বাবা, তোমার জন্য
বাবা দিবসে ১৬ জুন পাঠকের পাঠানো লেখা থেকে বাছাই করা লেখা প্রকাশিত হচ্ছে দূর পরবাসে।
আমার ছেলেবেলার যত সুন্দর স্মৃতি রয়েছে, তার বেশির ভাগই বাবার সঙ্গে জড়িত। আমি যখন তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ি, তখন বাবা আয়ারল্যান্ডে চলে যান। আমি ভাবতাম, কেন বাবাকে দেশের বাইরে যেতে হলো, কেন তাঁকে আমাদের সবাই থেকে দূরে একা থাকতে হয়। তখন আমি বুঝতাম না, বাবাকে কেন এ ত্যাগ স্বীকার করতে হয়েছিল। বাবার এ আত্মত্যাগের ফলেই প্রতি মাসে আমার স্কুল ফি সময়মতো জমা হতো, আমি টিউশনে যেতে পারতাম, বাজার ঠিকভাবে করা হতো এবং আমার ঈদের জামা কেনা হতো। সবই হতো, শুধু বাবাই থাকতেন না সেখানে। আমরা সবই পেতাম, শুধু বাবাকে কাছে পেতাম না। আচ্ছা, আমরা কোনো দিন কি বাবাদের বলি যে তাঁদের পরিশ্রম, তাঁদের ঘামের ফোঁটা বা তাঁদের ওভারটাইমের বদৌলতে আমরা কি নিশ্চিন্তে এসির শীতল হাওয়ায় জীবন কাটাতে পারি!
আমার বন্ধুরা যখন বলে যে আমি আত্মবিশ্বাসী, আমি জানি এর অনেকটাই বাবার কৃতিত্ব। আমার মনে আছে, আমি যখন পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ি, তখন বিজয় দিবসে স্কুলে একটি অনুষ্ঠান হচ্ছিল। বাবা আমাকে সবার সামনে মাইক্রোফোনের সামনে দাঁড় করিয়ে বললেন, ‘যা খুশি তা-ই বলো, দেশকে কেন ভালোবাসো, তা বলো।’ আমি ভাবলাম, এটা তো আমি জানি! আমি অবলীলায় বলে গেলাম। আমি জানতাম, সেখানে একজন মানুষ আছেন যিনি হাততালি দেবেন, আমি যা-ই বলি না কেন। সেই আত্মবিশ্বাসই আমাকে পরবর্তী সময়ে সাহস জুগিয়েছে এবং অনুপ্রেরণা দিয়েছে পাবলিক স্পিকিং, বিতর্ক প্রতিযোগিতা বা টেলিভিশন উপস্থাপনায়।
দেশের বাইরে পড়তে আসার যাত্রা আমার জন্য সহজ ছিল না, কিন্তু বাবা-মা সেটিকে অনেকাংশে সহজ করে দিয়েছেন। তাঁরা শুধু আমাকে স্বপ্ন দেখতেই অনুপ্রেরণা দেননি, বরং তা পূরণে অনেকখানি এগিয়ে দিয়েছেন। আমার বাবা আমাকে সেই জীবন দিতে চেয়েছেন, যা আমি চেয়েছি; সেটি নয়, যা সমাজ বা চারপাশের মানুষ আমার জন্য চেয়েছে।
আমার বাবা আমার কাছে আলাদিনের ইচ্ছাপূরণের দৈত্যের মতো। ছোটবেলায় আমি একবার বলেছিলাম, আমার ইচ্ছা, আমাদের একদিন নীল রঙের ডুপ্লেক্স বাড়ি হবে। তারপর কত সময় পেরিয়ে গেল। সত্যি বলতে, আমার সেই কথা আর মনেও ছিল না। কিন্তু বাবা তা ভোলেননি। আমার সেই ইচ্ছা পূরণ করতে বাবার প্রায় দুই দশক লেগেছিল। তবু তিনি তা পূরণ করেছেন। বাবা-মায়ের সব পরিশ্রম, সব সেভিংস, সবটা তাঁরা এই বাড়ির পেছনে দিয়েছেন। আমার বাবা-মা প্রায় শূন্য থেকে শুরু করেছেন, অথচ আজকের এই প্রাপ্তি তাঁদের সততা ও কঠোর পরিশ্রমের ফল। আমি জানি না, সেই টিনের ঘর থেকে আজকের ডুপ্লেক্স বাড়ি দেখে আমার কী অনুভূতি হয়! সুখ, গর্ব না ফেলে আসা জীবনের প্রতি স্মৃতিকাতরতা!
এখন যখন আমি কোনো এক বিকেল বেলায় আমাদের বাড়ির বারান্দায় দাঁড়িয়ে চায়ের কাপে চুমুক দিই, নিজেকে খুব ভাগ্যবান মনে হয়। এটা ভেবে যে আমি এমন বাবা পেয়েছি, যিনি আমাকে শিখিয়েছেন কীভাবে সৎ হতে হয়, পরিশ্রমী হতে হয়, আত্মবিশ্বাসী হতে হয়, স্বপ্ন দেখতে হয় এবং ভালোবাসতে হয়, নিজেকে এবং চারপাশের সবকিছুকে। কীভাবে সবার জন্য, সবাইকে নিয়ে বাঁচতে হয়। আমি সৃষ্টিকর্তার কাছে আমার কৃতজ্ঞতার সবটা প্রকাশ করি এমন বাবা পেয়েছি বলে।
*লেখক: আফসানা আলম প্রীতি, ওহাইও, যুক্তরাষ্ট্র
*দূর পরবাসে ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]