ভালোবাসার হাতছানি

মনন খুব সকালে ঘুম থেকে উঠেছে। আজ সে অনেক দিন পর বাড়ি যাবে। বুয়েটের টার্ম ফাইনাল শেষ হয়েছে গতকাল। রাতে হলের কক্ষগুলোয় অনেক রাত অবধি আলো জ্বলেছে। ছাত্ররা পরীক্ষা শেষে সবাই আনন্দ-ফুর্তিতে রাত কাটিয়েছে। মনন সকালের নাশতা সেরে একঝলক খবরের কাগজে চোখ বুলিয়েই দৌড় দিল রেলস্টেশনের দিকে। ঘড়ির কাঁটা তখন আটটায় ঠেকেছে, একটি ট্রেন ছাড়বে ছাড়বে বলে হর্ন বাজিয়ে চলছে। মনন দৌড়ে ট্রেনের কামরায় উঠে পড়ল। তেমন ভিড় নেই। একটি কামরায় দুটি মেয়ে বসা, তাদের সামনের আসন ফাঁকা। মনন একটু দোনামনায় ছিল, মেয়ে দুটোর সামনে বসলে সারা রাস্তা অনেক অস্বস্তিতে যাওয়ার আশঙ্কা আছে। আজকাল মেয়েরা অনেক এগিয়ে গেছে, তাই ছেলে হিসেবে একেবারে ওদের সামনে বসবে কি না, চিন্তায় ছিল।

বুয়েটের ছেলে, মাথায় বুদ্ধির অভাব নেই। মনন ভেবে দেখল, মেয়ে দুটির সঙ্গে কথা বলা শুরু করতে পারলে অস্বস্তি অনেকাংশে কেটে যাবে। কীভাবে শুরু করা যায়? মেয়ে দুটি এত সকালে, কোনো কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী হবে। খবরের কাগজে একটি শিরোনাম ছিল ইডেন কলেজের ছাত্রী হলে মারামারি হয়েছে, তাই হল ছাড়তে বলা হয়েছে। মনন ভাবল, মেয়ে দুটি ইডেনের হবে। তাই ঝড়ে বক মরার মতো বলল, ‘আপনারা কি ইডেনে পড়েন?’ মেয়ে দুটি অবাক! এক অজানা অচেনা ছেলে কীভাবে বলছে, আমরা ইডেনে পড়ি? একজন উত্তর দিল, ‘জি, ইডেনে পড়ি। তবে আপনি জানলেন কীভাবে?’ শুরুটা এভাবেই।

মেয়ে দুটি নাম বলল, শীলা আর রীতা। এবার মনন তার নাম বলতেই তারা একটু স্মিত হাসি দিল। মনন তো লজ্জায় পড়ে গেল, তার নাম কি এতই খারাপ? বল্টু তো আর না। মনন একটু বিরক্তি নিয়ে জিজ্ঞাসা করল, ‘আপনারা আমার নাম শুনে হাসলেন কেন?’ কোনো উত্তর নেই। উত্তর থাকার কথাও না। কেউ কি জানত, গত রাতের স্বপ্নের মানুষ সকালে বাস্তবে একহাত দূরত্বে বসে শীলার বুকে ডুগডুগি বাজাবে? কিছুক্ষণের নীরবতা রীতাকে অস্থির করে দিল। সে বলল, গত রাতে শীলা বলছিল, ‘আমার হাসবেন্ডের নাম মনন হলে, আমি তাকে মনন ভাই বলে ডাকব।’ কী অবাক কাণ্ড, মনন এক অজানা অচেনা মেয়ের মনের কোণে আগে থেকেই ঠাঁই করে রেখেছে। এক অভূতপূর্ব অনুভূতি এসে মননের মুখ লাল করে দিল। মনে হচ্ছিল বসন্তের সেই কৃষ্ণচূড়ার রক্তিম লাল ফুলগুলোর আলতো ছোঁয়ায় হৃদয়ে এক ভালোবাসার জোয়ার এসে গেল। ভালোবাসার আগুনের লেলিহান শিখায় নিজেকে অনেক উষ্ণ লাগছে। একটি মেয়ে তার নামের একজনকে নিয়ে স্বপ্ন বুনে যাচ্ছে। মনন জীবনে কোনো মেয়ের কাছে এর আগে অবলীলায় কোনো দিন এত মিষ্টি কথা শুনেনি। শীলাও যেন একটু হকচকিয়ে গেল, স্বপ্ন পুরুষের সঙ্গে কাকতালীয় ভাবে দেখা। তাহলে কি টগবগে যৌবনে ভালোবাসার মানুষের অপেক্ষার কি শেষ হতে চলেছে? সৃষ্টিকর্তা কি তাহলে স্বর্গীয় প্রেমের উপন্যাসটি লিখেই ফেলেছেন? কত দিন কত রাত ধরে লালিত স্বপ্ন যেন সত্যি হতে চলেছে। শীলা একটু একটু কাঁপছিল, কেন জানি শরীরের ইন্দ্রিয়গুলো অভূতপূর্ব ছন্দে শিহরিত হতে লাগল। হৃদয়ের মধ্যখানে থাকা সুপ্ত আগ্নেয়গিরি যেন এখনিই অগ্ন্যুৎপাত হবে।

ট্রেন চলছে, মনন ভাইয়ের চোখে চোখ রেখে শীলা যেন জানিয়ে দিচ্ছে অন্তরের অন্তস্তলে লুকানোর ভালো লাগার গল্প। হঠাৎ চানাচুর ওয়ালার বিচরণ শীলাকে ঘোরের মধ্য থেকে বাস্তবে ফিরিয়ে আনল। সবাই মিলে চানাচুর খাচ্ছে, ট্রেন চলছে, গল্পও চলছে। অজানা অচেনা মানুষ তিনটিকে দেখলে বোঝার উপায় নেই যে তারা ঘণ্টা দুয়েক আগেও আসলে কেউ কাউকে চিনত না। শীলা ভাবছে আর গুন গুন করে গাইছে, এই পথ চলা যেন শেষ না হয়....

মনন আগে কখনো মেয়েদের সঙ্গে এত গল্প করেনি। সারা জীবন শুধু পড়া আর পড়া। স্কুলে ফার্স্ট বয় হিসেবে অনেক মেয়ের ভালো লাগা নীরবে পেয়েছে, যদিও মুখ ফুটে কেউ কিছু বলেনি। প্রেম থেকে নিজেকে নিরাপদে দূরত্বে সরিয়ে রেখে জীবনের উন্নতির লক্ষ্যে পরিশ্রম করে এসেছে। গ্রামের ছেলে, নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান। প্রেম নামক রোগে পড়লে জীবনের লক্ষ্য থেকে বিচ্যুতির আশঙ্কা আছে। স্কুলে পড়ার সময় অনেকে বলেছে, তোমাকে জীবনে শাইন করতে হবে। মনন জানে, মেয়েদের ব্যাপারে যে যত বেশি অন্ধকারে থাকবে, তার জীবনে তত বেশি আলো আসবে। মেয়েদের সঙ্গে বন্ধুত্ব যদি জ্যামিতিক হারে বাড়ে, জীবনে উন্নতির সম্ভাবনাও জ্যামিতিক হারে কমে। তাই সাধু সাবধান, মনন মেয়েদের চোখের দিকে কখনো তাকাত না। মেয়েদের চোখ নাকি মায়ার সাগর। তাদের চোখের দিকে তাকালে সেই সাগরে নিমজ্জিত হওয়ার আশঙ্কা থাকে। মায়ার সাগর থেকেই প্রেম বৃক্ষের জন্ম। তাই, সহজ রাস্তা হলো চোখের দিকে না তাকানো। মাটির দিকে তাকিয়ে পথ চললে মায়ার সাগরে ডুবতে হবে না, হোঁচট খেতেও হবে না। মনন ইঞ্জিনিয়ারিং পড়লেও মনের মাঝে সুপ্ত প্রেমের কাব্যচর্চা করেছে সব সময়। ট্রেনে যুবতী মেয়ের সঙ্গে সহযাত্রা যেন খোদার ইচ্ছার প্রতিফলন। তাই মনন এই অল্প সময়ের মাঝেই একটি প্রেমের কাব্য মনে মনে রচনা করে ফেলেছে।

শীলা তুমি যদি শীলা হও, আমি হব বৃষ্টি
দুজনে এক সঙ্গে ঝরে করব অপরূপ সুরের সৃষ্টি।

তিনটা ঘণ্টা পার হয়ে গেল। কিছুক্ষণ পর ট্রেন থেকে নামতে হবে। শীলার মনে অজানা ভয় কাজ করছে, এ যেন হারানোর ভয়। মনন ভাইয়ের সঙ্গে আবার দেখা হবে কী? আস্তে আস্তে ট্রেন স্টেশনে এসে থামল। প্ল্যাটফর্মে মানুষের ভিড়। সবাই ট্রেন থেকে নেমে একে অপরের কাছ থেকে বিদায় নিল। শীলার হাত–পা যেন ঠান্ডা হয়ে আসছে। ভালোবাসার ফুল ফুটেই কি ঝরে পড়ল নাকি? মনন ভাই এরই মাঝে মানুষের ভিড়ে হারিয়ে গেল। শীলা যথারীতি দুর্গাপুরের বাস নিয়ে বাড়ি ফিরে গেল। যাওয়ার আগে মননকে জানিয়ে দিল প্রেমের আহ্বান।

কাহিনি এখানেই শেষ নয়। সপ্তাহখানেক পর শীলা আবার ঢাকায় ফিরবে। মননও ফিরবে বুয়েটে। শহরে আবার শীলার সঙ্গে মননের দেখা। শীলা মননকে দেখে চিৎকার করে উঠল, এই যে মনন ভাই। রিকশা থেকে নেমে শীলা মনন ভাইকে ঠিকানা দিয়ে বলল, মনন ভাই, আসবেন। খোদার ইচ্ছা, তিনি চেয়েছিলেন দুজনের জুড়ি মেলাতে। কিন্তু মনন সেই আগের মতোই। জীবনে উন্নতি করতে হবে, তাই শীলার খোঁজ নেয়নি।

মনন গুগলে সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে কাজ করছে। প্রতিদিন নানা রকম অ্যালগরিদম নিয়ে নাড়াচাড়া করতে হয়। নিজের জীবনের যোগ–বিয়োগটাই কেমন জানি গোলমেলে হয়ে রইল। জীবনে উন্নতি করেছে ঠিকই, কিন্তু মনের মাঝে কী যেন নেই এর অনুভূতি সব সময় কাজ করে। নিজের অজান্তেই যেন কাউকে সে খোঁজে ফিরে। মাঝে মধ্যে সে ভাবে, ঈশ্বরের ইচ্ছাকে অসম্মান করা ছিল জীবনের বড় ভুল। উন্নতি আসলে আপেক্ষিক বিষয়। কেউ তাজমহল পেয়েও খুশি হয় না, আবার কেউ কুঁড়েঘরে বসে শুকনা রুটি পেয়ে সুখের কাব্য রচনা করে। টাকাপয়সা, বড় চাকরি মানুষকে উন্নতির সাধ দেয় না। মানুষ যখন দেখে সে অপরের কাছে গুরুত্বপূর্ণ, তখনই নিজের জীবনকে সার্থক মনে করে। চারপাশের মানুষের ভালোবাসা মানুষকে উন্নতির শিখরে আরোহণ করতে সাহায্য করে। মননও চায়, জীবনের উন্নতির উপলব্ধি। আর আশীর্বাদ থাকে শীলার প্রতি। শীলাকে গুগলে অনেকবার খুঁজেছে, কিন্তু পায়নি। শীলা হয়তো গুগলের এর ডাটাবেজে নেই, কিন্তু মননের হৃদয়ে রয়ে গেল।

লেখক: নূরুল আনোয়ার মামুন, তড়িৎ প্রকৌশলী হিসেবে গাড়ির কোম্পানিতে কর্মরত, মিশিগান, যুক্তরাষ্ট্র