রোজার দিন

অলংকরণ: মাসুক হেলাল

ম্যানোলা মানে টলমল শিশিরের লাবণ্য...
ম্যানোলা মানে কমোলীন সুরভি অনন্য...
ম্যানোলা ভ্যানিসিং ক্রিম।

এক বন্ধুর ওয়ালের পোস্ট পড়তে পড়তে মনে পড়ল খুব পুরোনো এ বিজ্ঞাপনের জিঙ্গেল। প্রায়ই মনে পড়ে আমার এ জিঙ্গেল। গাছে পানি দিচ্ছি বা গাড়ি চালাচ্ছি বা রান্না করছি, হুট করে মাথায় কেন জানি না, এ জিঙ্গেলই আসে। মনে হয় সৃষ্টিকর্তা কাউকে শিশিরের লাবণ্য দিয়ে ভ্যানিস করে দেওয়ার সংকেত দিচ্ছেন!

কত্ত আগের কথা..., স্কুলে যাই কি না তা–ও ঠিক মনে নেই, বিশ্রী রকমের স্মৃতিশক্তি আমার, সবকিছু মনে থাকে আবছা আবছা করে—ঠিক পুরোপুরি না, আবার ভুলেও যাই না, ঠিক মধ্যরাতের স্বপ্নগুলোর মতো। মডেলের চেহারা হালকা হলেও মনে আছে, ডাগর চোখের মিষ্টি হাসির বেশ মায়াবতী ছিলেন, কী যে টলমল লাবণ্যে ভরা কমোলীন সুরভী মাখা মুখখানি...কে জানে উনি এখন কোথায় আছেন? নামও জানি না, কেউ জানলে জানান দেবেন প্লিজ। ইউটিউবে কতভাবে সার্চ দিয়েছি, কিছুই আসে না ছাই, আর একবার যদি দেখতে পেতাম, একবার...

আচ্ছা, ম্যানোলা ভ্যানিসিং ক্রিম কি এখনো পাওয়া যায়। নাকি স্বপ্নলোকের চাবি হয়ে গেছে, ঠিক যেমন রোজার বিকেলে তুষ দিয়ে ঢাকা বরফের চাকতি মাথায় বরফওয়ালা। ডেকে যায় বরফ...বরফ..., লাগবে নাকি ঠান্ডা ঠান্ডা বরফ...

মনে পড়ে তখন স্কুলে যাই কিন্তু স্কুল রোজার জন্য ছুটি, আসরের ওয়াক্ত শেষ...ইফতারের থালাগুলো কেবল বিছানো হয়েছে টেবিলে, একটু পরই ঠিক মাপে মাপে বসে যাবে গরম ভাজা পেঁয়াজু, বেগুনি, ছোলা, খেজুর, লম্বা ফালি করা শসা...একটু দূরেই মুড়ির ডিব্বা। মায়ের কথামতো জগের পানিতে চিনি মিশিয়ে লম্বা চামচ দিয়ে ঘুটা দিতে দিতে টিভিতে চোখ রাখা, রমজানের তাৎপর্যপূর্ণ আলোচনা...কাটা কাগজি লেবুর রস চিপে শরবতে মিশিয়ে চিরাচরিত মিষ্টি চাখতে যেয়ে মনে হলো—আরে, আমি তো রোজা আছি। কোনো রকমে শরবত বানানো শেষ করে গলা উঁচু করে হয়ে গেছে বলে বারান্দায় দে ছুট, বরফওয়ালাকে দেখতে...
মা ডাকলেন, এদিকে আসো আলুর চপের বাটিটা নিয়ে যাও। গলা বাঁকা করে দাঁড়ানো নারিকেল গাছটায় বসে তাকিয়ে আছে একটা বাবুই পাখি, কিছু কি বলতে চায়! কে জানে কী...চলে এলাম রান্নাঘরে, আরও ইফতারি বসে যায় থালায় থালায়, কলিং বেল বেজে ওঠে কানের তালায়।

বাবা এসেছেন হাতভর্তি ব্যাগ, খুশিতে চকমকে হয়ে ওঠে চোখমুখ, গরম জিলাপির বাদামি প্যাকেটটা রসে ভিজে স্বচ্ছ, তেলে–সিরায় মাখামাখি, কে বলে তেল–জল মেশে না? বেশ তো মিশে গেল চিনির সঙ্গে জিলাপির প্যাঁচে, আসলে অসম্ভব বলে কিছু নেই যদি সদিচ্ছা, একাগ্রতা আর পরিশ্রম থাকে।

অলংকরণ: মাসুক হেলাল

পানিফল, লিচু নিয়ে চলল বেশ মাতামাতি, বাবার কাছে বায়না হলো বরফের। তিনি আবারও সিঁড়ি ভেঙে নেমে গেলেন বরফ আনতে, হাতে নিয়ে গেলেন এক থালা ইফতারি নিচে দণ্ডায়মান কাউকে দিতে। আজ খুশির সীমা নেই, বরফ আসবে বাসায়, খণ্ড খণ্ড মেঘ...
সময় হয়ে আসে ইফতারের,
রকমারি ইফতারি সাজানো থালা আসে পাশের বাড়ির আন্টির দরজা হয়ে, তাৎক্ষণিক ইফতারি সাজিয়ে ফেরত যায় আবার সেই থালা। তার আগে কানে ভেসে আসে আজানের ধ্বনি...চোখ পড়ে রয় পাশের বাড়ি থেকে পাঠানো ইফতারির দিকে। সেখান থেকে কী কী নিজের ভাগে পাওয়া যাবে, সেই চিন্তায় ভাইবোনদের হুটোপুটি খোঁচাখুঁচি...
হঠাৎ মায়ের এক ধমকে সব সুনসান, কপাল কুঁচকে বলে উঠলেন—শরবতে মিষ্টি কম হয়েছে, আরও চিনি লাগত...
এখন হলে বলতাম, সাদা চিনি বিষ আম্মা...
না খাওয়াই ভালো বরং ম্যানোলার টলমল শিশিরের লাবণ্য থেকে একটু মিষ্টি নিয়ে নিয়ো।

পরম করুণাময় ভালো রহমতে রেখেছেন আমাদের, নইলে এত ছোটখাটো স্মৃতি কি মগজে থাকত? রহমত না থাকলে কি রোজার দিনেও ফেসবুকে এত কিছুর দেখা মিলত? চাঁদ-তারা দেখা নিয়ে এত জল্পনা হতো? আপা থুক্কু স্যার-ম্যামদের নিয়ে ভবের হাট বসত? মানুষজন রুচি আর অরুচি ঘাঁটার এত এত সময় পেত?
আলহামদুলিল্লাহ, রহমতের বন্যা চারদিকে...
আচ্ছা যে জিনিস আপনার একদমই পছন্দ না, আপনি কি তা ঈদে নিজের জন্য কিনবেন? তাহলে সেটা নিয়ে কথা বলা বা লেখা কি সময়ের অপচয় এবং অপছন্দকে অগ্রাধিকার দিয়ে সেটার প্রচারণায় নামা নয়?
দুনিয়ায় কি আর কোনো বিষয় নেই?
এর চেয়ে ঢের ভালো,
ভোরের স্নিগ্ধতা নিশ্বাসে হাসি পেপস সবুজ জেল,
মুক্তঝরা দাঁত, মধুময় হাসি পেপস সবুজ জেল,
এর জিঙ্গেল গুনগুন করে গাওয়া...