৃষিকাজ, মৎস্যজীবী, মৃৎশিল্প, কুটির শিল্প।
কৃষিকাজ
বাংলাদেশের অগ্রগতির কথা বলতে গেলে শুরুতেই কৃষি কিংবা কৃষিকাজে জড়িত ব্যক্তিদের কথাই সবার আগে বলতে হয়। প্রাচীন আমলে যাঁরা কৃষিজীবী ছিলেন, তাঁরা রাজাকে রাজস্ব কিংবা রাজস্ব দিতেন আর যাঁরা ব্যবসায়ী ছিলেন, তাঁরা কর কিংবা ট্যাক্স দিতেন আর যাঁরা মুনি কিংবা ঋষি ছিলেন, তাঁরা সব প্রকার করের আওতামুক্ত ছিলেন। মজার ব্যাপার হচ্ছে, আগেকার দিনে কেবল বৈশ্য ও শূদ্রেরই কৃষিকাজের অনুমতি ছিল। উচ্চবর্ণ লোকজন এ কাজ করতেন না। বাংলাদেশ বিচিত্র বৈভবে অনন্য একটি দেশ। সম্ভবত বাংলাদেশই বিশ্বের একমাত্র দেশ, যে দেশের বিজ্ঞানীরা হরেক জাতের ধান উদ্ভাবন করতে সক্ষম হয়েছেন। তাঁদের উদ্ভাবিত গভীর জলের ধান নিম্নাঞ্চলের দেশগুলোয় আজ অনুকরণীয়। বাংলাদেশের ক্ষুদ্র জাতিসত্তর মানুষের চাষপদ্ধতি (জুম) কৃষির বিকাশ ও বৈচিত্র্যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে চলেছে, এটিকে অ্যাগ্রো–ইকোলজিও বলা যেতে পারে।
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট উদ্ভাবিত জেনেটিক রিসোর্স লোনাপানি–সহনশীল জাতের ধান সফল উদ্ভাবন করেছে। এটি একটি সারা বিশ্বের জন্য মডেল। উন্নত বীজ সংরক্ষণে গ্রামাঞ্চলে এখনো শিশি, বোতল, রাও, ধামা, কলসের বিকল্প আধুনিক সংরক্ষণাগার গড়ে ওঠেনি। মাটির স্বাস্থ্য ঠিক রাখার জন্য মাটিকে অবশ্যই আর্দ্র রাখতে হবে, হিউমাস ঠিক থাকলে মাটি শস্যকে বেশি পুষ্টি দিতে পারবে। সারমুক্ত অরগানিক খাবারের জন্য প্রাকৃতিক কৃষি ব্যবস্থাপনায় প্রজাপতি, ফড়িং, মৌমাছি, ব্যাঙ—এগুলোকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য আরও আরও কার্যকর উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন বলে আমি মনে করি। একটা সময় আমাদের গোলাভরা ধান ছিল, পুকুরভরা মাছ ছিল, গোয়ালভরা গরু ছিল। আমরা চাই, সেই সোনালি দিন আবার ফিরে আসুক। এ ক্ষেত্রে নাগরিকদের খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তন, বিজ্ঞানভিত্তিক উৎপাদন বৃদ্ধির ফলেই নিরাপদ খাদ্যবলয় গড়ে তোলা সম্ভব।
মৎস্যজীবী
মাছ উৎপাদনে বাংলাদেশ আজ বিশ্বে চতুর্থ। এ সাফল্য রাতারাতি হয়নি, আমাদের মৎস্যবিজ্ঞানীদের নিরলস পরিশ্রমেই দেশ আজ সফলতার এ অবস্থায় এসে দাঁড়িয়েছে। একটা সময় বর্ষা মৌসুমে ধরা পড়া অতিরিক্ত মাছকে শুকিয়ে মটকিতে বিশেষ কায়দায় সংরক্ষণ করে শুঁটকি করা হতো। এ প্রক্রিয়া মৎস্যজীবীদের দীর্ঘদিনের পুরোনো। বাংলাদেশের অধিকাংশ জেলেপল্লিগুলো নদীর পাড় ঘেঁষেই সৃষ্টি হয়েছে। সমতল অঞ্চলে অবশ্য বাণিজ্যিকভাবে চাষপদ্ধতির মাধ্যমে এখন অনেক হ্যাচারিই গড়ে উঠেছে। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে অনেক জেলেই এখন জীবিকার ধরন পাল্টাচ্ছেন আবার অনেক জেলে নানা প্রতিকূলতা ও রাজনৈতিক পরিবেশের কাছে অসহায় হয়ে আদি এ পেশা থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন। সমুদ্রগামী জেলেদের জীবনের ঝুঁকির জন্য এখনো ইনস্যুরেন্স প্রথা চালু হয়নি। মাছ ধরাকে যাঁরা পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছেন, তাঁরা যদি যৌথ, সংঘবদ্ধ, টিমওয়ার্কের মাধ্যমে কাজ করেন, তাহলে বড় বড় জাল, নৌকা ও আধুনিক উপকরণের মাধ্যমে জেলেরা আরও বেশি লাভবান হবেন বলে আমি মনে করি। জেলেদের নিবন্ধন, বিশেষ ক্যাটাগরিতে তাঁদের পরিচয়পত্র প্রদান, স্মার্ট কার্ড প্রদান এবং উপকূলীয় অঞ্চলে বিনা মূল্যে ওয়াকিটকি প্রদান জেলেদের জীবনমান নিরাপত্তায় সহায়ক হবে বলেই আমার বিশ্বাস।
সব শেষে বলব, আমরা মাছে–ভাতে বাঙালি, তবে আধুনিক খাবারের সঙ্গে মাছকে কীভাবে সমন্বয় করা যায়, আমাদের পুষ্টিবিজ্ঞানীদের এই খাতে কাজ করার যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে।
মৃৎশিল্প
নানা রকম শিল্প–সংস্কৃতির মধ্য দিয়েই আমাদের মৃৎশিল্প এগিয়ে যাচ্ছে, বিশেষ করে বৈশাখী মেলায় এর প্রভাব খুব লক্ষ করা যায়। মাটির এসব কাজের জন্য এঁটেল মাটি খুব উপযোগী। মাটিতে পানির রস কমে গেলে পাতিল, কলসি, সানকি, মালশা, আরও কত–কী বানানো যায়। আমি কিছুদিন আগে জাতিসংঘের সদর দপ্তরে গিয়ে একটি বিস্ময়কর ও দুর্লভ চিত্র দেখে সত্যি বিস্মিত হয়েছি। বাংলাদেশের ময়নামতি শালবন বিহারের অষ্টম শতাব্দীর একটি টেরাকোটা সেখানে সংরক্ষিত আছে প্রদর্শনীর জন্য। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১৯ সালে এটি জাতিসংঘকে উপহার হিসেবে দিয়েছিলেন। কী সৌভাগ্য আমাদের! বিশ্বের বিভিন্ন রাষ্ট্রের প্রতিনিধিরা আমাদের এ বিস্ময়কর কর্ম দেখে বিস্মিত হচ্ছেন। ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানাই প্রধানমন্ত্রীকে।
বাংলাদেশের মৃৎশিল্প রপ্তানিতে কারিকা নামক প্রতিষ্ঠানটি সত্যি প্রশংসার দাবিদার। কুমিল্লার বিজয়পুর ও সাতক্ষীরার কালারোয়া এ শিল্পের প্রসারে উল্লেখযোগ্য অবদান রেখে চলেছে। তবে মৃৎশিল্পে আমরা এখনো ফিলিপাইনকে ডিঙোতে পারিনি।
তাঁতশিল্প: তাঁতশিল্পে নরসিংদী ও পাবনা জেলা এখন শীর্ষে। পাবনার হোসিয়ারি দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় এখনো তার শ্রেষ্ঠত্ব ধরে রেখেছে। বসাক সম্প্রদায়ের লোকেরাই তাঁতশিল্পের আদি তাঁতি। সিরাজগঞ্জ ও টাঙ্গাইল তাঁতশিল্পে অভূতপূর্ব সাফল্য দেখাচ্ছে। নারীর রুচির সঙ্গে সংগতি রেখে কারুকাজখচিত আধুনিক নকশাসমৃদ্ধ তাঁতের শাড়ির কদর যেন শেষ হওয়ার নয়। স্বর্ণচূড়া, কুমকুম, সানন্দা, কটকি, নীলাম্বরি, ময়ূরকণ্ঠী, হাজারকুটি, ইকতাক, কুঞ্জলতা—আরও কত বাহারি নামের শাড়ি বাঙালি ললনাদের পছন্দ। উন্নত সুতা ভালো শাড়ি বানানোর পূর্বশর্ত হলেও নানা রকম প্রতিকূলতার কারণে উৎপাদিত পণ্যের গুণগত মান ধরে রাখা যাচ্ছে না।
কুটির শিল্প খুবই ক্ষুদ্রতম একটি শিল্প। অনেকেই এ শিল্পকে লোকশিল্পও বলে থাকেন। কুটির শিল্পের নানা শাখা-প্রশাখা থাকলেও মূলত বাঁশ ও বেতের তৈরি গৃহস্থালি শৌখিন জিনিসপত্রকেই কুটিরশিল্প বলা হয় যদিও স্বর্ণকার, শাঁখারি, কাঁসারি, পাট, চাটাই—এগুলোও কুটির শিল্পের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে, তবে এগুলোর প্রতিটিরই আলাদা আলাদা সমস্যা ও সম্ভাবনা রয়েছে।