ক্যাম্বেলটাউন বাংলা স্কুলের আয়োজন: ‘সব কটা জানালা খুলে দাও না’
ক্যাম্বেলটাউন বাংলা স্কুল মাতৃভাষা, বাংলা সংস্কৃতি, কৃষ্টি, ঐতিহ্য ধারণ ও চর্চার পাশাপাশি আবহমান বাংলার খাদ্যতালিকার অপরিহার্য অনুষঙ্গ পিঠাপুলিকে নতুন প্রজন্মের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিতে চায়। দেশ ছেড়ে আসা পিঠার স্বাদবঞ্চিত বাঙালির রসনা তৃপ্ত করতে এবং বাংলা স্কুলের সার্বিক উন্নয়নে তহবিল সংগ্রহ করতে স্থানীয় সময় ২১ জুলাই সিডনির গ্রেগ পারসিভাল কমিউনিটি হল, ইঙ্গেলবার্নে বসেছিল ‘সব কটা জানালা খুলে দাও না’ শীর্ষক এবারের পিঠার আসর।
বাংলাদেশের সাম্প্রতিক কোটা সংস্কার আন্দোলনে ঘটে যাওয়া মর্মান্তিক প্রাণহানির ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে এবারে পিঠা ‘উৎসব’-এর মেজাজকে প্রত্যাহার করে নিয়ে একটি শোক ও সহমর্মিতার আবহ তৈরি করা হয়। অনুষ্ঠানে বাংলাদেশে সাম্প্রতিক ছাত্র বিক্ষোভে এবং মহান মুক্তিযুদ্ধ ও সব গণতান্ত্রিক সংগ্রামে সব শহীদের স্মৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধাঞ্জলি নিবেদন করে এক মিনিট নীরবতা পালন করা হয়। আয়োজন থেকে তহবিলের কিয়দংশ বাংলাদেশে শহীদ পরিবারের কাছে পাঠানোর কথা জানানো হয়।
সকাল ১০টায় বাংলা স্কুল সাধারণ সম্পাদক রাফায়েল রোজারিও সবাইকে স্বাগত জানান। এর পরপরই স্কুলের কার্যকরী কমিটির সদস্য কাজী আশফাক রহমান ক্যাম্বেলটাউন বাংলা স্কুল ও বাংলা স্কুলের পিঠা আয়োজনের প্রেক্ষাপট তুলে ধরেন। পরিপাটি এবং রকমারি পিঠার সমাহারে সাজানো আয়োজনে উল্লেখ্যযোগ্যসংখ্যক উপস্থিতি লক্ষ করা যায়। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে সিডনির বিভিন্ন প্রান্ত থেকে বাঙালিরা এসে অনুষ্ঠানে যোগ দেন।
পিঠা আয়োজনের পুরো সময়ে ছাত্রছাত্রী, স্কুলের নিজস্ব শিল্পী ও সিডনির প্রখ্যাত শিল্পীদের পরিবেশনায় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হয়। এবারের আয়োজনে পরিবর্তিত ভাবনার সঙ্গে সংগতি রেখে পুরো অনুষ্ঠানের পরিকল্পনা নেওয়া হয়।
অনুষ্ঠানের প্রথম পর্বে স্কুলের ছাত্রছাত্রীদের একটি আকর্ষণীয় পরিবেশনা উপস্থিত সবাইকে মোহমুগ্ধ করে।
নাচে, গানে ও কবিতা আবৃত্তিতে শিক্ষার্থীদের আত্মবিশ্বাস ও মুনশিয়ানার ছাপ ছিল স্পষ্ট। অংশগ্রহণ করেন মিকাইল, যারা, গার্গী, সারিনা, সাজিব, ওমায়রা, নাজিফা, সুহানা, মুনাজ্জাহ, রাইনা, নুসাইবা হক, ইমরান, ইয়ারা, সোহারদিতি, অনিরুদ্ধ, নাশভা, আদিয়ান, আমীনা, নুসাইবা আল-ইন্সিরা, নাশিয়া, মৃণ্ময়ী, জারিফ, আদ্য, অস্কার, অর্ণিলা, মাহরুস, ইউসুফ, অর্ণা, মারজান, রেহনুমা ও অলিভিয়া।
পারস্পরিক মেলবন্ধন তৈরির প্রয়াসে ছোটদের পর্বে আমন্ত্রিত হয়ে আসে বারডিয়া বাংলা স্কুল, বিএসপিসি বাংলা স্কুল ও কিশলয় কচিকাঁচার খুদে শিক্ষার্থীরা। প্রতিটি স্কুল নিজ নিজ পরিবেশনায় নিপুণতার সুস্পষ্ট স্বাক্ষর রাখতে সক্ষম হয়। বারডিয়া বাংলা স্কুলের ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে ছিলেন আয়ান, আরিমা, আহারার, আরিব, আদিরা, জ্যাক, ইনারা, আরাভ, নোয়া ও জিভা। কিশলয় কচিকাঁচার খুদে শিল্পীরা হলো সামরিন, মুনিবা, অনিশ, প্রীতিশ, লিবনী, রিখিয়া, ঋদ্ধ, আরিশ, অর্ণব, ওয়াফীক, ইনআয়া, ঋদ্ধি, শেরিশ, আরোরা ও মেহুলী। বিএসপিসি বাংলা স্কুলের শিক্ষার্থীরা হলেন অন্নিকা দত্ত ও ঈপ্সিতা দত্ত।
ক্যাম্বেলটাউন বাংলা স্কুলের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা নাজমুল আহসান খান তাঁর তিন প্রজন্মের পরিবার নিয়ে একটি পরিবেশনা উপহার দেন। ঐতিহ্যবাহী খান পরিবারের সদস্যরা হলেন হারমোনিয়ামে দাদা নাজমুল আহসান খান, তবলায় বাবা, বাংলা স্কুলের প্রাক্তন ছাত্র সজীব আহসান খান আর গান ও নৃত্যে কন্যাদ্বয় জেইনা খান ও জাহিয়া খান।
এ পর্যায়ে ক্যাম্বেলটাউন বাংলা স্কুল অধ্যক্ষ রুমানা খান মোনা উদ্ভূত পরিস্থিতিতে অনুষ্ঠানটির আয়োজন বাতিল না করার পূর্বাপর প্রেক্ষাপট ব্যাখ্যা করেন এবং স্কুলের বিভিন্ন কার্যক্রম তুলে ধরে সবার সন্তানদের বাংলা স্কুলে নিয়ে আসতে অনুরোধ করেন।
অনুষ্ঠানের দ্বিতীয় পর্বে স্কুলের নিজস্ব শিল্পী এবং আমন্ত্রিত সিডনির বরেণ্য শিল্পীরা অনুষ্ঠানের মেজাজের সঙ্গে সংগতি রেখে তাঁদের পরিবেশনা উপস্থাপন করেন। সংগীতে দেশভাবনা তুলে আনেন এ কে এম ফারুক, শরীফা সুলতানা মুন্নি, সাজ্জাদ চৌধুরী বাপ্পী, সুমিতা দে, অভিষেক রায় প্রান্ত, আনিসুর রহমান ও রোকসানা বেগম দম্পতি, সাজ্জাদ হোসেন, লুৎফা খালেদ, মিঠু স্বপ্ন ও ফায়সাল খালিদ শুভ। কবিতায় দেশবন্দনা ও সমসাময়িক পরিস্থিতির চিত্রপট তুলে আনেন মাজনুন মিজান, শাকিল চৌধুরী, মৌমিতা চৌধুরী ও কন্যা মেহুলী বোস, শাহিন শাহনাওয়াজ, নাসরিন মোফাজ্জল ও রুমানা সিদ্দিকী। নৃত্যে বাঙালি শিল্পভাবনা তুলে আনেন নবনীতা শিমুল ও শিল্পীকন্যা হৃদিয়া দাস। বেহালায় মাটি ও মানুষের কথা তুলে আনেন যন্ত্রশিল্পী আবীর হারুনী।
সবশেষে দেশের সর্বশেষ পরিস্থিতিকে উপজীব্য করে, মহান মুক্তিযুদ্ধ ও সব গণমানুষের মানুষের সংগ্রামকে একই সূত্রে গেঁথে একটি পথনাটক পরিবেশনা। নাটকের মূল ভাবনায় ছিলেন তানিম মান্নান, মাজনুন মিজান, মাহবুবুল মহসিন খান, আজিম সাগর ও ফারহানা বীথি। ধারাবর্ণনায় ছিলেন তানিম মান্নান ও ফারহানা বীথি। নাটকের চরিত্রায়ণে ছিলেন ক্যাম্বেলটাউন বাংলা স্কুলের ছাত্রছাত্রী, শিক্ষক ও অভিভাবকেরা।
অনুষ্ঠানের প্রধান সমন্বয়কের দায়িত্বে ছিলেন নাজমুল আহসান খান, ক্যাম্বেলটাউন বাংলা স্কুলের শিক্ষার্থীদের পরিবেশনা পর্বের পরিকল্পনা ও নির্দেশনায় ছিলেন লুৎফা খালেদ এবং ফায়সাল খালিদ শুভ। পর্বটি পরিচালনা করেন সংগীত শিক্ষক জয়তী রায় সোমা ও তবলায় সংগত করেন সজীব খান।
সঞ্চালনা করেন শ্রেণিশিক্ষক অনিতা মণ্ডল। মঞ্চে ছাত্রছাত্রীদের সমন্বয়কের দায়িত্ব পালন করেন শ্রেণিশিক্ষক শায়লা ইয়াসমিন নুসরাত, নুসরাত মৌরি, সায়মা হক ও অনিতা বিশ্বাস মিরা।
আমন্ত্রিত অতিথি পর্বের সঞ্চালনা করেন আজিম সাগর ও ফারহানা বীথি দম্পতি। এই পর্বে তবলায় সংগত করেন শুভ আহসান খান। শব্দ নিয়ন্ত্রণে ছিলেন নাজমুল আহসান খান ও ফায়সাল খালিদ শুভ।
শিল্প নির্দেশনা ও মঞ্চসজ্জায় ছিলেন মাজনুন মিজান, তানিম মান্নান, মহসিন খান, ফায়সাল খালিদ শুভ, সম্রাট ও মামুন। প্রযুক্তি স্থাপনা ও ব্যবস্থাপনায় ছিলেন রাফায়েল রোজারিও ও মোস্তাফা হাসান জিসান।
সহায়তায় ছিলেন অপলা, অরূপা ও নূরীণ। প্রচারে ছিলেন ইয়াকুব আলী, হিসাবরক্ষণে ছিলেন মোস্তাফা হাসান জিসান। আপ্যায়নে ছিলেন শাহীন, অপূর্ব, শরীফ, মাসি খান স্বপন, মহসিন, কিবরিয়া, মইন, তমাল, মামুন, রঞ্জন, বিশাখা, সিলভিয়া, লিন্ডা, তাপসী, শায়লা, তাবাসসুম, সুমিত, হোসেইন, সংগীত, ইয়াকুব, সাবিহা, আজিজ, সায়মা, টপি, নূরীণ, সৃজা, রাত্রি, আলিশা, দৃপ্ত, লুৎফা, অনু, নুসরাত, মৌরি, সায়েমা, মিরা, ফেরদৌস, সোমা, মেগডালিনা, বর্ণী, সন্ধ্যা ও দিশা।
অনুষ্ঠানের সময়ে হলরুমের ভেতরে ও বাহিরে সার্বিকভাবে টহল ডিউটিতে ছিলেন মাসি খান স্বপন। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একটি প্রতিষ্ঠানসহ আরও অনেকে বিভিন্নভাবে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে এগিয়ে এসেছেন, তাদের মধ্যে অন্যতম টুকিটাকি গ্রোসারিস, জমিদার বাড়ি রেস্টুরেন্ট, একই ব্যবস্থাপনার অধীনে; প্রাইসলাইন ফার্মেসি, মিন্টো ভিলেজ ডিসকাউন্ট ফার্মেসি, মিন্টো গ্রুপ ডিসকাউন্ট ফার্মেসি ও শাপলা সুইটস, ইঙ্গেলবার্ন এবং স্কুলের সব সময়ের সুহৃদ সিডনির প্রখ্যাত সাংবাদিক নাঈম আবদুল্লাহ। বিকেল ৫টায় সবাইকে ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানিয়ে ভবিষ্যতেও সবার সহযোগিতা কামনা করে পিঠা আয়োজন অনুষ্ঠানের সমাপ্তি ঘোষণা করেন সভাপতি ফায়সাল খালিদ শুভ।
প্রসঙ্গত, উল্লেখ্য ক্যাম্বেলটাউন বাংলা স্কুল প্রতি রোববার সকাল দশটা থেকে বেলা একটা পর্যন্ত সব বাংলা ভাষাভাষীর জন্য উন্মুক্ত থাকে।